নিজের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ যত গান রেকর্ড করেছিলেন, তার তালিকা দেখলে বোঝা যায়, সেইসব গানের অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত। ফলে, যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা রেকর্ডে শুনেছি, তার বাইরেও রয়েছেন আরেক রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কণ্ঠমাধুর্য ধরা রয়েছে কেবল স্মৃতির পাতায়। নানা সময়ের গায়ক রবীন্দ্রনাথের নানান ছবি ফুটে উঠেছে নানান মানুষের স্মৃতিকথায়। তেমনই কয়েকটি স্মৃতিকথার মালা ‘গায়ক রবীন্দ্রনাথ’।
রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথেরই গান কম বেশি আমরা অনেকেই শুনেছি। কখনও হয়তো অবাক হয়েছি, কখনও আবার মুগ্ধ হয়েছি। তবে যাঁরা কেবল রেকর্ডে নয়, সামনাসামনি তাঁর গান শুনেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই ধরা যাক! ‘ঘরোয়া’-য় তিনি লিখেছেন, “আমরা তখন ছোট ছোট ছেলে। এক-একদিন বেড়াতে যেতুম ফরাশডাঙার বাগানে যেমন ছেলেরা যায় বুড়োদের সঙ্গে। সেই একদিনের কথা বলছি। তখন মাসটা কি মনে পড়ছে না, খুব সম্ভব বৈশাখ। আমের সময়। বসে আছি বাগানে। খুব আম-টাম খাওয়া হল। রীতিমত পেটের সেবা করে তারপর গান। জ্যোতিকাকামশায় বললেন, ‘রবি গান গাও।’ গান হলেই রবির গান হবে। আমি তখন সাত-আট বছরের ছেলে, রবিকাকার দশ বছরের ছোট। ওঁর তখন সতেরো বছর। সেই গানটা হল–‘ভরা বাদর মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর।’ গঙ্গার ধারে জ্যোতিকাকামশায় হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, প্রথম সেই গান শুনলুম, সে-সুর এখনো কানে লেগে রয়েছে। কী চমৎকার লাগলো। …বাল্যকালে যখন সুরবোধ হয় নি, তখন সেই গান শুনে ভালো লেগেছিল। ‘ভরা বাদর’ গাইবার সঙ্গে সঙ্গে সুরের বর্ষার সঙ্গে সত্যিকারের বর্ষা নামল। সেদিন আর ফিরবে না। তাঁর পর গানের পর গান শুনেছি, সেই প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত ওঁর কত গানই শুনেছি। যৌবনের পাখি চলে গেছে, আর-এক পাখি এসেছে। তিনি লিখেছেন–আমি চলে যাব, নতুন পাখি আসবে। কিন্তু নতুন পাখি আর আসবে না!”
বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গান শোনার চির উজ্জ্বল মুহূর্তের কথা ‘পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ’-এ লিখেছেন অমল হোম। কেমন সেই স্মৃতি? ফিরে দেখা যাক! “…মনে পড়ছে সেই যেদিন প্রথম রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে তাঁর গান শুনেছিলুম। সেদিন ছিল তাঁর পিতৃদেব মহর্ষির জন্মদিন। তখন প্রতি বৎসর সেই বিশেষ দিনটি তাঁর পুত্র-কন্যারা তাঁদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উৎসব সমারোহে পালন করতেন। …জ্যেষ্ঠ দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর দুই কনিষ্ঠ সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে দু-পাশে নিয়ে বসেছেন আচার্যের আসনে। আর গায়কদের মধ্যে অর্গানে বসেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। উপাসনা শেষে উপবিষ্ট রবীন্দ্রনাথ দাঁড়ালেন গিয়ে অর্গানের কাছে। গান ধরলেন, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।’ …যিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, তাঁর সে-কন্ঠের গান শুনেছেন, তাঁরাই শুধু মনে করতে পারবেন তাঁর সেদিনের রূপমূর্তি, তাঁর সেকালের গানের কথা। …মনে হল, দিব্য জ্যোতির্ময় পুরুষের সে-গান প্রাঙ্গণশীর্ষে বিস্তৃত চন্দ্রাতপের বাধা ভেদ করে কোথা যে উধাও হল ঊর্ধ্ব আকাশে। …”
অনেকেই জানেন, রবীন্দ্রনাথ নিজের গানের সুর নিজেই ভুলে যেতেন। অনেক সময় সম্পূর্ণ নতুন সুরেও পুরনো গান গেয়ে ফেলতেন। তেমন অভিজ্ঞতার কথাই লিপিবদ্ধ করেছেন শান্তিময়ী দত্ত তাঁর ‘মহিলাদের স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ’-এ। রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই আসতেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। তিনি এলে বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে সংগীত ও সাহিত্যের আসর বসত। শান্তিময়ী দত্ত লিখেছেন, “এমনই একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ গাইলেন ‘আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে।’ তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল, গাওয়ার সময় সর্বদাই আশেপাশের গায়ক-গায়িকাদের নিজের সঙ্গে গাইতে বলতেন ও গানটি শিখে নিতে বলতেন। ঐ গানটি সেদিন রবীন্দ্রনাথ এমন একটি সুরে গাইলেন যে শান্তা-সীতা অবাক হয়ে নিঃশব্দে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। গান শেষ করে কবি বললেন, ‘কি রে, তোরা চুপ করে রইলি কেন? আমার সঙ্গে গাইতে পারলি না?’ সীতাদেবী বললেন, ‘কি করে গাইব? আপনি যে সম্পূর্ণ নতুন সুরে গাইলেন। এ সুর তো আমাদের জানা নেই!’ কবি হেসে বললেন, ‘তাই নাকি? তোরা কি সুর শিখেছিস শোনা দেখি।’ তারা অন্য সুরে গানটি গেয়ে শোনানোর পর তিনি বললেন, ‘তা হবে। আমারই হয়তো ভুল হয়েছে…’।”
গায়ক রবীন্দ্রনাথের আর-এক রূপও প্রণিধানযোগ্য। ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’-এ প্রমথনাথ বিশী-র কলমে আমরা সেই রূপ দেখতে পাই– “তখন আশ্রমের গ্রীষ্মাবকাশ প্রায় শেষের দিকে, আকাশ নূতন বর্ষার মেঘে ঘন নীল, কিছু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, তখনো গাছের পাতা হইতে জল ঝরিতেছে। … আমি আমবাগানের মধ্য দিয়া কোথাও যাইতেছিলাম। হঠাৎ দেখিলাম রবীন্দ্রনাথ সবেগে আসিতেছেন; এতই ত্বরা যে পথ দিয়া চলিবার সময় নাই বলিয়াই মাঠ ভাঙিয়া চলিয়াছেন, …অদূরে দাঁড়াইয়া শুনিলাম গুনগুন করিয়া গানের দু’টি পদ আবৃত্তি করিতেছেন– ‘ভ্রমর যেথায় হয় বিবাগী নিভৃত নীল পদ্ম লাগি।’ ব্যাপার কী বুঝিতে বিলম্ব হইল না। এই গানটি তখনি রচনা করিয়া সুর দিয়াছেন; ভুলিয়া যাইবার আগেই গানটি দিনেন্দ্রনাথকে শিখাইয়া দিবার জন্য ছুটিয়া চলিয়াছেন। …তাঁহার এমন মত্ত ভাব আর কখনো দেখি নাই। উদাসীন দৃষ্টি সেই নিভৃত নীল পদ্মের দিকে বদ্ধ, দেহটা অভ্যেসের বশে ছুটিয়া চলিয়াছে। সব মিলিয়া সে যেন এক আবির্ভাব!”
