শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীরামকৃষ্ণ।

কথামৃত : ১-৯-১ : বৈকুণ্ঠ : আমরা সংসারী লোক, আমাদের কিছু বলুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ : তাঁকে জেনে—এক হাতে ঈশ্বরের পাদপদ্মে রেখে আর এক হাতে সংসারের কার্য কর।

বৈকুণ্ঠ : মহাশয় সংসার কি মিথ্যা?

শ্রীরামকৃষ্ণ : যতক্ষণ তাঁকে না জানা যায়, ততক্ষণ মিথ্যা। তখন তাঁকে ভুলে মানুষ ‘আমার আমার’ করে, মায়ায় মুগ্ধ হয়ে কামিনী কাঞ্চনে মুগ্ধ হয়ে আরও ডোবে।…

“তোমরা তো নিজে নিজে দেখছো সংসার অনিত্য। এই বাড়িই দেখো না কেন? কত লোক এলো গেল! কত জন্মালো কত দেহত্যাগ করলে। সংসার এই আছে এই নাই। অনিত্য। যাদের এতো ‘আমার আমার’ করছো চোখ বুজলেই নাই। কেউ নাই, তবু নাতির জন্য কাশী যাওয়া হয় না। ‘আমার হারুর কি হবে?’ …এরূপ সংসার অনিত্য।…তাঁকে জেনে সংসার করলে অনিত্য নয়। …তাঁকে যদি লাভ করতে পারো, সংসার অসার বলে বোধ হবে না।…”
শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের বহু জায়গায় বলেছেন, “আমি” ও “আমার” “অজ্ঞান”। বলেছেন “জীবের অহংকারই মায়া। এই অহংকার সব আবরণ করে রেখেছে। আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল। যদি ঈশ্বরের কৃপায়, ‘আমি অকর্তা’ এই বোধ হয়ে গেল, তাহলে সে ব্যক্তি তো জীবনমুক্ত হয়ে গেল। তার আর ভয় নাই। (কথামৃত : ১-৪-৬)

“অহংকার হয় অজ্ঞানে। অজ্ঞানে বোধ হয় আমি কর্তা। ঈশ্বর কর্তা, ঈশ্বরই সব করছেন, আমি কিছু করছি না—এ বোধ হলে তো সে জীবনমুক্ত। ‘আমি কর্তা’ ‘আমি কর্তা’—এই বোধ থেকেই যত দুঃখ, অশান্তি।” (কথামৃত : ১-২-৮)

অজ্ঞানের মূল শিকড়, অহংকারকে নির্মূল করার জন্য রবীন্দ্রনাথ এইসব গানে কাতর প্রার্থনা করেছেন ঈশ্বরের কাছে।
আমার মাথা নত করে
দাও হে তোমার
চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে।
নিজের করিতে গৌরব দান
নিজেরে কেবলই করি অপমান
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া
ঘুরে মরি পলে পলে।
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে।

***

রক্ষা করো হে
আমার কর্ম হইতে আমায় রক্ষা করো হে।
আপন ছায়া আতঙ্কে
মোরে করিছে কম্পিত হে,
আপন চিন্তা গ্রাসিছে আমায়—
রক্ষা করো হে।
প্রতিদিন আমি আপনি রচিয়া
জড়াই মিথ্যজালে—
ছলনাডোর হইতে মোরে
রক্ষা করো হে।
অহংকার হৃদযদ্বার
রয়েছে রোধিয়া হে—
আপনা হতে আপনায়,
মোরে রক্ষা করো হে।

***

… আমার ইচ্ছা হইতে, প্রভু,
তোমার ইচ্ছা মাঝে—
আমার স্বার্থ হইতে , প্রভু,
তব মঙ্গল কাজে
তোমার ইচ্ছা মাঝে—
অনেক হইতে একের ডোরে,
সুখদুখ হতে শান্তিক্রোড়ে—
আমা হতে নাথ
তোমাতে মোরে
নুতন জনম দাও হে।

(গানের প্রথম চরণ “ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জনম দাও হে”)

***

তোমারি ইচ্ছা হউক পূর্ণ
করুণাময় স্বামী।
তোমারি প্রেম স্মরণে রাখি,
চরণে রাখি আশা—
দাও দুঃখ, দাও তাপ,
সকলই সহিব আমি।…

***

তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার
করিয়া দিয়েছ সোজা।
আমি যত ভার জমিয়ে
তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা
এ বোঝা আমার
নামাও বন্ধু, নামাও—
ভারের বেগেতে
চলেছি কোথায়
এ যাত্রা তুমি থামাও।

