রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ছবি: সংগৃহীত।

শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর মাত্র সাত বছর যেতে না যেতেই স্বামীজি যখন জগৎ আচার্য হয়ে আমেরিকা তারপর ইংল্যান্ড তোলপাড় করছেন এবং পরবর্তীকালে ভারতে এসে এই অতিকায় ঘুমন্ত জলজন্তুটিকে (স্বামীজীর ভাষায় ‘Sleeping leviathon’) নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তুলছেন বক্তৃতায়, গল্পে, হাস্য পরিহাসে, কথকতায় তখন তাঁর নিশ্চয়ই শ্রীরামকৃষ্ণের কথা মনে পড়ছিল। কারণ স্বামীজি বলতেন, শিক্ষক যত বড় বিদ্বান, পণ্ডিত হোক না কেন ছাত্রকে শিক্ষা দিতে হলে তাঁকে ছাত্রের মনের সমান্তরালে নেমে আসতে হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ, যাঁর সম্মন্ধে স্বামীজি শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, “সারা জীবনপাতি সাধনা করেও বুঝতে পারলাম না শ্রীরামকৃষ্ণ কি বস্তু!”

“হায়! কেউ জানল না শ্রীরামকৃষ্ণ নাম ধরে পৃথিবীতে কে এসেছিলেন!” সেই শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষা দেবার সময় গানে, গল্পে, কৌতুকে, অভিনয়ে, কথকতায় ছেলে থেকে বুড়ো, মূর্খ থেকে পণ্ডিত সকলের সমপর্যায়ে নেমে এসে তবে শিক্ষা দিতেন। আর এমন অন্তঃসলিলা, আনন্দময় তাঁর শিক্ষা দেবার পদ্ধতি যে আপনিই তাঁর ছাত্ররা সমৃদ্ধ ও স্নাত হয়ে যেত। তাঁরা বুঝতেই পারত না কীভাবে কখন তাঁরা শিক্ষিত হয়ে উঠছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষাদান পদ্ধতির দুটি বিশেষ দিক— অধিকারিভেদ এবং প্রকৃতি বা রুচিভেদ। “কি জানো রুচিভেদ, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন, আর যার যা পেটে সয়। তিনি নানা ধর্ম নানা মত করেছেন অধিকারী বিশেষের জন্য। সকলে ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী নয়। তাই আবার তিনি সাকার পূজার ব্যবস্থা করেছেন। মা ছেলেদের জন্য বাড়িতে মাছ এনেছে। সেই মাছ ঝোল, অম্বল, ভাজা আবার পোলাও করলেন। সকলের পেটে কিন্তু পোলাও সয় না। তাই কারও কারও জন্য মাছের ঝোল করেছেন তারা পেট রোগা। আবার কারও সাধ অম্বল খায়, বা মাছ ভাজা খায়। প্রকৃতি আলাদা -আবার অধিকারিভেদ।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ৩য় খণ্ড, ৯ম অধ্যায়, ৫ম পরিচ্ছেদ)
এখানে মূলত মনুষ্য প্ৰকৃতি বা রুচিভেদের কথা বলেছেন। আবার অধিকারীভেদের কথাও বলেছেন, “সকলে ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী নয়, তাই তিনি সাকার পূজার ব্যবস্থা করেছেন।” আবার অন্যত্র শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “সবাই কি অখণ্ড সচ্চিদানন্দকে ধরতে পারে?” (ঐ, ২-৫-২)

শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের মধ্য থেকেই উদাহরণ দিয়েছেন নিরাকার ও সাকারবাদী উপাসকের। শ্রীরামকৃষ্ণ “আশ্চর্য দর্শন সব হয়েছে। অখণ্ড সচ্চিদানন্দ দর্শন। তার ভিতর দেখছি, মাঝে বেড়া দেওয়া দুই থাক। একধারে কেদার, চুনি আর আর অনেক সাকারবাদী ভক্ত।

বেড়ার আর একধারে টকটকে লাল সুরকির কাঁড়ির মতো জ্যোতি। তার মধ্যে বসে নরেন্দ্র সমাধিস্থ। “ধ্যানস্থ দেখে বললুম, ও নরেন্দ্র! একটু চোখ চাইলে বুঝলুম, ওই একরূপে সিমলেতে কায়েতের ছেলে হয়ে আছে। তখন বললাম, ‘মা, ওকে মায়ায় বদ্ধ কর। তা না হলে সমাধিস্থ হয়ে দেহত্যাগ করবে।’ কেদার সাকারবাদী, উঁকি মেরে দেখে শিউরে উঠে পালাল।” (কথামৃত: ৪-২৪-৩)

