বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ভারতের দুই মহামানব—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ।

ভারতের দুই মহামানব—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ। একজন নররূপী নারায়ণ, অবতাররূপে পূজিত, অন্যজন বিশ্বকবি হিসেবে বন্দিত। দু’ জনেরই অলোকসামান্য জীবন, কর্ম ও বাণী আমাদের চিন্তা ও কল্পনাকে বারবার মুগ্ধ এবং বিস্মিত করে। একজনের কথা ও বাণীর সংকলন ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ ও আরেকজনের গীত-বাণীর সংকলন—‘গীতবিতান’।

দুটি গ্রন্থই আমাদের পরমপ্রিয়। ভারতের বিবিধ ভাষায় ও সারা বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত ও লক্ষ লক্ষ পাঠকের কাছে নন্দিত ও বন্দিত। মূলত গীতবিতানেরই কিছু গান ও আরও কিছু কবিতার সংকলন ‘গীতাঞ্জলি’। যার ইংরাজি অনুবাদ ‘Song Offerings’, নোবেল পুরস্কারে ভূষিত। দুটি বই-ই আমাদের ও বিশ্বের বহুজনের কাছে ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’। কত সহস্রজনের জীবন পরিবর্তিত করে দিয়েছে এ দুটি বই। আমাদের কত দুঃখ, বেদনা ও শোকে প্রিয় বন্ধুর মতো এরা পাশে এসে দাঁড়ায়, স্বান্তনা দেয়। আবার সর্ব আনন্দ ও সৌন্দর্যের আকর ঈশ্বরের ও মুক্তির সন্ধান পাই এ দুটি গ্রন্থে।
যাঁরাই ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ নিবিষ্ট হয়ে পড়েছেন এবং তন্ময় হয়ে শুনেছেন রবীন্দ্রসংগীত, তাঁদেরই চৈতন্যে হয়তো কখনও কখনও কথামৃত পড়তে পড়তে ঝলসে উঠেছে সমার্থক কোনো রবীন্দ্রসংগীত কিংবা রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে কথামৃতের কোনো অমৃতকথা। আমরা এই প্রবন্ধমালা ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ ও রবীন্দ্রসংগীতের সংকলন ‘গীতবিতান’ থেকে এরকমই বহু সমার্থক অমৃতকথা দিয়ে সাজিয়েছি।

এই প্রবন্ধগুলি রচনার মূল উদ্দেশ্য হল শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথের বহু গোঁড়া ভক্ত একজনকে বড় করার জন্য অন্যজনকে ছোট করেন এবং কোনওরকম গভীর পাঠ ও অনুশীলন ছাড়া একটা ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করার চেষ্টা করেন যে, এঁদের দু’ জনের চিন্তাধারায় আসমান জমিন ফারাক। সুতরাং আমরা যখন ওই বিশেষ ব্যক্তির ভক্ত হয়েছি তখন অন্য ব্যক্তি সম্মন্ধে জানার কোনো প্রয়োজন নেই। এই প্রবন্ধগুলি সেই ভ্রান্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে দেখাবার চেষ্টা করবে এই দুই মহামানবের চিন্তাধারার মধ্যে কত মিল! সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সমৃদ্ধ হব এই তুলনামূলক রচনা পাঠে।
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-৩: আদর্শ শিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন

শুরু করার আগে প্রখ্যাত বিবেকানন্দ গবেষক, সাহিত্যিক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রাক্তন অধ্যাপক, প্রয়াত শঙ্করীপ্রসাদ বসুর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’-এর সপ্তম খণ্ড থেকে এই অতি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিটি চয়ন করে দিলাম—”যদি একথা সত্য হয় যে শ্রীরামকৃষ্ণের মরদেহের মধ্যে আধ্যাত্মসত্যের চরম ও পরম প্রকাশ ঘটেছিল (অবশ্যই তা ঘটেছিল), তাহলে সেই সত্য প্রকাশের আচার্য থাকবেন, এবং তার কবিও থাকবেন। বিবেকানন্দ সেই যুগাচার্য এবং সাময়িকতার ধূলিঝঞ্ঝা কেটে গেলে কাল ব্যবধানে অবস্থিত মানুষ অবশ্যই দেখবে—রামকৃষ্ণ-সত্যের মহাকবি হলেন রবীন্দ্রনাথ। আমার তাই ধারণা।” (পৃ: ৫২১-৫২২, প্রকাশক, শ্রীসুনীল মন্ডল, মন্ডল বুক হাউস, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

 

সংসার ঈশ্বর ছাড়া নয়—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত: ৩/১৭/৪) তবে জ্ঞানলাভের পর কেউ সংসারে থাকে। তারা ঘর-বার দুইই দেখতে পায়। জ্ঞানের আলো সংসারের ভিতর পড়ে, তাই তারা ভাল, মন্দ, নিত্য, অনিত্য —এসব সে আলোতে দেখতে পায়।

“যারা অজ্ঞান, ঈশ্বরকে মানে না, অথচ সংসারে আছে, তারা যেন মাটির ঘরের ভিতর বাস করে। ক্ষীণ আলোতে শুধু ঘরের ভিতরটি দেখতে পায়। কিন্তু যারা জ্ঞান লাভ করেছে, ঈশ্বরকে জেনেছে, তারপর সংসারে আছে, তারা যেন শার্সির ঘরের ভিতর বাস করে। ঘরের ভিতরও দেখতে পায়, ঘরের বাহিরের জিনিসও দেখতে পায়। জ্ঞানসূর্যের আলো ঘরের ভিতরে খুব প্রবেশ করে। সে ব্যক্তি ঘরের ভিতরের জিনিস খুব স্পষ্টরূপে দেখতে পায়—কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ, কোনটি নিত্য, কোনটি অনিত্য।”

ঈশ্বরে সদা শরণাগত ভক্ত রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানের আলোয় সংসারের ভিতর বাহির ভালো-মন্দ সব দেখতে পেতেন বলে তাঁর উপলব্ধি—

“আজি হেরি সংসার অমৃতময়
মধুর পবন, বিমল কিরণ, ফুল্ল বন,
কোথা হতে বহিল সহসা প্রাণভরা প্রেমহিল্লোল, আহা—
হৃদয়কুসুম উঠিল ফুটি পুলকভরে।

***

“সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে নির্মলপ্রাণে।
জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে,
সন্ধ্যায় গৃহে চলো হে আনন্দ্গানে।
সংকটে, সম্পদে থাকো কল্যাণে
থাকো আনন্দে নিন্দা-অপমানে।
সবারে ক্ষমা করি থাকো-আনন্দে
চির-অমৃত নির্ঝরে শান্তিরসপানে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত: ৪/৭/২)
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭১: ছোট মাছকে অবাঞ্ছিত না ভেবে প্রতিপালন করলে বিকল্প আয়ের দিশা পাওয়া যাবে

পরিযায়ী মন: বিদেশ ভ্রমণে বিভ্রাট

“যখন রামচন্দ্রের বৈরাগ্য হোলো দশরথ বড় ভাবিত হয়ে বশিষ্ঠদেবের শরণাগত হলেন— যাতে রাম সংসার ত্যাগ না করেন। বশিষ্ঠ রামচন্দ্রের কাছে গিয়ে দেখেন, তিনি বিমনা হ’য়ে বসে আছেন—অন্তরে তীব্র বৈরাগ্য। বশিষ্ঠ বল্লেন, রাম, তুমি সংসার ত্যাগ করবে কেন? সংসার কি তিনি ছাড়া? আমার সঙ্গে বিচার করো। রাম দেখলেন, সংসার সেই পরব্রহ্ম থেকে হয়েছে—তাই চুপ করে গেলেন।”

এই পৃথিবীর হাজার ভাগের একভাগ জায়গায় আশ্রমে, মঠে, মন্দিরে যত সাধু সন্ন্যাসীরা থাকে, তার থেকে আরও ন’শ নিরানব্বই গুণ সংসারীরা ন’শ নিরানব্বই গুণ বেশি জায়গায় থাকে। সেই সংসার ও সংসারীদের মধ্যে ঈশ্বর নেই, এমন ঈশ্বরে সংসারীদের কম্ম কি? আসল কথা সংসারে যে ঈশ্বর আছেন আর এই সংসার যে ঈশ্বরের, সে বিশ্বাস নেই সংসারীর।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বশিষ্ঠদেবের মতো রবীন্দ্রনাথেরও বিশ্বাস ছিল এই সংসার ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরময়। রবীন্দ্রসংগীত—

নিকটে দেখিব তোমারে বাসনা করেছি মনে।
চাহিব না হে, চাহিব না হে দূরদূরান্তর গগনে।
দেখিব তোমারে গৃহমাঝারে জননীস্নেহে,
শত সহস্র মঙ্গল বন্ধনে।
হেরিব উৎসবমাঝে, মঙ্গলকাজে,
প্রতিদিন হেরিব জীবনে।
হেরিব উজ্জ্বল বিমলমুর্তি
তব শোকে দুঃখে মরণে।
হেরিব সজনে নরনারী মুখে,
হেরিব বিজনে বিরলে হে
গভীর অন্তর আসনে।

***

তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে।
আমার প্রাণ তোমারি দান তুমি ধন্য ধন্য হে।
পিতার বক্ষে রেখেছ মোরে, জনম দিয়েছ জননী ক্রোড়ে,
বেঁধেছ সখার প্রণয়ডোরে, তুমি ধন্য ধন্য হে।…

***

আজি প্রনমি তোমারে চলিব নাথ, সংসার কাজে।
তুমি আমার নয়নে নয়ন রেখো অন্তরমাঝে।
হৃদয়দেবতা রয়েছ প্রাণে
মন যেন তাহা নিয়ত জানে,
পাপের চিন্তা মরে যেন দহি
দুঃসহ লাজে।…

***

সংসারে তুমি রাখিলে মোরে যে ঘরে
সেই ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া।
করুণা করিয়া নিশিদিন নিজ করে
রাখিয়ো তাহার একটি দুয়ার খুলিয়া।…
***
* সুসময় রায় চৌধুরী (Susamay Roy Chowdhury) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরাজি সাহিত্যে সাম্মানিক ও সাংবাদিকতায় এমএ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ: ১. শিক্ষায় জীবন গঠন ও আনন্দলাভ—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ, ২. শ্রীরামকৃষ্ণ-আলোয় সবার জীবন, ৩. শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান—প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়। প্রকাশিতব্য: ১. জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য—ঈশ্বরলাভ, ২. কে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণ?, ৩. কে তুমি বিবেকানন্দ?, ৪. জন্মানতরবাদ—ভারতীয় শাস্ত্র ও ঋষি, মহামানবেরা।

Skip to content