শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ভাষা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান।

ভাষার প্রতি এমন ঔদার্য বা ঔদাসীন্য বাঙালি ছাড়া আর কোনও জাতির বোধহয় নেই। রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমারের যুগ পেরিয়ে বাংলা এখন এমন এক স্তরে নেমে এসেছে যেখানে কোনও ভিন ভাষার শব্দকে নাম-গোত্র-পিতৃপরিচয় না জেনে ঝুলিতে ভরে নিতে অসুবিধা নেই। অথবা ভাষা যদিও বা ‘সেলফি’কে ‘নিজস্বী’ বলে, বাঙালি তবু গর্বিত স্বাভাবিকতায় ‘সেলফি’ই তুলবে, কেদারার চেয়ে অনেক আরাম করে বসে পড়বে চেয়ারে।

রমেশচন্দ্র দত্তের এক লেখায় পড়েছিলাম—উনি প্রতি বছর দশমীতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিমা গুনতেন। যদি দেখতেন গতবারের তুলনায় এ বার সংখ্যায় কিছু কম হল, তবে যারপরনাই আনন্দিত হতেন। এই যদি হয় শিক্ষিত বাঙালির সংস্কৃতি প্রেমের নিদর্শন, তাহলে ভাষার প্রতি তার প্রযত্ন সহজেই অনুমেয়।
ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কবিতাটা মনে পড়ে, ইংরাজি মাধ্যমে পড়া ছাত্রের গর্বিত মায়ের জবানীতে “আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না”—বাংলা না আসুক তাতে যত না ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি ‘বাংলা না আসাকে’ গর্বের, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির সোপান করে তোলায়।

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। একটা ভাষার জন্য আন্দোলন, তাও কাগজে কলমে কাদা- ছোঁড়াছুড়ি নয়, পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো, ভাষার জন্য শহিদ হওয়া। এত আবেগের উৎস কোথায়? হোক না তা বিশ্বের সুমধুরতম ভাষা, হোক না রবীন্দ্রনাথের ভাষা, কিন্তু তাই বলে প্রাণ দেওয়া! আবদুস সালাম, রফিকুদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকতের মনটাকে মাঝে মাঝে ফেলতে ইচ্ছে করে ইলেকট্রন, অনুবীক্ষণের নীচে—কোনও প্রকোষ্ঠে কতটা মাতৃপ্রেম থাকলে এতখানি আত্মবলিদান সম্ভব?
আরও পড়ুন:

শিক্ষক দিবস আসলে ভাবার দিন, ভাবতে শেখানোর দিন

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৬: সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল হকিকত

কিন্তু ইতিহাসের পাতা অনেকগুলো বছর অতিক্রম করে এসেছে, অনেক ওঠা পড়াকে সামনে দেখেছে বাঙালি, অনেক প্রলোভন সম্মোহনের পরে কেউ ধরেছেন বাংলাকে আরও নিবিড় করে, কেউ বা ছেড়েছেন গভীরভাবে। ধরা ছাড়ার এই খেলার মজার উপাদান হল তাঁরা, যাঁরা সচেতন ভাবে ধরতেও পারেননি, আবার ছাড়তেও চাননি পুরোপুরি। মোটকথা ভাষাটাও যে গভীর মনযোগ দিয়ে চিন্তা করার একটা উপাদান, বলাটাও যে সামান্য মনঃসংযোগ প্রার্থনা করে, এটাই তাদের কখনও মনে হয়নি। এই মনে না হওয়াকেও দোষারোপ করা না, মাঝে মাঝে এটাকেই সহজ মনে হয়। বাংলা বলতেই হবে ভেবে কারও সঙ্গে কথা শুরু করা যায় না—যদি কথার ফাঁকে চলেই আসে খিচুড়ি একটা ভাষা, বৃষ্টির দিনের শীতলতায় তার উষ্ণতাকেও তো নস্যাৎ করে দিতে পারি না।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

ভাষা নিয়ে একটি আলোচনাসভার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বক্তা বলছেন— দেশের সাধারণ মানুষ, চাষা-ভুষো-মাঝি-মাল্লারা কোন ভাষায় কথা বলছেন তা দেখে কোনও ভাষার গ্রহণযোগ্যতা বিচার করা যায় না। কারণ, তাঁদের কাছে সুক্তো আর বিরিয়ানির মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং দেশের শিক্ষিত জনগণ যে ভাষায় কথা বলছেন, যে ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন, লিখছেন তা কি সত্যি সত্যি বাংলা? তাঁদের কাছে সুক্তো ছেড়ে বিরিয়ানি খাওয়ার সুযোগ আছে। কোনও পাঁচতারা হোটেলের বেয়ারাকে দিয়ে সহজে বাংলা বলানো যাবে না, যতই আপনি বাংলায় বলে যান তাঁর সঙ্গে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী

বিচিত্রের বৈচিত্র, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস: তোমার ভাষা বোঝার আশা

মাতৃভাষা দিবস হয়তো সানন্দে পালিত হয়ে যাবে, “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানে পাড়ার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। কিন্তু তাতে কার কী এসে যায়? সেই তো বাইশ তারিখ সকালে হোয়াটস্অ্যাপ ওপেন করে ‘Good Morning’ লিখে পাঠাব ‘broadcast’ এ। ফকিরা কিংবা রূপম ইসলাম ছেড়ে টেলর সুইফটের গানে মেতে উঠব। এই মেতে ওঠাকে দোষ দিই না, সেই ভাষা অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্য সংগীত তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বাংলা যদি সেই উচ্চতায় পৌঁছতে না পারে, তবে তাকে তুলে ধরার দায়িত্ব বর্তায় আমাদেরই উপরে। রবীন্দ্র-সত্যজিৎ তো চিরকাল থাকবেন না সশরীরে, কিন্তু তাঁদের সদম্ভ বাঙালিয়ানা থেকে যাক আমাদের মানসিকতায়। তুখোড় ইংরাজি বলার জন্য যে বাংলাকে দুমড়ে-মুচড়ে আধা ইংরাজি করতে হয় না, এ কথাটা আমাদের বোঝা উচিত, লাগানো উচিত দেনন্দিন কথোপকথনের কাজে।

Skip to content