শ্রীরামকৃষ্ণের এই দর্শন ও উক্তির ভাব সম্প্রসারণের দরকার নেই। শুধু বলা যায় নরেন্দ্রনাথের আধার ও অধিকার আলাদা। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় তাঁর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের বিভিন্ন আধার সম্মন্ধে উদাহরণ দিয়েছেন, “মানুষের এক ছটাক বুদ্ধিতে ঈশ্বরের স্বরূপ কি বোঝা যায়? এক সের ঘটিতে কি চার সের দুধ ধরে?” (কথামৃত: (১-১২-৯)
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-২: গুরুমশায় শ্রীরামকৃষ্ণ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

জাত-শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার ও প্রকৃতিভেদ খুব মানতেন। তাই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে হাজার হাজার স্কুল কলেজে যখন শতাধিক বর্ষ ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু পরীক্ষায় বেশি নম্বর ও ডিগ্রী সংগ্রহের অদম্য আগ্রহ, তখন রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয় থেকে একে একে তৈরি হচ্ছে বিখ্যাত সাহিত্যিক, ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, গায়ক-গায়িকা, চিত্র-পরিচালক, বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ইত্যাদি। সব ছাত্র ছাত্রীকে এক গোয়ালের গরু বানিয়ে শিক্ষা দিলে শান্তিনিকেতন থেকে এত সৃষ্টিশীল প্রতিভাবান ছাত্র ছাত্রী তৈরি হত না।

একবার দেখেনি রবীন্দ্র-সৃষ্ট শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় থেকে তৈরি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর নাম। এখানে শুধুমাত্র কয়েকজনের নাম দেওয়া হল এবং এঁদের বিবিধ কার্যাবলী কিংবা গ্রন্থের নাম, পুরস্কার ইত্যাদির বিবরণ দেওয়া সম্ভব হল না, কারণ তাহলে প্রবন্ধের কলেবর দীর্ঘ হয়ে যাবে। সেই সব গুণী ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে কয়েকজন হলেন— ভারতের প্রাক্তন প্ৰধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক সত্যজিৎ রায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুধীরঞ্জন দাস, লেখক-গায়ক-নৃত্যশিল্পী ও অভিনেতা শান্তিদেব ঘোষ, সম্পাদক-লেখক সাগরময় ঘোষ, চিত্রকর ও গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপালমুকুল দে, প্রখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ, সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী, চিত্রশিল্পী ও লেখিকা রানী চন্দ।

এ ছাড়া কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, রাজেশ্বরী দত্ত-সহ কত যে পুরুষ ও মহিলা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১১: মশ্যা রে তুঁহু মম শ্যাম-সমান

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৬: অবশেষে চার হাত এক হল, পঞ্চম-আশা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুরু করলেন দ্বিতীয় ইনিংস

রবীন্দ্রনাথের মতো শ্রীরামকৃষ্ণও তাঁর পাঠশালা থেকে যেসব ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করেছেন তারও তুলনা নেই। স্ব স্ব ক্ষেত্রে এঁরা প্রত্যেকেই এক একজন দিকপাল। এঁদের কয়েকজনের নাম আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এঁদের সমসময়ে এবং পরে, শতাধিক বছর ধরে, শ্রীরামকৃষ্ণের বহু মানস ছাত্র ও শিষ্য, শত শত সন্ন্যাসী ও গৃহীভক্তের অকৃপণ আত্মদানের বিনিময়ে আজ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন নামে মহীরুহটি দ্বিশতাধিক শাখা বিস্তার করে দেশে-বিদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’ হয়ে উঠেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-পাঠশালা এখনও চলছে। মূলত কথামৃতকার শ্রীম, তাঁর গুরুমশায় শ্রীরামকৃষ্ণকে চিরনবীন করে ধরে রেখেছেন তাঁর তুলনাহীন গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে’। এই গ্রন্থে শ্রীম আনন্দময় শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর পাঠশালাকে সংগীতে, কথকতায়, নৃত্যে, হাস্যপরিহাসে, অভিনয়ে মহাকালের বুকে জীবন্ত করে রেখে গিয়েছেন। এই গ্রন্থের মাধ্যমে যে কোনও মানুষ যে কোনও সময় এই পাঠশালায় ভর্তি হয়ে যেতে পারেন। শত সহস্র মানুষ, শতাধিক বর্ষ ধরে এই পাঠশালায় পাঠ নিয়ে চৈতন্যময় জীবনযাপন করেছেন, করছেন ও ভবিষ্যতেও করবেন।

