শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের কথা ভেবেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ সব বাঙালিই শৈশবে পড়েছে। যারা গলায় টাই ঝুলিয়ে, দুলিয়ে সাহেব স্কুলে যায়, তাদের কথা আলাদা। তারা ‘বর্ণপরিচয়’-এর গোপালকেও চেনে না, রাখালকেও চেনে না। এই না-চেনাদের এখন বাড়-বাড়ন্ত। শহর-শহরতলিতেই মুখ্যত এমন। দেশটা তো অনেক বড়, বিপুল বঙ্গভাষী। মফসসলে, গ্রামে, প্রত্যন্ত গ্রামে অবিশ্যি এখনও আধো-উচ্চারণে ‘বর্ণপরিচয়’-ই পঠিত হয়। বইপাড়ায় আজও সব থেকে বিক্রি হয় এ বইটি। বলা যায়, চিরকালের ‘বেস্টসেলার’।

সেই ‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রথম ভাগ লেখা হয়েছিল পালকিতে বসে, এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে যাওয়ার পথে। হুম-না-না পালকি ছুটেছে। বেহারাদের ছোটার তালে তালে কণ্ঠ থেকে বেরুচ্ছে বিচিত্র শব্দ। পালকির ভেতরে যিনি রয়েছেন, তাঁর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। পালকির দুলদুলুনির মধ্যেই লিখে চলেছেন! ভাবতেও কেমন যেন বিস্ময় লাগে, বিদ্যাসাগর এ ভাবেই ‘বর্ণপরিচয়’ লিখেছিলেন!

কেউ পড়তো পাঠশালায়, কেউ টোলে বা মক্তবে। এক সময় বইপত্তর তেমন ছিল না। কী পড়ানো হবে—ঠিকঠাক সে-ধারণাই তখনও তৈরি হয়নি। যেন অন্ধের হস্তিদর্শন! হাতড়ে হাতড়ে, আন্দাজে আন্দাজে যেটুকু শেখানো হতো, তা যথেষ্ট ছিল না।
এ সব ইংরেজ সরকারকেও ভাবিয়েছে। সবে তারা তখন এদেশের শাসন দায়িত্বে জাঁকিয়ে বসেছেন। সমস্যাকে জিইয়ে না রেখে উদ্যোগী হয়েছেন নিরসনে। এ নিয়ে রীতিমতো ব্রিটেনের পার্লামেন্টে মিটিং বসেছে। শিক্ষা-বিষয়ক কমিটি তৈরি হয়েছে। রেভারেন্ড মে চুঁচড়োতে স্কুল খুলেছেন। মে-সাহেবের সে স্কুলে পিলপিলিয়ে ছাত্র এসেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্রসংখ্যা আটশোয় পৌঁছেছে। শহরে, শহরতলিতে নতুন নতুন স্কুল চালু হয়েছে। কোনও স্কুলেই পড়ুয়ার অভাব হয়নি। পড়ুয়াদের কলতানে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠেছে।

স্কুল আছে, ছাত্র আছে, অথচ উপযুক্ত বই নেই। ছোটরা প্রাণের আনন্দে স্কুলে আসছে, অভিভাবকরা অনেক আশা নিয়ে পাঠাচ্ছেন, অথচ নতুন পড়ুয়াদের প্রথম-পাঠের উপযোগী তেমন কোনও বই নেই। স্কুলে এসে তারা পড়বে কী, করবে কী— এই বাস্তব-সমস্তা অনেককেই ভাবিয়েছে।