ক্লারা বাট্ তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ অফ সঙ’-এ গায়ক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “একদিনের কথা মনে পড়ছে। তিনি যখন আমার গানের ভূয়সী প্রশংসা করলেন, মুগ্ধতার আবেশে, তাঁকে জানালাম, ‘আপনাকেও শুনতে বড় সাধ হয়৷’ নানা বাহানায় প্রাথমিকভাবে তিনি তাঁর কণ্ঠমাধুর্যের কথা অস্বীকার করলেও পরিশেষে বললেন, ‘আপনার সুরের সঙ্গী হয়ে আমি অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছি। তাই, আপনি যখন ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, আমি অবশ্যই গাইব। তাঁর সামনে সেদিন কেবল আমি একাই ছিলাম। কোনও যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই তিনি তাঁর নিজের দু-তিনটি গান শোনালেন। …তাঁর কণ্ঠস্বর কিছুটা অপ্রশিক্ষিত মনে হলেও তাঁর গানের মতন প্রাণঢালা স্নিগ্ধ উপস্থাপনা আমি তার আগে তেমন শুনিনি।”
নিঃসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ গানকে আঁকড়ে ধরেছেন বারে বারে। কেমন ছিল সেই আঁকড়ে ধরা? ‘প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ’-এ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ লিখেছেন, “…মন যখন ক্লিষ্ট তখন কোনও কোনও সময় নিজের মনে গান করতেন। …কোনও পারিবারিক ব্যাপারে কবির মন অত্যন্ত পীড়িত। কবি তখন থাকেন ছোট একটা নতুন বাড়িতে। শুধু দু’খানা ছোট ঘর। খাওয়ার পরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এখানেই থাকবে।’ লেখবার টেবিল সরিয়ে আমার শোবার জায়গা হল। পাশেই কবির ঘর। মাঝে একটা দরজা, পর্দা টাঙানো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে শুনতে পেলুম গান করছেন ‘অন্ধজনে দেহো আলো…’। বারবার ফিরে ফিরে চলল, সারা রাত ধরে। ফিরে ফিরে সেই কথা, ‘অন্ধজনে দেহো আলো…’। … সকালে মন্দিরের পরে বললুম, ‘কাল তো আপনি সারা রাত ঘুমোননি।’ একটু হেসে বললেন, ‘মন বড়ো পীড়িত ছিল তাই গান করছিলুম। ভোরের দিকে মন আকাশের মতোই প্রসন্ন হয়ে গেল…’।”
রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথেরই গান কম বেশি আমরা অনেকেই শুনেছি। কখনও হয়তো অবাক হয়েছি, কখনও আবার মুগ্ধ হয়েছি। তবে যাঁরা কেবল রেকর্ডে নয়, সামনাসামনি তাঁর গান শুনেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই ধরা যাক! ‘ঘরোয়া’-য় তিনি লিখেছেন, “আমরা তখন ছোট ছোট ছেলে। এক-একদিন বেড়াতে যেতুম ফরাশডাঙার বাগানে যেমন ছেলেরা যায় বুড়োদের সঙ্গে। সেই একদিনের কথা বলছি। তখন মাসটা কি মনে পড়ছে না, খুব সম্ভব বৈশাখ। আমের সময়। বসে আছি বাগানে। খুব আম-টাম খাওয়া হল। রীতিমত পেটের সেবা করে তারপর গান। জ্যোতিকাকামশায় বললেন, ‘রবি গান গাও।’ গান হলেই রবির গান হবে। আমি তখন সাত-আট বছরের ছেলে, রবিকাকার দশ বছরের ছোট। ওঁর তখন সতেরো বছর। সেই গানটা হল–‘ভরা বাদর মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর।’ গঙ্গার ধারে জ্যোতিকাকামশায় হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, প্রথম সেই গান শুনলুম, সে-সুর এখনো কানে লেগে রয়েছে। কী চমৎকার লাগলো। …বাল্যকালে যখন সুরবোধ হয় নি, তখন সেই গান শুনে ভালো লেগেছিল। ‘ভরা বাদর’ গাইবার সঙ্গে সঙ্গে সুরের বর্ষার সঙ্গে সত্যিকারের বর্ষা নামল। সেদিন আর ফিরবে না। তাঁর পর গানের পর গান শুনেছি, সেই প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত ওঁর কত গানই শুনেছি। যৌবনের পাখি চলে গেছে, আর-এক পাখি এসেছে। তিনি লিখেছেন–আমি চলে যাব, নতুন পাখি আসবে। কিন্তু নতুন পাখি আর আসবে না!”
বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গান শোনার চির উজ্জ্বল মুহূর্তের কথা ‘পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ’-এ লিখেছেন অমল হোম। কেমন সেই স্মৃতি? ফিরে দেখা যাক! “…মনে পড়ছে সেই যেদিন প্রথম রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে তাঁর গান শুনেছিলুম। সেদিন ছিল তাঁর পিতৃদেব মহর্ষির জন্মদিন। তখন প্রতি বৎসর সেই বিশেষ দিনটি তাঁর পুত্র-কন্যারা তাঁদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উৎসব সমারোহে পালন করতেন। …জ্যেষ্ঠ দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর দুই কনিষ্ঠ সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে দু-পাশে নিয়ে বসেছেন আচার্যের আসনে। আর গায়কদের মধ্যে অর্গানে বসেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। উপাসনা শেষে উপবিষ্ট রবীন্দ্রনাথ দাঁড়ালেন গিয়ে অর্গানের কাছে। গান ধরলেন, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।’ …যিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, তাঁর সে-কন্ঠের গান শুনেছেন, তাঁরাই শুধু মনে করতে পারবেন তাঁর সেদিনের রূপমূর্তি, তাঁর সেকালের গানের কথা। …মনে হল, দিব্য জ্যোতির্ময় পুরুষের সে-গান প্রাঙ্গণশীর্ষে বিস্তৃত চন্দ্রাতপের বাধা ভেদ করে কোথা যে উধাও হল ঊর্ধ্ব আকাশে। …”
অনেকেই জানেন, রবীন্দ্রনাথ নিজের গানের সুর নিজেই ভুলে যেতেন। অনেক সময় সম্পূর্ণ নতুন সুরেও পুরনো গান গেয়ে ফেলতেন। তেমন অভিজ্ঞতার কথাই লিপিবদ্ধ করেছেন শান্তিময়ী দত্ত তাঁর ‘মহিলাদের স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ’-এ। রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই আসতেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। তিনি এলে বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে সংগীত ও সাহিত্যের আসর বসত। শান্তিময়ী দত্ত লিখেছেন, “এমনই একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ গাইলেন ‘আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে।’ তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল, গাওয়ার সময় সর্বদাই আশেপাশের গায়ক-গায়িকাদের নিজের সঙ্গে গাইতে বলতেন ও গানটি শিখে নিতে বলতেন। ঐ গানটি সেদিন রবীন্দ্রনাথ এমন একটি সুরে গাইলেন যে শান্তা-সীতা অবাক হয়ে নিঃশব্দে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। গান শেষ করে কবি বললেন, ‘কি রে, তোরা চুপ করে রইলি কেন? আমার সঙ্গে গাইতে পারলি না?’ সীতাদেবী বললেন, ‘কি করে গাইব? আপনি যে সম্পূর্ণ নতুন সুরে গাইলেন। এ সুর তো আমাদের জানা নেই!’ কবি হেসে বললেন, ‘তাই নাকি? তোরা কি সুর শিখেছিস শোনা দেখি।’ তারা অন্য সুরে গানটি গেয়ে শোনানোর পর তিনি বললেন, ‘তা হবে। আমারই হয়তো ভুল হয়েছে…’।”
