“আমি পৃথিবীর কবি যেথা তার যত উঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনই”
বলেছিলেন যে কবি, তাঁর নিজের একান্ত পার্থিব বৃত্তের বেদনবাঁশির ঝঙ্কারও বড় কম নয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনীকারদের বুঝি একটি বিশেষ খতিয়ান রাখতেই হয়েছে কবিজীবনের ব্যক্তিগত ছবি আঁকতে গিয়ে, তা হল শৈশবাবধি আজীবন একটির পর একটি প্রিয় সম্পর্কের বিয়োগচিহ্ন এবং তা জীবনাবসানের মাত্র একবছর আগে কবির প্রাণপ্রিয় সন্তানবৎ ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত।
আশিবছরের দীর্ঘ জীবনপথে কতবার মৃত্যু আঘাত লেগেছে প্রাণে, কত বার পাঁজর উঠেছে কেঁপে, তবুও অনন্তের বাণীবাহক রবিকবি কিছুতেই পিছু হঠেননি। তবুও শান্তি তবু আনন্দ — এই অভিজ্ঞানে নিরন্তর দুরতিক্রম্যকে সহজপাঠ হিসেবেই গ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। ঠাকুর পরিবারের বা তার বাইরেও জগতজোড়া আত্মজনের অকালমৃত্যুতে যখনই যেখানে বিচ্ছেদ উঠেছে ব্যথিয়ে, সেইখানেই স্বনির্দেশ্য জীবনদেবতাকে আঁকড়ে ধরেছেন তিনি গানে গন্ধে আলোকে পুলকে, বারংবার। জননী, নতুন বৌঠান, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা, সন্তানসম জন — একে একে নিভেছে দেউটি, আর রবীন্দ্রনাথ যেন আপনচিত্তজয়ে অঙ্গীকার করেছেন, “দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়”।
স্ত্রীর মৃত্যুর পরপরই একে একে দুই কন্যাকে হারিয়েছেন তিনি। নিতান্ত অকালে শিশু রবীন্দ্রনাথের প্রতিচ্ছবির মতো কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথও চলে গেছেন। তবু আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে বিচিত্র সৃষ্টির পথে চলেছিলেন কবি। মুমূর্ষু কন্যা রেণুকার শেষের দিনে তার একান্ত আবদারে শান্তমুখে শুনিয়েছেন, “ওঁ পিতা নোহসি”।
প্রথম সন্তান মাধুরীলতা, তাঁর আদরের বেলির মৃত্যুর পর ‘শেষ প্রতিষ্ঠা’ কবিতাটিতে কবি লিখলেন —
“মানুষের কাছে
যাওয়া-আসা ভাগ হয়ে আছে
তাই তার ভাষা
বহে শুধু আধখানা আশা
আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ
যে-সমুদ্রে আছে নাই পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান”
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনই”
বলেছিলেন যে কবি, তাঁর নিজের একান্ত পার্থিব বৃত্তের বেদনবাঁশির ঝঙ্কারও বড় কম নয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনীকারদের বুঝি একটি বিশেষ খতিয়ান রাখতেই হয়েছে কবিজীবনের ব্যক্তিগত ছবি আঁকতে গিয়ে, তা হল শৈশবাবধি আজীবন একটির পর একটি প্রিয় সম্পর্কের বিয়োগচিহ্ন এবং তা জীবনাবসানের মাত্র একবছর আগে কবির প্রাণপ্রিয় সন্তানবৎ ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত।
আশিবছরের দীর্ঘ জীবনপথে কতবার মৃত্যু আঘাত লেগেছে প্রাণে, কত বার পাঁজর উঠেছে কেঁপে, তবুও অনন্তের বাণীবাহক রবিকবি কিছুতেই পিছু হঠেননি। তবুও শান্তি তবু আনন্দ — এই অভিজ্ঞানে নিরন্তর দুরতিক্রম্যকে সহজপাঠ হিসেবেই গ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। ঠাকুর পরিবারের বা তার বাইরেও জগতজোড়া আত্মজনের অকালমৃত্যুতে যখনই যেখানে বিচ্ছেদ উঠেছে ব্যথিয়ে, সেইখানেই স্বনির্দেশ্য জীবনদেবতাকে আঁকড়ে ধরেছেন তিনি গানে গন্ধে আলোকে পুলকে, বারংবার। জননী, নতুন বৌঠান, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা, সন্তানসম জন — একে একে নিভেছে দেউটি, আর রবীন্দ্রনাথ যেন আপনচিত্তজয়ে অঙ্গীকার করেছেন, “দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়”।