এই সমস্যা-সংকট কাটানোর জন্য গড়ে উঠেছে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’। ঠিক হয়, সোসাইটির উদ্যোগে বই লেখানো হবে, সে-বই সুলভে পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। নব্য পড়ুয়াদের প্রথম-পাঠের বই-লেখার দায়িত্ব কোনও বঙ্গসন্তানকে দেওয়া হয়নি। ক্যালকাটা বুক সোসাইটির প্রথম বই ‘লিপিধারা’ লিখেছিলেন জেমস স্টুয়ার্ট। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮১৮তে। পর পর লেখা হয়েছে আরও কয়েকটি বই। রাধাকান্ত দেব লিখেছেন ‘বাঙলা শিক্ষাগ্রন্থ’। এ বইতে বাংলা বর্ণমালা যেমন ছিল, তেমনই ছিল ব্যাকরণ-ইতিহাস-ভূগোলের প্রথম-পাঠ। ঈশ্বরচন্দ্র বসু লিখেছেন, ‘শব্দসার’ নামে একটি বর্ণমালা শেখার বই। রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ দু’খণ্ডে লিখেছেন ‘শিশুসেবধি’। আরেকটি বই সেকালে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, বিশ্বনাথ তর্কবাগীশের ‘শিশুবোধক’। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ প্রকাশের আগে ‘শিশুবোধক’-ই প্রথম-পড়ুয়াদের হাতে হাতে ঘুরতো। ‘শিশুশিক্ষা’ প্রকাশের পর এই জনপ্রিয়তায় চিড় ধরে, দিনে দিনে ফিকে হয়ে যায়। এক সময় একেবারে তলানিতে পৌঁছয়। তেমনই হয়েছিল ‘শিশুশিক্ষা’র ক্ষেত্রে। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশের পর মদনমোহনের বইটির অবস্থাও হয়েছিল এ-রকম। দ্রুত হারিয়েছিল জনপ্রিয়তা।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

বিদ্যাসাগর তখন ছিলেন স্কুল-পরিদর্শকের দায়িত্বে, ফলে কাছে দূরের নানা স্কুলে যাওয়া, খোঁজখবর নেওয়া ছিল তাঁর দৈনন্দিন কাজ। ‘বর্ণপরিচয়’ লেখার আগে বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ বা ‘শকুন্তলা’-র মতো বই লিখেছিলেন। কোনওটিই মৌলিক নয়, প্রথমটির আদি উৎস রয়েছে হিন্দিতে, পরেরটি সংস্কৃতে। হোক না অনুবাদ, বিন্দুমাত্র আড়ষ্ঠতা নেই, মৌলিকতায় উজ্জ্বল।

এ ধরণের সাবালকপাঠ্য লেখায় অভ্যস্ত বিদ্যাসাগর কেন খুব ছোটদের জন্য বর্ণ চেনানোর, বানান শেখানোর বই লিখলেন, সে-প্রশ্ন তো মনে জাগে। জাগাই স্বাভাবিক!

বিদ্যাসাগরের অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। দু’বন্ধুতে পড়তেন সংস্কৃত কলেজে। তাঁদের মধ্যে ছিল সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। শুধু সহপাঠী নন, পরে সহমর্মী সহকর্মীও হয়ে উঠেছিলেন। দু’জনেই পড়াতেন সংস্কৃত কলেজে। পরে পড়িয়েছেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। সে-চাকরি তাঁকে বিদ্যাসাগরই করে দিয়েছিলেন।

পরস্পরের অনাবিল বন্ধুত্বে হঠাৎ করেই চিড় ধরে। বিদ্যাসাগরের মতো মদনমোহনও চেয়েছিলেন মেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। দুই বন্ধুই তাঁদের এ কাজে পাশে পেয়েছিলেন বেথুনসাহেবকে। বেথুনসাহেবের ক্যালকাটা ফিমেল স্কুলে তাঁরা দু’জনেই পড়াতেন।
বেথুনসাহেব স্কুল খুললেন বটে, প্রথমদিকে ছাত্রী পাওয়া প্রায় দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। সে-সময় মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে, স্কুলে যাবে— এ সব ছিল অভাবনীয়। মদনমোহন সবার আগে নিজের দুই মেয়ে ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে এই স্কুলে ভরতি করে দিয়েছিলেন। স্কুলে পড়াতে গিয়ে ‘শিশুশিক্ষা’ লেখার কথা তাঁর মাথায় আসে। দ্রুত লিখেও ফেলেন তিনটি খণ্ড। বেথুনসাহেবের স্কুলের পড়ুয়াদের কথা ভেবে লেখা হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে ‘শিশুশিক্ষা’ হয়ে উঠেছিল বর্ণ চেনানোর, ভাষা শেখানোর অপরিহার্য প্রথম-পাঠ। রবীন্দ্রনাথও শৈশবে মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’ পড়েছেন। ‘শিশুশিক্ষা’-র জনপ্রিয়তা স্থায়ী হয়নি। দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। শেষে বইবাজার থেকেই অবলুপ্ত হয়েছে।

বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বন্ধুত্বে চিড় ধরার পর মদনমোহন মুর্শিদাবাদে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। একসঙ্গে সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা, গলায় গলা মিলিয়ে বলেছিলেন মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর যৌক্তিকতা, দুই বন্ধুতে ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এত মিলমিশ, একসঙ্গে পথ-হাঁটা— সবই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

মদনমোহন সংস্কৃত কলেজের চাকরি ছেড়েছিলেন ১৯৫০-এর নভেম্বরে। কলকাতা-ত্যাগের আগের বছর বেরিয়েছিল ‘শিশুশিক্ষা’-র প্রথম ভাগ। ১৯৫০-এ প্রকাশিত হয় পরের দু’টি খণ্ড। ‘শিশুশিক্ষা’ প্রকাশের বছর ছয়েক পর, ১৮৫৫ তে প্রকাশিত হয় বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রথম ভাগ, পরের বছর বেরিয়েছিল দ্বিতীয় ভাগ।

মদনমোহন দীর্ঘজীবী হননি। ‘বর্ণপরিচয়’-এর দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশের দু’বছর পর, ১৮৫৮তে প্রয়াত হন। কলকাতার বাইরে বসবাস করে, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মহাদায়িত্ব সামলে মদনমোহন সেভাবে ‘শিশুশিক্ষা’ বিপণনে মনোনিবেশ করতে পারেননি। বইয়ের উপস্থাপনে, রচনাশৈলীতে যে খামতি ছিল, তাও পরবর্তী সংস্করণে পূরণ করতে পারেননি। ফলে ‘বর্ণপরিচয়’-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এঁটে ওঠেনি ‘শিশুশিক্ষা’। অচিরেই অদৃশ্য হয়েছে।

‘শিশুশিক্ষা’ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেও প্রথম ভাগে গ্রন্থিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের এই কবিতাটি আজকের ছোটরাও পড়ে, পড়তে পড়তে প্রভাতের শব্দ-ছবি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ‘পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল। / কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।।’

বন্ধুত্বে চিড় ধরেছিল বলেই ‘শিশুশিক্ষা’-র একটি পাল্টা বই লিখেছিলেন, শিক্ষাবিভাগের সঙ্গে সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ‘শিশুশিক্ষা’-র জনপ্রিয়তা ম্লান করতে তৎপর হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, এমনতরো সরলীকরণের কোনও মানে হয় না। ‘শিশুশিক্ষা’-র আগে শিশুকে বর্ণ চেনানো ও পড়তে শেখানোর কথা ভেবে বাংলা ভাষায় কম বই লেখা হয়নি। এইসব বইয়ের মধ্যে গুণগত মান বিচারে ‘শিশুশিক্ষা’ অনেক এগিয়েছিল। ফলে সমকালে প্রাপ্য স্বীকৃতিও পেয়েছিল। ‘বর্ণপরিচয়’কে বলা হয় ‘প্রথম বিজ্ঞানসম্মত প্রাইমার’। এটাই ‘বর্ণপরিচয়’-এর সাফল্যের চাবিকাঠি। প্রকাশের বছর পনেরো পর ‘বর্ণপরিচয়’-এর মুদ্রণ সংখ্যা আড়াইলাখে পৌঁছেছিল।

