বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ ও সৌম্যেন্দ্রনাথ, মস্কোতে।

ঠাকুরবাড়িতে সাহেবসুবোরা অনেকে নিয়মিত আসতেন। রবীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের কারও কারও সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সখ্যের বন্ধন সূচিত হয়েছিল। ব্যবসায়িক স্বার্থেই দ্বারকানাথ সাহেবসুবোদের সঙ্গে মিশতেন। ছিল অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক।

সাহেবদের সঙ্গে যতই মেলামেশা থাকুক না কেন, ঠাকুরবাড়িতে সাহেবিয়ানা কখনও স্পর্শ করেনি। বাংলাভাষার চর্চায় নিবেদিত প্রাণ এই পরিবারটিতে বাঙালিয়ানা ষোলোআনাই ছিল। কখনও এই বাঙালিয়ানায় ঘাটতি পড়েনি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র সৌম্যেন্দ্রনাথের আত্মজীবনী ‘যাত্রী’ বইতে আছে, ‘মহর্যি দেবেন্দ্রনাথের আমল থেকেই আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে কখনও নকলনবিশী সাহেবিয়ানা ঢুকতে পারেনি। কলকাতার সমাজের উপরের তলায় শিক্ষিত পুরুষ ও মেয়েদের মধ্যে তখন সাহেবিয়ানা আর বিবিয়ানা ঢঙের জোয়ার বইছে। বাংলা ভাষায় কথা বলা, চিঠি লেখা, বাঙালি বেশভূষা তখন এদের কাছে অচল ছিল।’
পরিস্থিতি কি পাল্টেছে? একেবারই নয়, অপরিবর্তিত বলা যায়। এখনও প্রায় একই রকম আমাদের মানসিকতা। আমাদের রাজ্যে বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতি ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। সৌম্যেন্দ্রনাথ যে সময়ের কথা লিখেছেন, সে সময়ও সুখকর ছিল না। সেই অন্ধকারে আলোকবর্তিকা জ্বেলে রেখেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। সৌম্যেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের এই আত্মমর্যাদাহীন কলুষের ঢেউ আমাদের জোড়াসাঁকো বাড়ির ফটক পার হতে পারেনি।’

সুধীন্দ্রনাথের পুত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ ছিলেন নানা গুণে গুণান্বিত। অসাধারণ ছিল তাঁর গানের গলা। তখন বছর পাঁচেক বয়েস। রোজ সকালে ঘুম ভাঙার পর খাটে বসে, মা চারুবালার সঙ্গে গান ধরতেন, গাইতেন ব্রহ্মসংগীত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই পৌত্রটিকে খুবই পছন্দ করতেন। ছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথের গানের ‘ভক্ত’। বালক-বয়সে সৌম্যেন্দ্রনাথের গান শুনে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘প্রকৃতপক্ষে শ্রীমানের আশ্চর্য শক্তি সকলকেই বিমুগ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৫: শেকল-বাঁধা ঠাকুরবাড়ির খাতা

আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস: তোমার ভাষা বোঝার আশা

সৌম্যেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীতে আছে, ‘আমার বয়স তখন পাঁচ বৎসর হবে, মনে পড়ে বাড়ির উঠোন ভরে গেছে লোকে, আমার দাদা দিনেন্দ্রনাথ মাথায় গেরুয়া পাগড়ি গায়ে আলখাল্লা, আমাকে তাঁর কাঁধে বসিয়ে তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গান ধরেছেন, সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি …।’

এই বোধ, দেশের প্রতি ভালোবাসা জোড়াসাঁকোয় সযত্নে লালিত হয়েছে। নানাভাবে, বিভিন্ন ঘটনাক্রমে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সৌম্যেন্দ্রনাথকে বড় ভালোবাসতেন। নামকরণও করেছিলেন তাঁর। মহর্যিদেব-প্রসঙ্গে তিনি আত্মজীবনীতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি আপাতভাবে ‘সামান্য’ মনে হতে পারে। এমন বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে বা নানা সূত্রে অবগত হয়ে পরিবারের সদস্যদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর আনুগত্য গড়ে উঠেছিল। সৌম্যেন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এক আত্মীয় তাঁকে একবার চিঠি লিখেছিলেন ইংরেজিতে। সে চিঠি মহর্ষিদের গ্রহণ করেননি। তখনই ফেরত পাঠিয়েছিলেন। যিনি চিঠিটি লিখেছিলেন, প্রেরিত পত্র এভাবে ফেরত পেয়ে প্রথমে হতবাক হয়েছিল, পরে ফেরতের কারণ জানতে পারার পর খুবই যে লজ্জিত হয়েছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!

