উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি।
রাজার সিন্দুকে টুনটুনির সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি তো সভ্যতার এক প্রাচীন ইতিহাস, কিন্তু সে কাহিনি তেমন করে আর কেই-বা বলতে পারে? পেরেছিলেন একজন। তাকে তোমরা সবাই চেনো। প্রাণীকুলকে মানবজীবনের রূপকে প্রাণদান করতে তাঁর থেকে ভালো আর কেই-বা পারত? তিনি আর কেউই নন, তিনি হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি। সুকুমার রায়ের পিতা, সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর, যাঁর গুরুত্ব বাংলাসাহিত্য ঠিকমতো অনুধাবন করার আগেই যেন একটা যুগ ভোজবাজির মতো হুশ করে শেষ হয়ে গেল। টুনটুনির জীবনের সত্যিকারের যন্ত্রণাটুকু আর সেভাবে কখনওই বুঝে ওঠা হল না আমাদের। তবে টুনটুনির স্রষ্টা সম্পর্কে আজ এমন কিছু চমকপ্রদ তথ্য তোমাদের দেব যে তোমরা একেবারে অবাক হয়ে যাবে।
উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ মে ময়মনসিংহ জেলার বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে, যা অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত। তাঁর পিতা কালীনাথ রায় ছিলেন আরবি, ফারসি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। কালীনাথকে সবাই চিনত শ্যামসুন্দর মুন্সী নামে। শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান হলেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছর বয়সের আগেই তাঁকে দত্তক নেন তাঁর পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরি এবং নামকরণ করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি। জানো কি এই উপেন্দ্রকিশোর ছেলেবেলা থেকে মেধাবী ছাত্র ও পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্য অধিক পরিচিতিলাভ করলেও ছোটবেলায় তাঁর লেখাপড়ার থেকেও বেশি আগ্রহ ছিল বাঁশি, বেহালা ও সংগীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান এবং কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। পরবর্তী জীবনে উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় একটি ছাপাখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাপাখানা গড়ে ওঠার পেছনে কিন্তু একটি গল্প আছে।
১৮৮৫ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে তাঁর প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি সমাজের প্রতিটি স্তরেই যথেষ্ট প্রশংসা ও সম্মান অর্জন করলেও লেখকের নিজস্ব একটি অভিযোগের জায়গা তৈরি হয়েছিল বইটির মুদ্রণের মানগত দিকটি নিয়ে। ভবিষ্যতে যাতে আর কখনও এই সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয় তার জন্য তিনি সেই বছরই বিদেশ থেকে সেই সময়কার আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন, এবং ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে এই ছাপাখানাটির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীনই উপেন্দ্রকিশোর অঙ্কনচর্চা করতে আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’এরই একটি কামরায় তিনি নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন এবং সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। ১৯১১ সালে তিনি বড়ছেলে সুকুমারকে বিলাতে পাঠান ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য। কলেজজীবনের শুরুতেই তিনি ব্রাহ্মসমাজের সদস্যপদ গ্রহণ করায় অনেক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর ১৮৮৬ সালে ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়। সেই সময়কার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর ও বিধুমুখীর সংসারজীবন আরম্ভ হয়। তাঁদের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুবিমল, এবং সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা। ভবিষ্যৎজীবনে এঁরা প্রত্যেকেই শিশুসাহিত্যে নিজের মৌলিকতা ও অনন্যতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মধ্যে জ্যেষ্ঠা কন্যা সুখলতা রায় ও জ্যেষ্ঠপুত্র সুকুমার রায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যজীবন আরম্ভ হয় ছাত্রাবস্থা থেকেই। ১৮৮৩ সালে সখা, সাথী, মুকুল ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। উপেন্দ্রকিশোরের প্রথমদিকের প্রকাশিত লেখাগুলি ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ, পরে তাঁর কাছ থেকে আমরা প্রভূত চিত্র অলংকরণযুক্ত গল্প উপহার পেয়েছি।
