ভারতের দুই মহামানব—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ।
দুটি গ্রন্থই আমাদের পরমপ্রিয়। ভারতের বিবিধ ভাষায় ও সারা বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত ও লক্ষ লক্ষ পাঠকের কাছে নন্দিত ও বন্দিত। মূলত গীতবিতানেরই কিছু গান ও আরও কিছু কবিতার সংকলন ‘গীতাঞ্জলি’। যার ইংরাজি অনুবাদ ‘Song Offerings’, নোবেল পুরস্কারে ভূষিত। দুটি বই-ই আমাদের ও বিশ্বের বহুজনের কাছে ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’। কত সহস্রজনের জীবন পরিবর্তিত করে দিয়েছে এ দুটি বই। আমাদের কত দুঃখ, বেদনা ও শোকে প্রিয় বন্ধুর মতো এরা পাশে এসে দাঁড়ায়, স্বান্তনা দেয়। আবার সর্ব আনন্দ ও সৌন্দর্যের আকর ঈশ্বরের ও মুক্তির সন্ধান পাই এ দুটি গ্রন্থে।
এই প্রবন্ধগুলি রচনার মূল উদ্দেশ্য হল শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথের বহু গোঁড়া ভক্ত একজনকে বড় করার জন্য অন্যজনকে ছোট করেন এবং কোনওরকম গভীর পাঠ ও অনুশীলন ছাড়া একটা ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করার চেষ্টা করেন যে, এঁদের দু’ জনের চিন্তাধারায় আসমান জমিন ফারাক। সুতরাং আমরা যখন ওই বিশেষ ব্যক্তির ভক্ত হয়েছি তখন অন্য ব্যক্তি সম্মন্ধে জানার কোনো প্রয়োজন নেই। এই প্রবন্ধগুলি সেই ভ্রান্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে দেখাবার চেষ্টা করবে এই দুই মহামানবের চিন্তাধারার মধ্যে কত মিল! সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সমৃদ্ধ হব এই তুলনামূলক রচনা পাঠে।
যত মত, তত পথ, পর্ব-৩: আদর্শ শিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা
সংসার ঈশ্বর ছাড়া নয়—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত: ৩/১৭/৪) তবে জ্ঞানলাভের পর কেউ সংসারে থাকে। তারা ঘর-বার দুইই দেখতে পায়। জ্ঞানের আলো সংসারের ভিতর পড়ে, তাই তারা ভাল, মন্দ, নিত্য, অনিত্য —এসব সে আলোতে দেখতে পায়।
“যারা অজ্ঞান, ঈশ্বরকে মানে না, অথচ সংসারে আছে, তারা যেন মাটির ঘরের ভিতর বাস করে। ক্ষীণ আলোতে শুধু ঘরের ভিতরটি দেখতে পায়। কিন্তু যারা জ্ঞান লাভ করেছে, ঈশ্বরকে জেনেছে, তারপর সংসারে আছে, তারা যেন শার্সির ঘরের ভিতর বাস করে। ঘরের ভিতরও দেখতে পায়, ঘরের বাহিরের জিনিসও দেখতে পায়। জ্ঞানসূর্যের আলো ঘরের ভিতরে খুব প্রবেশ করে। সে ব্যক্তি ঘরের ভিতরের জিনিস খুব স্পষ্টরূপে দেখতে পায়—কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ, কোনটি নিত্য, কোনটি অনিত্য।”
ঈশ্বরে সদা শরণাগত ভক্ত রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানের আলোয় সংসারের ভিতর বাহির ভালো-মন্দ সব দেখতে পেতেন বলে তাঁর উপলব্ধি—
মধুর পবন, বিমল কিরণ, ফুল্ল বন,
কোথা হতে বহিল সহসা প্রাণভরা প্রেমহিল্লোল, আহা—
হৃদয়কুসুম উঠিল ফুটি পুলকভরে।
জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে,
সন্ধ্যায় গৃহে চলো হে আনন্দ্গানে।
সংকটে, সম্পদে থাকো কল্যাণে
থাকো আনন্দে নিন্দা-অপমানে।
সবারে ক্ষমা করি থাকো-আনন্দে
চির-অমৃত নির্ঝরে শান্তিরসপানে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত: ৪/৭/২)
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭১: ছোট মাছকে অবাঞ্ছিত না ভেবে প্রতিপালন করলে বিকল্প আয়ের দিশা পাওয়া যাবে
পরিযায়ী মন: বিদেশ ভ্রমণে বিভ্রাট
এই পৃথিবীর হাজার ভাগের একভাগ জায়গায় আশ্রমে, মঠে, মন্দিরে যত সাধু সন্ন্যাসীরা থাকে, তার থেকে আরও ন’শ নিরানব্বই গুণ সংসারীরা ন’শ নিরানব্বই গুণ বেশি জায়গায় থাকে। সেই সংসার ও সংসারীদের মধ্যে ঈশ্বর নেই, এমন ঈশ্বরে সংসারীদের কম্ম কি? আসল কথা সংসারে যে ঈশ্বর আছেন আর এই সংসার যে ঈশ্বরের, সে বিশ্বাস নেই সংসারীর।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও বশিষ্ঠদেবের মতো রবীন্দ্রনাথেরও বিশ্বাস ছিল এই সংসার ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরময়। রবীন্দ্রসংগীত—
চাহিব না হে, চাহিব না হে দূরদূরান্তর গগনে।
দেখিব তোমারে গৃহমাঝারে জননীস্নেহে,
শত সহস্র মঙ্গল বন্ধনে।
হেরিব উৎসবমাঝে, মঙ্গলকাজে,
প্রতিদিন হেরিব জীবনে।
হেরিব উজ্জ্বল বিমলমুর্তি
তব শোকে দুঃখে মরণে।
হেরিব সজনে নরনারী মুখে,
হেরিব বিজনে বিরলে হে
গভীর অন্তর আসনে।
আমার প্রাণ তোমারি দান তুমি ধন্য ধন্য হে।
পিতার বক্ষে রেখেছ মোরে, জনম দিয়েছ জননী ক্রোড়ে,
বেঁধেছ সখার প্রণয়ডোরে, তুমি ধন্য ধন্য হে।…
তুমি আমার নয়নে নয়ন রেখো অন্তরমাঝে।
হৃদয়দেবতা রয়েছ প্রাণে
মন যেন তাহা নিয়ত জানে,
পাপের চিন্তা মরে যেন দহি
দুঃসহ লাজে।…
সেই ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া।
করুণা করিয়া নিশিদিন নিজ করে
রাখিয়ো তাহার একটি দুয়ার খুলিয়া।…