ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
জীবনানন্দ পথ হাঁটছেন। মধ্যরাত্রির কাছাকাছি। কলকাতা নির্বাক।
এই কিছুক্ষণ আগেই একদল তরুণ তরুণী পার হয়ে গেল সেই পথ। হাতে মোবাইল। চোখ স্ক্রিনে। দৃষ্টি চঞ্চল, চিন্তিত। জেব্রা ক্রসিং, একটা বেপরোয়া বাস আর একঝাঁক বাইক উড়ে গেল পথ দিয়ে।
এই কিছুক্ষণ আগেই একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছে। স্যোশাল মিডিয়াতে আকস্মিক লোডশেডিং হয়ে গিয়েছে। কেমন লাগছে আপনার? কেমন লাগছিল আপনার?
বেশ ভালো। খুব ভালো। আর না ফিরলেই বাঁচা যেত। অথবা, শ্বাসকষ্ট, একটা চাপা আর্তনাদ বুকের কাছে পাক খাচ্ছিল। অথবা, ফিরে এসেছিল আদিম গুহাজীবনের শান্তি আর স্বস্তি, টিভি দেখছিলাম।
সত্যিই তো, কুড়ি বছর আগে এ সবের বালাই ছিল না। মন এককেন্দ্রিক ছিল। মানুষ তখনও মাল্টিটাস্কার হয়তো ছিল। কিন্তু সদর থেকে অন্দরমহলে, হাত থেকে মগজের গভীরে, সময়ে অসময়ে এ ভাবে একটাই কিছু অদ্বিতীয় হয়ে গেড়ে বসেনি।
এই কিছুক্ষণ আগেই একদল তরুণ তরুণী পার হয়ে গেল সেই পথ। হাতে মোবাইল। চোখ স্ক্রিনে। দৃষ্টি চঞ্চল, চিন্তিত। জেব্রা ক্রসিং, একটা বেপরোয়া বাস আর একঝাঁক বাইক উড়ে গেল পথ দিয়ে।
এই কিছুক্ষণ আগেই একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছে। স্যোশাল মিডিয়াতে আকস্মিক লোডশেডিং হয়ে গিয়েছে। কেমন লাগছে আপনার? কেমন লাগছিল আপনার?
বেশ ভালো। খুব ভালো। আর না ফিরলেই বাঁচা যেত। অথবা, শ্বাসকষ্ট, একটা চাপা আর্তনাদ বুকের কাছে পাক খাচ্ছিল। অথবা, ফিরে এসেছিল আদিম গুহাজীবনের শান্তি আর স্বস্তি, টিভি দেখছিলাম।
সত্যিই তো, কুড়ি বছর আগে এ সবের বালাই ছিল না। মন এককেন্দ্রিক ছিল। মানুষ তখনও মাল্টিটাস্কার হয়তো ছিল। কিন্তু সদর থেকে অন্দরমহলে, হাত থেকে মগজের গভীরে, সময়ে অসময়ে এ ভাবে একটাই কিছু অদ্বিতীয় হয়ে গেড়ে বসেনি।
মোবাইল মানে হল একটি ফোন, ফোন জিনিসটি মানুষে মানুষে কথা বলতে সাহায্য করে। অথবা, লিখেও বার্তা আদান প্রদান করা যায়। কিন্তু এটাই সব নয়, বলতে গেলে কিছুই নয়। আপনার ফোনে একটি নেট কানেকশন থাকতে হবে। তাতে আপনি সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে নানা তথ্য খুঁজে নেবেন। এতো খুবই ভালো। তবে এটাও তেমন কিছু নয়। কেজো দরকারি ব্যাপার। আপনাকে থাকতে হবে সমাজমাধ্যমে। বলা ভালো, সামাজিক গণমাধ্যমে। সেটা হল সব পেয়েছির দেশ। অথবা, পেয়েও বারে বারে হারানোর একটা মঞ্চ।
এর যুক্তি-বুদ্ধিতে শাণ দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অ্যালগোরিদম ইত্যাদি প্রভৃতি নানা কৃত্কৌশল। এর ওপর ভর করেই আপনার আমার নাচ গান, আত্মপ্রচার, আত্মানুসন্ধান আর যোগাযোগের বাড়া-কমা। পৃথিবীটা ছোট হয়ে এখন হাতের মুঠোয়। বিশ্ব-সাথে যোগের মায়ামুকুর কিংবা লীলাকমল নিয়ে জনগন ধ্যানী বুদ্ধের আত্মমগ্নতায় ছুটে চলেছে, বসে আছে, ঘাড় নাড়ছে, হাসছে, খেলছে… আর হেঁটে চলেছে, ঠিক যেমনটা জীবনানন্দ হাঁটতেন, সিংহল সমুদ্র পেরিয়ে বিদিশা-শ্রাবস্তীর অন্দর কন্দর পার হয়ে নিশীথের অনন্ত অন্ধকারের দিকে।