১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি পরলোকগমন করেন। একটা যুগের অবসান ঘটে যায় তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে৷ কিন্তু বাঙালি পাঠককুল আজও তাঁকে বুঝে উঠতে পারল না সেভাবে। আমরা আশা করব তোমরা নিশ্চয়ই একদিন তাঁর গুরুত্ব আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবে এবং সেদিন নিশ্চিতভাবেই বাংলাসাহিত্যের এক অনাবিষ্কৃত অভিনবত্ব বাঙালির মানসপটে উদ্ভাসিত হবে।
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ মে ময়মনসিংহ জেলার বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে, যা অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত। তাঁর পিতা কালীনাথ রায় ছিলেন আরবি, ফারসি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। কালীনাথকে সবাই চিনত শ্যামসুন্দর মুন্সী নামে। শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান হলেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছর বয়সের আগেই তাঁকে দত্তক নেন তাঁর পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরি এবং নামকরণ করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি। জানো কি এই উপেন্দ্রকিশোর ছেলেবেলা থেকে মেধাবী ছাত্র ও পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্য অধিক পরিচিতিলাভ করলেও ছোটবেলায় তাঁর লেখাপড়ার থেকেও বেশি আগ্রহ ছিল বাঁশি, বেহালা ও সংগীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান এবং কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। পরবর্তী জীবনে উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় একটি ছাপাখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাপাখানা গড়ে ওঠার পেছনে কিন্তু একটি গল্প আছে।
১৮৮৫ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে তাঁর প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি সমাজের প্রতিটি স্তরেই যথেষ্ট প্রশংসা ও সম্মান অর্জন করলেও লেখকের নিজস্ব একটি অভিযোগের জায়গা তৈরি হয়েছিল বইটির মুদ্রণের মানগত দিকটি নিয়ে। ভবিষ্যতে যাতে আর কখনও এই সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয় তার জন্য তিনি সেই বছরই বিদেশ থেকে সেই সময়কার আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন, এবং ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে এই ছাপাখানাটির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীনই উপেন্দ্রকিশোর অঙ্কনচর্চা করতে আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’এরই একটি কামরায় তিনি নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন এবং সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। ১৯১১ সালে তিনি বড়ছেলে সুকুমারকে বিলাতে পাঠান ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য। কলেজজীবনের শুরুতেই তিনি ব্রাহ্মসমাজের সদস্যপদ গ্রহণ করায় অনেক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর ১৮৮৬ সালে ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়। সেই সময়কার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর ও বিধুমুখীর সংসারজীবন আরম্ভ হয়। তাঁদের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুবিমল, এবং সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা। ভবিষ্যৎজীবনে এঁরা প্রত্যেকেই শিশুসাহিত্যে নিজের মৌলিকতা ও অনন্যতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মধ্যে জ্যেষ্ঠা কন্যা সুখলতা রায় ও জ্যেষ্ঠপুত্র সুকুমার রায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যজীবন আরম্ভ হয় ছাত্রাবস্থা থেকেই। ১৮৮৩ সালে সখা, সাথী, মুকুল ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। উপেন্দ্রকিশোরের প্রথমদিকের প্রকাশিত লেখাগুলি ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ, পরে তাঁর কাছ থেকে আমরা প্রভূত চিত্র অলংকরণযুক্ত গল্প উপহার পেয়েছি।
১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি পরলোকগমন করেন। একটা যুগের অবসান ঘটে যায় তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে৷ কিন্তু বাঙালি পাঠককুল আজও তাঁকে বুঝে উঠতে পারল না সেভাবে। আমরা আশা করব তোমরা নিশ্চয়ই একদিন তাঁর গুরুত্ব আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবে এবং সেদিন নিশ্চিতভাবেই বাংলাসাহিত্যের এক অনাবিষ্কৃত অভিনবত্ব বাঙালির মানসপটে উদ্ভাসিত হবে।
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে