শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


প্যালিনড্রোম বলে ইংরেজি ভাষায় যে লিটারেরি মেথড আছে, তার সার্থক উদাহরণ উপরের পদদুটি।
আজ আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের এমন দু’জন নক্ষত্রকে নিয়ে আলোচনা করব যা, সারস্বত সমাজে ব্যতিক্রম পদবীভূক্ত। স্বর্গীয় দ্যুতিভরা মুখের হাসিতে দু’জন গন্ধর্বের একসঙ্গে একটা ছবিও পাওয়া যায় না। গতানুগতিকভাবে আমরা হেমন্ত-উত্তম, মান্না-উত্তম, উত্তম-শ্যামল, কিশোর-উত্তম ধীরে ধীরে হজম করেছি। কিন্তু উত্তম-রফি! কেমন যেন ওয়ান বুক অথর লাগছে।

মহম্মদ রফি এবং উত্তমকুমার দু’জনেই জুলাই-কে অভিশপ্ত তকমা দেগে দিয়েছেন, তাঁদের অকাল প্রয়াণের ধাক্কা দিয়ে। বাংলায় শ্রাবণ মাস এলে যেমন বর্ষাপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ-র কথা ভেবে, বুকের ভেতরটা মোচড় দিতে থাকে, তেমনই জুলাই মাস-এ কোনও এক হারানোর ব্যথা মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।

আমরা দু’জন গন্ধর্বের সারস্বত অস্তিত্বকে পাশাপাশি রাখার চেষ্টা করব। মাত্র দুটি চলচ্চিত্রে দু’জন কালজয়ী শিল্পীকে কাজ করতে দেখা যায়। ‘ইন্দ্রাণী’ (১৯৫৮) এবং ‘ছোটি সি মুলাকাত’ (১৯৬৭)। ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে একটি বিশেষ দৃশ্যের গভীরতা জরিপ করতে ব্যাকগ্রাউন্ডে রফি সাহেবের সেই অননুকরণীয় ডেলিভারি দর্শককে সিটের সঙ্গে আটকে রেখেছিল।

সংগীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ, কী বোঝাতে পেরেছিলেন জানি না, কিন্তু মাইক্রোফোনের সামনে সাধারণ আবেগকে শাস্ত্রীয় ঘরানার মিহি তান মিশিয়ে শব্দ দিয়ে যে ছবি আকা যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ মহম্মদ রফি সাহেব। মুম্বইতে বসে বাঙালি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ‘হারানো সুর’ ছবির শেষ দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে স্বকণ্ঠে ‘রমা রমা’ বলে ডাক জুড়ে দিয়ে সেলুলয়েডি মস্তানিকে অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তেমনই পরের বছর ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে সংযোজিত রফিয়ানা ছবিটির অলংকরণ অনেকগুন বাড়িয়ে তুলেছিল। পরের অংশ অবশ্যই ‘ছোটি সি মুলাকাত’ নামক সেই অবিস্মরণীয় মিউজিক্যাল হিট, ফিল্মি ফ্লপ ছবিকে নিয়ে। মিউজিক্যাল হিট এ অর্থে যে, শঙ্কর-জয়কিষণ-এর সুরে উত্তমকণ্ঠে রফি ম্যাজিক।

বহুশ্রুত নেপোটিজম পর্ব বাদ দিয়ে যদি ছবিটির একটি নিরপেক্ষ সমালোচনা করা যায়, তবে অনেক পরস্পর বিরোধী মনখারাপ করা তথ্য উঠে আসবে। এবং সেখানেও বিজয়ীর আসনে রফি সাহেব।
বিষয়টির ডুবুরি হলে বলতে হয়, ফিল্ম নামক শিল্পটা এমনই সংযোজনভিত্তিক যে পদে পদে সতর্ক থাকতে হয়। কুশীলবদের আঙ্গিক-বাচিক উপস্থাপন, সাজসজ্জা থেকে শুরু করে বিশ্বাসযোগ্য দৃশ্যের বয়ন সবকিছুর একটা প্যাকেজ।
উক্ত সমস্ত ধাপগুলিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় সময়োচিত সাংগীতিক বিন্যাসে। অর্থাৎ প্রচলিত কথায় যাকে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বলা হয়। চিত্রনাট্য-র দাবী মেনে হসরত জয়পুরীর লেখা গীতে শঙ্কর জয়কিষণ-এর মেলোডি প্রসব এককথায় ছিল ‘সুপার্ব’।

সংগীত পরিচালক, ফিমেল ভয়েসের জন্যে যথাক্রমে লতা, আশা ছাড়াও রতিমেদুর সুমন কল্যাণপুরকে নিয়েছিলেন, কিন্তু মেল ভয়সের জন্যে রফি সাহেবকেই বেছেছিলেন। কারণ পূর্বোক্ত তিনজন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী হলেও রফি সাহেব ছিলেন চিত্রকল্প নির্মাণের যাদুকর। ঠিক এ প্রসঙ্গেই আমরা দুজনের শিল্পীসত্তার সামান্য সালতামামি সেরে রাখব।