এর যুক্তি-বুদ্ধিতে শাণ দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অ্যালগোরিদম ইত্যাদি প্রভৃতি নানা কৃত্কৌশল। এর ওপর ভর করেই আপনার আমার নাচ গান, আত্মপ্রচার, আত্মানুসন্ধান আর যোগাযোগের বাড়া-কমা। পৃথিবীটা ছোট হয়ে এখন হাতের মুঠোয়। বিশ্ব-সাথে যোগের মায়ামুকুর কিংবা লীলাকমল নিয়ে জনগন ধ্যানী বুদ্ধের আত্মমগ্নতায় ছুটে চলেছে, বসে আছে, ঘাড় নাড়ছে, হাসছে, খেলছে… আর হেঁটে চলেছে, ঠিক যেমনটা জীবনানন্দ হাঁটতেন, সিংহল সমুদ্র পেরিয়ে বিদিশা-শ্রাবস্তীর অন্দর কন্দর পার হয়ে নিশীথের অনন্ত অন্ধকারের দিকে।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৩: লিপ ইয়ার
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য
মোবাইল মানেই “সব গেল গেল” বলে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপের একটা প্রো ভার্সন লিখে ফেলা যায় পরীক্ষার হলে। কিন্তু লক ডাউন-উত্তীর্ণ অনলাইন পৃথিবী খানিক থমকাবে বৈকি! ভালো তো কিছু আছেই নৈলে…
সেটার থেকেও বড় কথা হল, ক্ষুধার্তের মুখ থেকে খাবার কিংবা নেশাগ্রস্তের নেশার বস্তুটি কেড়ে নিলে, ক্ষণিকের জন্য হলেও, কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে? দর্শন একটি উদাহরণে বলে, মাথায় আগুন লাগা জীব সর্বদাই জলের দিকে ছুটে যাবে। এ তার স্বাভাবিক প্রবণতা। কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলে কী হতে পারে? এসবই হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীজুড়ে খানিক আগেই।
একটি বহুবিদিত সমাজমাধ্যম সকলের বুকের স্পন্দন থামিয়ে হৃদয় উদ্বেল করে মুখ ঢেকেছিল। কেন? কী জন্য? এরকম হবেই কেন? এজন্যই বলেছিলাম বেশি পড়িস না ওই বই, গোল্লায় গেল, জালি কেস, দুনম্বরি ইত্যাদির বিপুল স্রোতে ভাসা সুকুমারমতি আট থেকে আশি থমকে গিয়েছিল তো! মনে পড়তে পারে তো, লোডশেডিং হলে কেমন একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব হতো, ইলেকট্রিক অফিস বলতো, এই তো হয়ে গেল, আমরা চেষ্টা করছি গাইজ!
সেটার থেকেও বড় কথা হল, ক্ষুধার্তের মুখ থেকে খাবার কিংবা নেশাগ্রস্তের নেশার বস্তুটি কেড়ে নিলে, ক্ষণিকের জন্য হলেও, কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে? দর্শন একটি উদাহরণে বলে, মাথায় আগুন লাগা জীব সর্বদাই জলের দিকে ছুটে যাবে। এ তার স্বাভাবিক প্রবণতা। কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলে কী হতে পারে? এসবই হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীজুড়ে খানিক আগেই।
একটি বহুবিদিত সমাজমাধ্যম সকলের বুকের স্পন্দন থামিয়ে হৃদয় উদ্বেল করে মুখ ঢেকেছিল। কেন? কী জন্য? এরকম হবেই কেন? এজন্যই বলেছিলাম বেশি পড়িস না ওই বই, গোল্লায় গেল, জালি কেস, দুনম্বরি ইত্যাদির বিপুল স্রোতে ভাসা সুকুমারমতি আট থেকে আশি থমকে গিয়েছিল তো! মনে পড়তে পারে তো, লোডশেডিং হলে কেমন একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব হতো, ইলেকট্রিক অফিস বলতো, এই তো হয়ে গেল, আমরা চেষ্টা করছি গাইজ!