সরকারি মহাদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরকে স্কুল-পরিদর্শনে যেতে হতো। পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথাও হতো। কথা বলতে গিয়ে তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ‘শিশুশিক্ষা’-র অসম্পূর্ণতা কোথায়!
বিদ্যাসাগরের পরম বন্ধু ছিলেন প্যারীচরণ সরকার। তাঁর বাড়িতে প্রায়ই বিদ্যাসাগার আসতেন, আসতেন আরও কত বিদগ্ধ বন্ধুজন! তেমনই এক বন্ধু-মজলিশে ঠিক হয়, প্যারীচরণ শিশু-শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি বই লিখবেন, বিদ্যাসাগর লিখবেন বাংলায়। যেমন কথা, তেমন কাজ। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেই বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয়’ লিখেছিলেন। বাংলায় বিদ্যাসাগরের প্রামাণ্য জীবনীরচনা করেছিলেন চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিহারীলাল সরকার। ইংরেজিতে লিখেছিলেন সুবলচন্দ্র মিত্র। তিন জীবনীতেই আছে এক তথ্য, জীবনীকাররা জানিয়েছেন কীভাবে ‘বর্ণপরিচয়’ রচিত হয়েছিল! চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘প্যারীবাবুর সদর বাটীর বৈঠকখানা ঘরে সর্ব্বদাই বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রভৃতির সমাগমে মজলিস হইত। একদিনকার ঐরূপ মজলিসে বঙ্গদেশীয় বালক বালিকাগণের শিক্ষা লাভের সদুপায় সম্বন্ধে কথাবার্ত্তা উঠে। সেদিনকার বৈঠকের কথাবার্ত্তায় স্থির হয় যে প্যারীচরণ সরকার মহাশয় ইংরাজী বর্ণমালা হইতে আরম্ভ করিয়া বালকদিগের প্রথম পাঠ্য কতকগুলি ইংরাজী পুস্তক রচনা করিবেন; আর বিদ্যাসাগর মহাশয় বাঙ্গালা বর্ণমালা হইতে আরম্ভ করিয়া বালকদিগের উপযোগী কতকগুলি বাঙ্গালা পুস্তক রচনা করিবেন।’
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৭: আমি শুধুই উদাস, জলজ্যান্ত লাশ

শিশুদের কথা ভেবে পরিকল্পিত বই প্যারীচরণ সরকার লিখেছিলেন আগে, বিদ্যাসাগর পরে। প্যারীচরণের ‘ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিব চিলড্রেন’-এর প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৯৫০-এ, দ্বিতীয় ভাগ বেরিয়েছিল পরের বছর। দু’টি বই-ই শৈশবে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পুরো নামে নয়, ‘ফার্স্ট বুক’ নামে অধিক পরিচিত বইটি সমকালে যে বিপুল সমাদর পেয়েছিল, পরে আর তা বজায় থাকেনি। ‘বর্ণপরিচয়’-এর সমাদর অবশ্য দিনে দিনে বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে। বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম বই ‘বর্ণপরিচয়’। পালকিতে বসে লিখে ফেললেও মনে মনে প্রস্তুতি দীর্ঘকাল ধরেই চলছিল। প্যারীচরণের বাড়িতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত করতে বিদ্যাসাগরের বছর ছয়েক তো লেগেইছিল। আকস্মিক মনের খেয়ালে লেখা নয়, রয়েছে দীর্ঘ রচনা-প্রস্তুত। সেকারণেই ‘বর্ণপরিচয়’-এর এই সাফল্য। হয়ে উঠেছে শৈশবের সঙ্গী। অপরিহার্যতা নিয়ে কেউ ভিন্নতর মত পোষণ করেন না।