প্রকৃত শিক্ষকের কাছে এসে ছাত্র বা ছাত্রীর সব সংশয় ছিন্ন হয়। কেউ হয়ত অঙ্ক বা ইংরাজিতে দুর্বল। পড়ায় উৎসাহ নেই, কারণ সে পড়া বোঝে না। শিক্ষক যা বলে বা শেখায় তা তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়, মস্তিষ্কে বা হৃদয়ে প্রবেশ করে না। আদর্শ শিক্ষক কোনও বিশেষ এক বিষয়ে দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীর স্তরে নেমে এসে সরস করে বুঝিয়ে সেই বিষয়ে তাকে উৎসাহী করে তোলে। তার সব সংশয়, প্রশ্ন ছিন্ন হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

কলকাতার পথ-হেঁশেল: উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া—প্রাণের আশ-প্যান্থেরাস

শ্রীরামকৃষ্ণ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সব মানুষের কাছেই আদর্শ-শিক্ষক। যে কেউ তাঁর কাছে বিনত হয়ে প্রশ্ন করবে তাঁরই সংশয় দূর হবে। নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে এত অসংখ্যবার প্রশ্ন করে শ্রীরামকৃষ্ণের মনে সংশয় উৎপাদন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, যে পরবর্তীকালে স্বামীবিবেকানন্দ রূপে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্মন্ধে এক শ্লোকে লিখেছেন “সংশয়রাক্ষস নাশ মহাস্ত্রম”। শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের সব সংশয় রাক্ষসকে নাশ করেন। আধুনিক মন সংশয়াত্মা। সব কিছু শুনে বুঝেও প্রশ্ন করে—বুঝলাম কিন্তু? তবে? ঠিক তো? এই সংশয়ী মন কোথাও নোঙর ফেলে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারে না। তার অশান্ত মন-নৌকা অবিশ্রাম ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সংশয়-সমুদ্রে টালমাটাল হয়ে দিকবিদিক হারিয়ে তলিয়ে যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ জীবনদেবতার কাছে আকুল প্রার্থনা করেছিলেন, “সংশয়তিমির মাঝে না হেরি গতি হে। প্রেম-আলোকে প্রকাশো জগপতি হে।”

আদার্শ-শিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের সব সংশয় ছিন্ন করার জন্য অতীত-বর্তমান-অনাগতকাল জুড়ে আজও বসে আছেন। কথামৃতের এক জায়গায় তিনি সমাগত দর্শক ও শ্রোতাদের বলছেন “বল, তোমাদের যা সংশয়। আমি সব বলছি।” (কথামৃত: ১-৬-৩) আমাদের সব সংশয়, সব প্রশ্নের উত্তর আছে তার কাছে। আমরা কবে যাব? তাঁর কাছে সব সংশয় ছিন্ন করে কবে আমাদের জীবনতরী নিয়ে বাঁধব সুধাসাগর্তীরে?

অতীতে শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন কুঠিবাড়ির ছাদ থেকে ব্যাকুল হয়ে ডাকতেন, ‘ওরে তোরা কে কোথায় আছিস আয়…” তেমনি আজও তাঁর চৈতন্যবীণা প্রতিমুহূর্তে আমাদের ডেকে চলেছে তাঁর আনন্দময় পাঠশালায় যোগ দিতে। আমরা কি তাঁর ডাক শুনতে পাই? শুনতে পাই কি তাঁর পায়ের ধ্বনি?

“তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি,
ওই যে আসে, আসে, আসে।
যুগে যুগে পলে পলে দিন রজনী
সে যে আসে, আসে, আসে।
(রবীন্দ্রসংগীত)

পায়ে পায়ে এসে কানে কানে কি বলেন তিনি?
‘ওরে তোরা যারা শুনবি না,
তোদের তরে আকাশ—’পরে নিত্যবাজে কোন বীণা
দূরের শঙ্খ উঠল বেজে, পথে বাহির হল সে যে,
দুয়ারে তোর আসবে কবে তার লাগি দিন গুনবি না…”
(রবীন্দ্রসংগীত)
* সুসময় রায় চৌধুরী (Susamay Roy Chowdhury) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরাজি সাহিত্যে সাম্মানিক ও সাংবাদিকতায় এমএ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ: ১. শিক্ষায় জীবন গঠন ও আনন্দলাভ—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ, ২. শ্রীরামকৃষ্ণ-আলোয় সবার জীবন, ৩. শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান—প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়। প্রকাশিতব্য: ১. জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য—ঈশ্বরলাভ, ২. কে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণ?, ৩. কে তুমি বিবেকানন্দ?, ৪. জন্মানতরবাদ—ভারতীয় শাস্ত্র ও ঋষি, মহামানবেরা।

Skip to content