মা চারুবালার কোলে শিশু সৌম্যেন্দ্রনাথ।

ঠাকুরবাড়িতে এমন দৃষ্টান্ত অনেকানেক ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। সৌম্যেন্দ্রনাথ এমনতরো একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটির মধ্য দিয়ে ঠাকুরবাড়ির আবহাওয়া আরও বেশি করে আলোকিত হয়ে ওঠে। সৌম্যেন্দ্রনাথ সে-সময় ছোট, বয়েস ছ’-সাত বছরের বেশি নয়। তিনি তাঁর কাকা কৃতীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন ময়দানে। ফেরার পর এমন এক ঘটনা ঘটে, যা সুদূর প্রসারিত অর্থবহ।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৬: সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল হকিকত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

কৃতীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকেশী দেবীর বিবাহ হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মহামারী জাঁকিয়ে বসে। ইনফ্লুয়েঞ্জা মড়কের চেহারা নিয়েছিল। সেই ইনফ্লুয়েঞ্জাতে সুকেশী দেবী মারা গিয়েছিলেন। স্ত্রী বিয়োগের চার মাসের মধ্যেই পুনরায় তিনি বিবাহ করেছিলেন। দ্বিতীয় পত্নী সবিতা দেবীকে নিয়ে নতুন সংসার অবশ্য সুখের হয়ে ওঠেনি। অচিরেই কৃতীন্দ্রনাথ উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ক্রমে সে রোগ বৃদ্ধি পায়। তাঁকে সারাক্ষণ পাহারা দেওয়ার জন্য দারোয়ানের ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল। সেই কৃতীন্দ্রনাথের সঙ্গে বালক সৌম্যেন্দ্রনাথ ময়দানে ঘুরে-বেড়িয়ে আনন্দিত চিত্তে বাড়ি ফিরছিলেন। আগেভাগে কোনও পরিকল্পনা ছিল না। আকস্মিকই ভাইপোটিকে ফেরার পথে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন সেকালের নামজাদা ‘হোয়াইটওয়ে লেডস কোম্পানি’র একটি আউটলেটে। কৃতীন্দ্রনাথ দোকানে গিয়ে সৌম্যেন্দ্রনাথের জন্য কিনে ফেলেছিলেন খাসসাহেবি পোশাক-আশাক। কোট, প্যান্ট, কলারটাই— কিছুই আর বাকি থাকেনি। সে সব ভাইপোটিকে পরিয়ে, একেবারে সাহেব সাজিয়ে কৃতীন্দ্রনাথ বাড়ির পথ ধরেছিলেন।

সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সৌম্যেন্দ্রনাথের তখন চোখে মুখে দীপ্তি, আনন্দের রোশনাই। খুশি তাঁর আর ধরে না। বাড়িতে ঢুকেই ছুটলেন পিতার কাছে, সাহেব-সাজ দেখাতে। পিতা সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্য ঘরানার মানুষ। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘সাধনা’ পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। নিজেকে আড়ালে রাখা এই মানুষটি সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। সুধীন্দ্রনাথের ঘরে পৌঁছে সৌম্যেন্দ্রনাথ যে খুব প্রশংসা পেয়েছিলেন, তারিফ করেছিলেন পিতৃদেব, তা নয়। বরং তিরস্কৃত হয়েছিলেন। নিজের হাতে পুত্রের গলা থেকে টাই খুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘কখনো এ-সব পরবে না।’

কেন পিতৃদেবের এই কঠোরতা, সাহেব-সাজের বিরোধিতা, তা বালক-বয়েসে বুঝতে পারেননি। সৌম্যেন্দ্রনাথ খুব কান্নাকাটি করেছিলেন। পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, ‘সেই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ সাহেব সাজা।’
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

ঠাকুরবাড়িতে স্বদেশি যুগে রকমারি দেশি জিনিস তৈরি হয়েছে। সে-সব জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁদের ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ তৈরি করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। বাড়িতে বিলিতি কাঁচের অনেক বাসন ছিল। অকাতরে সেসবও ভেঙে ফেলা হয়েছিল। দেশি নুন থেকে কাপড়-চোপড় সবই ঠাকুরবাড়িতে সানন্দে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশের প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য থেকে বিলিতি জিনিসপত্র বর্জন, না, এসব নিয়ে পরিবারের কারও মনে দ্বিধা ছিল না। পরিবারজীবনে জেগে ওঠা দেশের প্রতি এই ভালোবাসা সমাজজীবনেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সৌম্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বাড়ির আলো-বাতাসে আমার জীবন অত্যন্ত সহজভাবে দেশকে ভালোবাসতে শিখেছিল। যখনই খবরের কাগজে খবর বের হতো যে কোথাও বোমা পড়েছে, মনটা খুশি হয়ে উঠত।… ইংরেজ দেখলেই মনটা বিষিয়ে উঠত।’

বৃদ্ধ-বয়সে সৌম্যেন্দ্রনাথ।

কিশোর-বয়েসে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে চৌরঙ্গী যাওয়ার পথে এক ইংরেজকে ইচ্ছে করেই ধাক্কা মেরেছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ। এমন অনেক ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা বেড়েছিল, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। সৌমেন্দ্রনাথের শুধু এমন মনে হয়নি, জোড়াসাঁকোর সকলেই এ-রকম ভাবতেন। ইংরেজের প্রতি তাঁদের ক্ষোভ-বিদ্বেষ, যা পরিবারজীবনে দিনে দিনে ঘনীভূত হয়েছিল, তা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সক্রিয়ও হয়েছিলেন। জোড়াসাঁকোয় সাহেবিয়ানা কখনও প্রশ্রয় পায়নি, বরং সাহেবিয়ানা তিরস্কৃত হয়েছে। প্রাধান্য পেয়েছে বাঙালিয়ানা। ঠাকুরবাড়ি নানা ক্ষেত্রেই পথ দেখিয়েছে। এক্ষেত্রেও দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content