গায়ক রবীন্দ্রনাথের আর-এক রূপও প্রণিধানযোগ্য। ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’-এ প্রমথনাথ বিশী-র কলমে আমরা সেই রূপ দেখতে পাই– “তখন আশ্রমের গ্রীষ্মাবকাশ প্রায় শেষের দিকে, আকাশ নূতন বর্ষার মেঘে ঘন নীল, কিছু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, তখনো গাছের পাতা হইতে জল ঝরিতেছে। … আমি আমবাগানের মধ্য দিয়া কোথাও যাইতেছিলাম। হঠাৎ দেখিলাম রবীন্দ্রনাথ সবেগে আসিতেছেন; এতই ত্বরা যে পথ দিয়া চলিবার সময় নাই বলিয়াই মাঠ ভাঙিয়া চলিয়াছেন, …অদূরে দাঁড়াইয়া শুনিলাম গুনগুন করিয়া গানের দু’টি পদ আবৃত্তি করিতেছেন– ‘ভ্রমর যেথায় হয় বিবাগী নিভৃত নীল পদ্ম লাগি।’ ব্যাপার কী বুঝিতে বিলম্ব হইল না। এই গানটি তখনি রচনা করিয়া সুর দিয়াছেন; ভুলিয়া যাইবার আগেই গানটি দিনেন্দ্রনাথকে শিখাইয়া দিবার জন্য ছুটিয়া চলিয়াছেন। …তাঁহার এমন মত্ত ভাব আর কখনো দেখি নাই। উদাসীন দৃষ্টি সেই নিভৃত নীল পদ্মের দিকে বদ্ধ, দেহটা অভ্যেসের বশে ছুটিয়া চলিয়াছে। সব মিলিয়া সে যেন এক আবির্ভাব!”
ক্লারা বাট্ তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ অফ সঙ’-এ গায়ক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “একদিনের কথা মনে পড়ছে। তিনি যখন আমার গানের ভূয়সী প্রশংসা করলেন, মুগ্ধতার আবেশে, তাঁকে জানালাম, ‘আপনাকেও শুনতে বড় সাধ হয়৷’ নানা বাহানায় প্রাথমিকভাবে তিনি তাঁর কণ্ঠমাধুর্যের কথা অস্বীকার করলেও পরিশেষে বললেন, ‘আপনার সুরের সঙ্গী হয়ে আমি অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছি। তাই, আপনি যখন ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, আমি অবশ্যই গাইব। তাঁর সামনে সেদিন কেবল আমি একাই ছিলাম। কোনও যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই তিনি তাঁর নিজের দু-তিনটি গান শোনালেন। …তাঁর কণ্ঠস্বর কিছুটা অপ্রশিক্ষিত মনে হলেও তাঁর গানের মতন প্রাণঢালা স্নিগ্ধ উপস্থাপনা আমি তার আগে তেমন শুনিনি।”
নিঃসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ গানকে আঁকড়ে ধরেছেন বারে বারে। কেমন ছিল সেই আঁকড়ে ধরা? ‘প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ’-এ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ লিখেছেন, “…মন যখন ক্লিষ্ট তখন কোনও কোনও সময় নিজের মনে গান করতেন। …কোনও পারিবারিক ব্যাপারে কবির মন অত্যন্ত পীড়িত। কবি তখন থাকেন ছোট একটা নতুন বাড়িতে। শুধু দু’খানা ছোট ঘর। খাওয়ার পরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এখানেই থাকবে।’ লেখবার টেবিল সরিয়ে আমার শোবার জায়গা হল। পাশেই কবির ঘর। মাঝে একটা দরজা, পর্দা টাঙানো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে শুনতে পেলুম গান করছেন ‘অন্ধজনে দেহো আলো…’। বারবার ফিরে ফিরে চলল, সারা রাত ধরে। ফিরে ফিরে সেই কথা, ‘অন্ধজনে দেহো আলো…’। … সকালে মন্দিরের পরে বললুম, ‘কাল তো আপনি সারা রাত ঘুমোননি।’ একটু হেসে বললেন, ‘মন বড়ো পীড়িত ছিল তাই গান করছিলুম। ভোরের দিকে মন আকাশের মতোই প্রসন্ন হয়ে গেল…’।”