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৯: বিপরীত পরিস্থিতিতে পালিয়ে যাওয়াটাও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে টিকে থাকার উপায়
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন
লোডশেডিং হলে পড়াশোনা থেমে যেতো, হাওয়া একটু বেশি বইতো, অনেকেই চাইতো আলো না আসুক, কিন্তু আলো ক্রমে আসিতো, না চাহিলেও আসিতো।
না চাইলেও, কিংবা বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইলেও “সে” এসে গিয়েছে আবার।
আমরা লোডশেডিং জানি, লকডাউন জানি, কিন্তু ফেসডাউন? তাও জানি বৈকি!!
সমাজের কাছে মাথা নত হয়ে গেল বুঝি, কিংবা সমাজের মাথাটাই… কিন্তু কার কাছে কে জানে! পুরো সমাজটাই তো কোন এক অন্ধযুগের ব্ল্যাকহোলে ঢুকে গিয়েছিল হঠাৎ করেই!
না চাইলেও, কিংবা বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইলেও “সে” এসে গিয়েছে আবার।
আমরা লোডশেডিং জানি, লকডাউন জানি, কিন্তু ফেসডাউন? তাও জানি বৈকি!!
সমাজের কাছে মাথা নত হয়ে গেল বুঝি, কিংবা সমাজের মাথাটাই… কিন্তু কার কাছে কে জানে! পুরো সমাজটাই তো কোন এক অন্ধযুগের ব্ল্যাকহোলে ঢুকে গিয়েছিল হঠাৎ করেই!
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৪: শোভনাসুন্দরী—ঠাকুরবাড়ির এক সরস্বতী!
কী করছিলেন এই সময়? কেন? গুহাযুগের মানুষ কী করতো? যেবার শ্রীকৃষ্ণ মথুরা ছাড়েন, যেবার অজাতশত্রুর নিদারুণ আঘাতে স্তুপপাদমূলে লুটিয়ে পড়ল শ্রীমতী, যেবার ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ হল, ধর্মসঙ্গীতি হল, পুরু রুখে দাঁড়ালেন আলেকজাণ্ডারের বিরুদ্ধে, কিংবা ফ্রান্সে অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লব ঘটল, ভারতবর্ষে মহাবিদ্রোহ, বাংলায় পলাশীর যুদ্ধ কী বঙ্গভঙ্গ রদ হল স্টেটাস পড়েছিল কিছু ওয়ালে ওয়ালে? বেঁচে থাকার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছিল কিছু? সব পেয়েছির দেশ আর বুদবুদের স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হলে ক্ষতি কি? অথবা এপার ওপারের মাঝে ওই সেতুটুকু থাকলেও? পোস্ট, শেয়ার, ভিউয়ের জগৎ যদি বিলকুল মুছে যায়, যদি সদর্থক কিছু রেখে যায় ক্ষতি কি? যদি আপনি সেই আনন্দযজ্ঞে থাকেন, জীবনের সেই মিছে কলরবেও ক্ষতি কার? কারও কাছে “হট”, কারও কাছে “কুল” থাকাটাই জীবন, কেউ বলবেন, “যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে সে কথা আজি যেন বলা যায়”….
জীবনানন্দ থামলেন। জীবনের নানা লেন-বাইলেন থেমে যায়, বিচিত্র রাগে বসন্ত নিকুঞ্জে আসে, আরও নিবিড় অন্ধকারে “মুখোমুখি বসিবার” সময় হয়।
জীবনানন্দ থামলেন। জীবনের নানা লেন-বাইলেন থেমে যায়, বিচিত্র রাগে বসন্ত নিকুঞ্জে আসে, আরও নিবিড় অন্ধকারে “মুখোমুখি বসিবার” সময় হয়।
* লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।