***

এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে,
হবে গো এইবার।—
আমার এই মলিন অহংকার।
দিনের কাজে ধুলা লাগি
অনেক দাগে হল দাগি,
এমনি তপ্ত হয়ে আছে
সহ্য করা ভার
আমার এই মলিন অহংকার।
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-৬: ঈশ্বরলাভ ক’রে / শুদ্ধাভক্তি লাভ ক’রে সংসারে থাকা—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৩: নহবতবাড়ির ‘এতটুকু বাসা’

 

কথামৃত : পরিশিষ্ট—চ, প্রথম

পরিচ্ছেদ : শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তা সংসারে হবে না কেন? তবে কি জান, মন নিজের কাছে নাই। নিজের কাছে মন থাকলে তবে তো ভগবানকে দেবে। …মন নিজের কাছে এলে তবে সাধন ভজন হবে। …হয় নির্জনে রাতদিন তাঁর চিন্তা, নয় সাধুসঙ্গ। মন একলা থাকলে, ক্রমে শুষ্ক হয়ে যায়।

এক ভাঁড় জল যদি আলাদা রেখে দাও, ক্রমে শুকিয়ে যাবে। কিন্তু গঙ্গাজলের ভিতর যদি ঐ ভাঁড় ডুবিয়ে রাখো তাহলে শুকুবে না।”

কীভাবে ভাঁড়কে, অর্থাৎ মনকে, গঙ্গাজলের মধ্যে, অর্থাৎ ঈশ্বরভাবের মধ্যে, ডুবিয়ে রাখা যায় তারই উপায় কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত থেকে—

প্রভু, তোমা লাগি
আঁখি জাগে;
দেখা নাই পাই
পথ চাই
সেও মনে ভালো লাগে।
ধুলাতে বসিয়া দ্বারে
ভিখারী হৃদয় হা রে
তোমারি করুণা মাগে;
কৃপা নাই পাই
শুধু চাই,
সেও মনে ভালো লাগে।”…

***

ও আমার মন যখন
জাগলি না রে
তোর মনের মানুষ এল দ্বারে।..
ওরে তুই যাহারে দিলি ফাঁকি,
খুঁজে তারে পায় কি আঁখি
এখন পথে ফিরি পাবি কি রে
ঘরের বাহির করলি যারে।

***

হে মন, তাঁরে দেখো
আঁখি খুলিয়ে
যিনি আছেন সদা অন্তরে।
সবারে ছাড়ি প্রভু করো তাঁরে
দেহ মন যৌবন
রাখো তাঁর অধীনে।”

***

ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু তোমার পানে,
তোমার পানে, তোমার পানে।
যায় যেন মোর
সকল গভীর আশা
প্রভু, তোমার কানে,
তোমার কানে, তোমার কানে।
চিত্ত মম যখন যেথায় থাকে
সাড়া যেন দেয় সে তব ডাকে,
যত বাঁধা টুটে যায় যেন
প্রভু, তোমার টানে,
তোমার টানে, তোমার টানে।
বাহিরের এই ভিক্ষা ভরা থালি
এবার যেন নিঃশেষে হয় খালি
অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে
প্রভু, তোমার দানে,
তোমার দানে, তোমার দানে।
হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর,
এ জীবনে যা কিছু সুন্দর
সকলই আজ
বেজে উঠুক সুরে
প্রভু, তোমার গানে,
তোমার গানে, তোমার গানে।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৮: চোখিধানির জগৎখানি

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’

কথামৃত (১-২-৫) ”শ্রীরামকৃষ্ণ: সত্য বলছি, তোমরা সংসার করছো এতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরের দিকে মন রাখতে হবে। তা না হলে হবে না।”…

কথামৃত (১-১৮-৫) শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্যাম বসুর প্রতি) —সংসার ধর্ম; তাতে দোষ নাই। কিন্তু ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রেখে, কামনাশূন্য হয়ে কাজকর্ম করবে। এই দেখ না, যদি কার পিঠে ফোঁড়া হয়, সে কেমন সকলের সঙ্গে কথাবার্তা কয় হয়তো কাজকর্মও করে, কিন্তু যেমন ফোঁড়ার দিকে মন পড়ে থাকে, সেইরূপ।

“সংসারে নষ্ট মেয়ের মতো থাকবে। মন উপপতির দিকে, কিন্তু সে সংসারের সব কাজ করে।”…

রবীন্দ্রনাথ সংসারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মন, সব কাজের মধ্যেও সবসময়, উত্তর-মুখ কম্পাসের কাঁটার মতো, ঈশ্বরের দিকে ঘুরে আছে। একথা প্রমাণ হয় তাঁর প্রতিদিনের জীবনচর্যা অনুসরণ ও সংগীত সহ চিঠিপত্র, প্রবন্ধ ও বিবিধ রচনাবলী পড়লেই।