'ফাল্গুনী' নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও এমনই এক রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন। ‘রবিবশ্মি’-তে তিনি লিখেছেন, “…কোনো এক নাটক অভিনয় উপলক্ষে আমরা বহু লোক বোলপুরে গিয়েছিলাম। বসন্তকাল, জ্যোৎস্নারাত্রি। যত স্ত্রীলোক ও পুরুষ এসেছিলেন তাঁদের প্রায় সকলেই পারুলডাঙা নামক এক রম্য বনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কেবল আমি যাইনি, রাত জাগবার ভয়ে। …গভীর রাত্রি। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল যেন শান্তিনিকেতনের নীচের তলার সামনের মাঠ থেকে মৃদু মধুর গানের স্বর ভেসে আসছে। আমি উঠে ছাদের আলসের ধারে গিয়ে দেখলাম, কবিগুরু জ্যোৎস্নাপ্লাবিত খোলা জায়গায় পায়চারি করছেন আর গুনগুন রবে গান গাইছেন। আমি খালি পায়ে ধীরে ধীরে নীচে নেমে গেলাম। আমি গুরুদেবের কাছে গেলাম, কিন্তু তিনি আমাকে লক্ষ্য করলেন না। আপনমনে যেমন গান গেয়ে গেয়ে পায়চারি করছিলেন তেমনি পায়চারি করতে করতে গান গাইতে লাগলেন। গান গাইছিলেন খুব মৃদুস্বরে। আমি পিছনে পিছনে বেড়াতে বেড়াতে গানের কথা ধরবার চেষ্টা করতে লাগলাম। তিনি গাইছিলেন, ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে…’। অনেকক্ষণ পরে গান থামলে তিনি অতি মৃদুস্বরে কথা বললেন, ‘চারু এসেছ?’ আমি তাঁকে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিলাম। তিনি তেমনি মৃদুস্বরে বললেন, ‘যাও, তুমি শোও গিয়ে।’ বুঝলাম, তিনি একলা থাকতে চান। আমি চলে এলাম।”
কলকাতার মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া শেষ গান শোনার অভিজ্ঞতার কথা পাওয়া যায় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’-এ– “স্টেজে দাঁড়িয়ে ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না’ গানটি নিজে গাইলেন। তখন আমি গানের দল থেকে বেরিয়ে গান শোনবার লোভে কাউকে না বলে অডিটোরিয়ামে চলে গিয়েছিলাম। গানটি যথারীতি গেয়ে গুরুদেব স্টেজ থেকে বেরিয়ে এসে লক্ষ্য করলেন যে, গানের দলে আমি বসে নেই। আমিও তাড়াতাড়ি অডিটোরিয়াম থেকে ফিরে আসছিলাম এবং আসতে গিয়ে সামনে পড়ে গিয়েছি। পড়ে যাওয়াতেই তিনি এক ধমক লাগালেন। বললেন, ‘গানের দলে যে তোমাকে দেখতে পেলাম না! তুমি কোথায় গিয়েছিলে? কোথা থেকে আসছ?’ তার উত্তরে তেমনি সুর চড়িয়ে আমিও বললাম, ‘আমি ঠিক জায়গায় ছিলাম।’ তখন চাপা গলায় বললেন, ‘শোনা গিয়েছিল তো…?’”
অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ যে কত মধুর ছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন প্রমথ চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, “গলা ছিল তাঁর আশ্চর্য। …রবীন্দ্রনাথ বন্ধু হিসেবে আমাদের বাসায় প্রায় প্রত্যহই আসতেন এবং প্রায় প্রত্যহই তাঁর স্বরচিত গান শুনতুম।” (পূর্বস্মৃতি, গীতবিতান বার্ষিকী) প্রতিমা দেবী-র স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি পরিণত বয়সে নিজের কণ্ঠ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কী ধারণা হয়েছিল–“আমার অল্প বয়সের সে-গলা আর নাই। পেয়েছিলাম বটে একটা গলার মতন গলা। কিন্তু ভগবান কেড়ে নিয়েছেন। … তখন মধ্যমে ধরে ছেড়ে দিতুম সুর, পাখির মতন সে উড়ে চলত সুরের ধাপে ধাপে পর্দায় পর্দায়।” (রবীন্দ্রনাথ, মাসিক বসুমতী)
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “মাঝে মাঝে গান রচনার নেশায় যখন আমায় পেয়েছে তখন আমি সকল কর্তব্য ভুলে তাতে তলিয়ে গেছি। আমি যদি ওস্তাদের কাছে গান শিক্ষা করে দক্ষতার সঙ্গে সেই সকল দুরূহ গানের আলাপ করতে পারতুম তাতে নিশ্চয় সুখ পেতুম, কিন্তু আপন অন্তর থেকে প্রকাশের বেদনাকে গানে মূর্তি দেবার যে আনন্দ সে তার চেয়ে গভীর।” আমরা জানি, অসীম বেদনায় সেই গভীরতর আনন্দই তাঁকে শান্তি দিয়েছে।
কলকাতার মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া শেষ গান শোনার অভিজ্ঞতার কথা পাওয়া যায় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’-এ– “স্টেজে দাঁড়িয়ে ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না’ গানটি নিজে গাইলেন। তখন আমি গানের দল থেকে বেরিয়ে গান শোনবার লোভে কাউকে না বলে অডিটোরিয়ামে চলে গিয়েছিলাম। গানটি যথারীতি গেয়ে গুরুদেব স্টেজ থেকে বেরিয়ে এসে লক্ষ্য করলেন যে, গানের দলে আমি বসে নেই। আমিও তাড়াতাড়ি অডিটোরিয়াম থেকে ফিরে আসছিলাম এবং আসতে গিয়ে সামনে পড়ে গিয়েছি। পড়ে যাওয়াতেই তিনি এক ধমক লাগালেন। বললেন, ‘গানের দলে যে তোমাকে দেখতে পেলাম না! তুমি কোথায় গিয়েছিলে? কোথা থেকে আসছ?’ তার উত্তরে তেমনি সুর চড়িয়ে আমিও বললাম, ‘আমি ঠিক জায়গায় ছিলাম।’ তখন চাপা গলায় বললেন, ‘শোনা গিয়েছিল তো…?’”
অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ যে কত মধুর ছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন প্রমথ চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, “গলা ছিল তাঁর আশ্চর্য। …রবীন্দ্রনাথ বন্ধু হিসেবে আমাদের বাসায় প্রায় প্রত্যহই আসতেন এবং প্রায় প্রত্যহই তাঁর স্বরচিত গান শুনতুম।” (পূর্বস্মৃতি, গীতবিতান বার্ষিকী) প্রতিমা দেবী-র স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি পরিণত বয়সে নিজের কণ্ঠ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কী ধারণা হয়েছিল–“আমার অল্প বয়সের সে-গলা আর নাই। পেয়েছিলাম বটে একটা গলার মতন গলা। কিন্তু ভগবান কেড়ে নিয়েছেন। … তখন মধ্যমে ধরে ছেড়ে দিতুম সুর, পাখির মতন সে উড়ে চলত সুরের ধাপে ধাপে পর্দায় পর্দায়।” (রবীন্দ্রনাথ, মাসিক বসুমতী)
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “মাঝে মাঝে গান রচনার নেশায় যখন আমায় পেয়েছে তখন আমি সকল কর্তব্য ভুলে তাতে তলিয়ে গেছি। আমি যদি ওস্তাদের কাছে গান শিক্ষা করে দক্ষতার সঙ্গে সেই সকল দুরূহ গানের আলাপ করতে পারতুম তাতে নিশ্চয় সুখ পেতুম, কিন্তু আপন অন্তর থেকে প্রকাশের বেদনাকে গানে মূর্তি দেবার যে আনন্দ সে তার চেয়ে গভীর।” আমরা জানি, অসীম বেদনায় সেই গভীরতর আনন্দই তাঁকে শান্তি দিয়েছে।