‘বর্ণপরিচয়-এর সঙ্গে শৈশবে আমাদের যে পরিচয়, তা মনের কোণে রয়ে যায়। ‘বর্ণপরিচয়’-এর টুকরো টুকরো শব্দ, গোপাল-রাখাল-ভুবনরা মনের অলিতে গলিতে জীবনভর ঘোরাফেরা করে। মা-বাপ মরা ভুবন মাসির কাছে প্রতিপালিত। মাসি স্নেহের বশে তার অন্যায়কেও প্রশ্রয় দিয়েছে। সহপাঠীর বই চুরি করে এনেছিল ভুবন। ভুবনের মাসি ভুলেও তাকে কিছু বলেনি। একদিন সে সত্যিই বড়সড় চোর হয়ে ওঠে। বামাল-সহ ধরা পড়ে। শেষে তার ফাঁসির হুকুম হয়। ভুবন আকূল হয়ে বলে, ‘এ জন্মের মত, এক বার আমার মাসীর সঙ্গে দেখা করাও।’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সে-ব্যবস্থা হয়ে যায়। ভুবনের মাসিকে আনা হয়। ‘বর্ণপরিচয়’-এর পাতা থেকে একটু তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘ভুবনের মাসী ঐ স্থানে আনীত হইলেন এবং ভুবনকে দেখিয়া, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে, তাহার নিকট গেলেন। ভুবন কহিল, মাসি! এখন আর কাঁদিলে কি হইবে। নিকটে এস, কানে কানে তোমায় একটি কথা বলিব। মাসী নিকটে গেলে পর, ভুবন তাঁহার কানের নিকট মুখ লইয়া গেল এবং জোরে কামড়াইয়া, দাঁত দিয়া তাঁহার একটী কান কাটিয়া লইল। পরে ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, ‘মাসি। তুমিই আমার ফাঁসির কারণ। যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে সময়ে যদি তুমি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে আমার এ দশা ঘটিত না। তাহা কর নাই, এজন্য তোমার এই পুরস্কার হইল।’

এ সব কি ভোলা যায়! গল্প তো নয়, টুকরো অনুচ্ছেদ, সেই অনুচ্ছেদেও কত না শিক্ষা! ভালো-মন্দ কী অনায়াসেই না চিনিয়ে দিয়েছেন বিদ্যাসাগর! এ সব চলার পথের পাথেয় হয়ে ওঠে।

‘বর্ণপরিচয়’ পড়তে পড়তে ছোটরা সমাজ চেনে, পরিবেশ চেনে। ইঁদুর, ঈগল, উট, কোকিল, খরগোস, গরু, ঘোড়া, ছাগল, টিয়া, হরিণ— এমন কত না পশুপাখির সঙ্গে পরিচয় হয়! শব্দ চেনা, বাক্যের গঠন ও বিন্যাস জানা হয়ে যায়।

‘বর্ণপরিচয়’-এ চির-চেনা বর্ণমালা-র পরিবর্তন ঘটিয়েছেন বিদ্যাসাগর। অপ্রয়োজনীয় বর্ণ বর্জন করেছেন, যে বর্ণের স্থান যেখানে হওয়া উচিত, সেখানেই রেখেছেন বিদ্যাসাগর। বর্ণমালার অবস্থান ও ব্যবহার নিয়ে তাঁর আগে কেউ এমন যুক্তিনিষ্ঠভাবে ভাবেননি। বর্ণের বিন্যাস নিয়েই ভাবেননি বিদ্যাসাগর, বাক্যের গঠন নিয়েও ভেবেছেন। অনুচ্ছেদগুলিতে পাঠাভ্যাস তৈরিই শুধু করেননি, ছোটদের মধ্যে শুভবোধ জাগিয়ে তুলতেও চেয়েছেন। প্রথম ভাগে সুশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা আছে, দ্বিতীয়ভাগে তা আরও জোরালো, স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পিতা-মাতার অবাধ্য না-হওয়া, মিথ্যে কথা না বলা, পরের দ্রব্য না-বলে নেওয়ার মধ্যে আর যাই থাক বাহাদুরি নেই। বিদ্যাসাগর শিশুর চারিত্রিক বিকাশ চেয়েছিলেন, সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষাই দেয় ‘বর্ণপরিচয়’।

বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ পড়তে পড়তে ছোট্ট শিশুটি বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে ফেলুক। বাংলার ঘরে ঘরে ‘সুবোধ বালক’ হোক, বিদ্যাসাগরের জন্মদিবসে এইটুকুই চাওয়া। এর বেশি কিছু আমাদের চাওয়ার নেই।

Skip to content