প্রথমে আমরা ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি কবিতা উদ্ধৃত করে, পরে রবীন্দ্র সংগীত থেকে কিছু সংগীতের মাত্র কয়েকটি করে পংক্তি উদ্ধৃত করব।
সংসারে মোরে
রাখিয়াছ যেই ঘরে
সেই ঘরে রব
সকল দুঃখ ভুলিয়া।
করুণা করিয়া
নিশিদিন নিজ করে,
রেখে দিয়ো তার
একটি দুয়ার খুলিয়া।
মোর সব কাজে
মোর সব অবসরে
সে দুয়ার রবে
তোমার প্রবেশ তরে,
সেথা হতে বায়ু
বহিবে হৃদয়-‘পরে
চরণ হইতে
তবে পদরজ তুলিয়া।
সে দুয়ার খুলি
আসিবে তুমি এ ঘরে,
আমি বাহিরিব
সে দুয়ারখানি খুলিয়া।”…
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৬: সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ বা বাবাঠাকুর

দেশের প্রথম আধুনিক চিত্রকর নিরীহের হত্যা মানতে না পেরে গৃহত্যাগী হন

এই কবিতাটির আরও দুটি সুন্দর প্রাসঙ্গিক স্তবক আছে। উৎসাহী পাঠক নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থটি খুলে দেখে নেবেন।

এ বার শত শত রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে মাত্র কয়েকটি সংগীত তুলে দেখাবার চেষ্টা করব, শ্রীরামকৃষ্ণের কথা মতো সব কাজের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের মন কিভাবে ঈশ্বরে সংলগ্ন হয়ে থাকত।
মন তুমি নাথ লবে হরে
বসে আছি সেই আশা ধরে।
নীলাকাশে ওই তারা ভাসে,
নীরব নিশীথে শশী হাসে,
দু নয়নে বারি আসে ভরে—
বসে আছি আমি
আশা ধরে।”…

***

হে সখা, মম হৃদয়ে রহো।
সংসারে, সব কাজে
ধ্যানে, জ্ঞানে হৃদয়ে রহো।
নাথ, তুমি এসো ধীরে
সুখ-দুখ-হাসি-নয়ননীরে,
লহো আমার জীবন ঘিরে—
সংসারে সব কাজে
ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে রহো।”

***

সংসার যবে মন কেড়ে লয়,
জাগে না যখন প্রাণ,
তখনো হে নাথ,
প্রনমি তোমায়
গাহি বসে তব গান।
অন্তরযামী, ক্ষম সে আমার
শূন্য মনের বৃথা উপহার—
পুষ্পবিহীন পূজা-আয়োজন,
ভক্তিবিহীন টান।”…

***

আমি সংসারে মন দিয়েছিনু,
তুমি আপনি সে মন নিয়েছ।
আমি সুখ বলে দুখ চয়েছিনু,
তুমি দুখ বলে সুখ দিয়েছ।
হৃদয় যাহার শতখানে ছিল
শত স্বার্থের সাধনে
তাহারে কেমনে
কুড়ায়ে আনিলে
বাঁধিলে ভক্তিবাঁধনে।”…

***

ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি
পরোমৎসব—রাতি
রেখেছি কনকমন্দিরে
কমলাসন পাতি।
তুমি এসো হৃদে এসো,
হৃদিবল্লভ হৃদয়েশ,
মম অশ্রুনেত্রে করো বরিষণ
করুণ হাস্যভাতি।”…

***

তোমা-হীন কাটে
দিবস হে প্রভু,
হায় তোমা-হীন মোর
স্বপন জাগরণ—
কবে আসিবে হিয়া মাঝারে।

***

আজি রাজ-আসনে তোমারে
বসাইব হৃদয় মাঝারে।
সকল কামনা সঁপিব চরণে
অভিষেক উপহারে।
তোমারে বিশ্বরাজ,
অন্তরে রাখিব
তোমার ভকতেরই এ অভিমান
ফিরিব বাহিরে সর্ব চরাচর—
তুমি চিত্ত-আগারে।”

—চলবে।
* সুসময় রায় চৌধুরী (Susamay Roy Chowdhury) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরাজি সাহিত্যে সাম্মানিক ও সাংবাদিকতায় এমএ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ: ১. শিক্ষায় জীবন গঠন ও আনন্দলাভ—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ, ২. শ্রীরামকৃষ্ণ-আলোয় সবার জীবন, ৩. শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান—প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়। প্রকাশিতব্য: ১. জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য—ঈশ্বরলাভ, ২. কে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণ?, ৩. কে তুমি বিবেকানন্দ?, ৪. জন্মানতরবাদ—ভারতীয় শাস্ত্র ও ঋষি, মহামানবেরা।

Skip to content