গত শতকের ষাটের দশক উত্তম-রফি দু’জনেরই ছিল পিক পয়েন্ট। রফি যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন তাই শব্দের সঙ্গে নাটকীয়তার মিশেল ঘটিয়ে পর্দার নায়ককে জীবন্ত করার একটা অতিরিক্ত দায় উনি স্বেচ্ছায় নিতেন।
ফলে বহু ছবি টেকনিক্যালি অপরিণত থাকলেও শুধু রফি সাহেবের গান দিয়ে ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করেছে। তৎকালীন মুবইয়ের বহু চিত্রতারকা মানুষের পছন্দের তালিকায় না থাকলেও কেবল রফির গান শুনবেন বলে হলে ভীড় জমাতেন। প্রযোজক পরিচালকগণও এ মোহিনী ব্যাবস্থা-র সুযোগে ওৎ পেতে বসে থাকতেন। গান মানুষের কানে সেট হয়ে গেলেই পোষ্টার, ফেষ্টুন এ বড় বড় হরফে রফি সাহেবের গানের লাইন লিখে প্রচার চালাতেন। কলকাতায় ঠিক যে দায়িত্বটা, উত্তমবাবু পালন করতেন।

অন্যদিকে ষাটের দশকের উত্তম, যেটাতে হাত দিয়েছেন সেটাতেই সোনা ফলিয়েছেন। অভিনয় ছাড়াও পরিচালনা, সংগীত পরিচালনা, প্রযোজনা এবং সর্বোপরি বিগ ব্যানারে হিন্দি সিনেমার নির্মাণ। শিল্পব্যসনী উত্তম বাবুর প্রস্তুতিতে কোনও খামতি ছিল না। কিন্তু ঈশ্বরেরও কাজ করার একটা সীমা আছে। যখনই প্রকৃতির বিরুদ্ধে কেউ দিনের পর দিন চলবে তখনই প্রকৃত, অন্যদিক দিয়ে সমতা বজায় রাখবে।

সমগ্ৰ ‘ছোটি সি মূলাকাৎ’ ছবিটি তে উত্তমবাবুর ক্লান্তি ফুটে উঠেছে। হিন্দি ছবির নির্মাণে যে গোলোকধাধা পেরোতে হয় সেখানে অভিজ্ঞতার অভাব নিয়ে শুধু ডেডিকেশন দিয়ে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলা যায় না। যে কথা বলার জন্য এত কথা বলছি, তা হল — সমগ্ৰ ছবিটিতে একমাত্র রফি সাহেবের গান যেখানে থাকছে সেখানেই উত্তমবাবু টেনশনলেশ হিসাবে উজাড় করে দিচ্ছেন। আসলে প্রকৃতিগত ভাবে দু’জন ভালো মানুষের যুগলবন্দী ঐশ্বরিক দ্যুতিতে ফুটে উঠেছে।

পরবর্তীকালে উত্তমবাবুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বরপর্দা যখন ভারী হতে শুরু করে তখন ছবির প্রয়োজনে শিল্পের প্রতি সততা বজায় রাখতে কিশোর কুমার সুযোগ পেলেন। রফি সাহেবকে সে অর্থে আর উত্তমবাবুর কণ্ঠে দেখা যায়নি। কারণ ‘ছোটি সি মুলাকাত’-র মতো সর্বাঙ্গসুন্দর শহুরে আভিজাত্য পূর্ণ ছবি হিন্দী ভাষায় করার সুযোগ উত্তমবাবু পাননি।

বাঙালির উত্তমমাসে অপ্রত্যাশিতভাবে রফি সাহেবের মৃত্যু কলকাতা-মুম্বইকে অদৃশ্য ভাবে যুক্ত করে দিয়েছিল। আগের শুক্রবার উত্তমের শেষযাত্রায় বর্ষাকে মাথায় রেখে যারা পথে নেমেছিলেন তারা হয়তো পরের শুক্রবার রফির শেষযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি কিন্তু মুম্বইয়ের তামাম জনতা ভেজা চোখে বাইরের বর্ষাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন রফিয়ানার কি মাধুর্য। পরোপকারী দিলদরিয়া সদা হাস্যোজ্জ্বল দুই চিরতরুণের অকালপ্রয়াণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আলোচনাবন্দী করে রাখল।

উত্তমবাবুর শেষের কয়েক বছর যেমন ডিপ্রেশনে কেটেছিল, সত্তরের দশকে কিশোর-ঝড়ে রফি সাহেবেরও একই অবস্থা গিয়েছিল। উত্তমবাবুর মতোই শুধু কিশোর-অক্ষমতায় উনি ব্যবহৃত হচ্ছিলেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু এসে দুজনকেই মুক্তির সুখ দিয়ে গেল।

ভাবখানা এমন, যেন পরোপকারী উত্তমবাবু স্বর্গে গিয়ে আর একজন দিলদরিয়া সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষের মুক্তির ব্যবস্থা করলেন। যেখানে স্বর্গের অধিবাসীরাও অস্ফুটে বলে ফেলেছিলেন, ফির রফি!

Skip to content