স্ত্রীর মৃত্যুর পরপরই একে একে দুই কন্যাকে হারিয়েছেন তিনি। নিতান্ত অকালে শিশু রবীন্দ্রনাথের প্রতিচ্ছবির মতো কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথও চলে গেছেন। তবু আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে বিচিত্র সৃষ্টির পথে চলেছিলেন কবি। মুমূর্ষু কন্যা রেণুকার শেষের দিনে তার একান্ত আবদারে শান্তমুখে শুনিয়েছেন, “ওঁ পিতা নোহসি”।
প্রথম সন্তান মাধুরীলতা, তাঁর আদরের বেলির মৃত্যুর পর ‘শেষ প্রতিষ্ঠা’ কবিতাটিতে কবি লিখলেন —
“মানুষের কাছে
যাওয়া-আসা ভাগ হয়ে আছে
তাই তার ভাষা
বহে শুধু আধখানা আশা
আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ
যে-সমুদ্রে আছে নাই পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান”
মাতৃহারা ছোট ছেলেটি তাঁর, শান্তিনিকেতনের আশ্রমে যেন শিশু রবির পুনরাবির্ভাব তার ভাবে-মনে। ১৩১৩ সালের শ্রীপঞ্চমীর দিন শমীরই উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে শুরু হয়েছিল ঋতু উৎসব, জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। কিন্তু মাত্র ১১ বছর বয়সে কবির আদরের এই পুত্রের প্রয়াণ ঘটে ১৯০৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর। ‘শিশু’ কাব্য রচনা প্রসঙ্গে ‘কবিতাগুলি যখন লিখছিলাম তখন শমী ও তার মায়ের জীবনটাই আমার সামনে ছিল।’… লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই শমীও যখন মাত্র এগারো বছরে চলে গেল রবীন্দ্রনাথ নিঃশব্দে সহ্য করলেন সেই নির্মম আঘাত। ব্যক্তিগত শোক-তাপের ঊর্ধ্বে ওঠার কী অনন্য প্রয়াস তাঁর, সে কথা ধরা পড়েছে কন্যার কাছে লেখা চিঠিতে। শমীর মৃত্যুর পর ছোট মেয়ে মীরাকে তিনি লিখেছেন, ”শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি — সমস্তর মধ্যেই সব রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে…।”
১৯১৮ তে প্রকাশিত পরিশেষ কাব্যের মৃত্যুঞ্জয় কবিতায় প্রবল দার্ঢ্যে উচ্চারণ করলেন —
“পাঁজর উঠিল কেঁপে,
বক্ষে হাত চেপে
শুধালেম, “আরো কিছু আছে নাকি,
আছে বাকি
শেষ বজ্রপাত?’
নামিল আঘাত।
এইমাত্র?
আর কিছু নয়?
ভেঙে গেল ভয়।”
১৯১৮ তে প্রকাশিত পরিশেষ কাব্যের মৃত্যুঞ্জয় কবিতায় প্রবল দার্ঢ্যে উচ্চারণ করলেন —
“পাঁজর উঠিল কেঁপে,
বক্ষে হাত চেপে
শুধালেম, “আরো কিছু আছে নাকি,
আছে বাকি
শেষ বজ্রপাত?’
নামিল আঘাত।
এইমাত্র?
আর কিছু নয়?
ভেঙে গেল ভয়।”
কিন্তু অকালবিয়োগ তাঁকে মুক্তি দিল কই?
শেষ বজ্রপাত অশেষ হল আবারও। মাত্র একুশ বছর বয়সে পরপারের খেয়ায় ভাসলেন রবীন্দ্রনাথের একমাত্র দৌহিত্র আদরের নীতু। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র নীতীন্দ্রনাথের স্মরণে, বলা ভালো অকালে হারানো গৃহলক্ষ্মী মৃণালিনীদেবীর অতুল স্নেহের আকরের স্মরণে কন্যা অতসীলতার (মীরাদেবী)-র পুত্রের নাম রেখেছিলেন কবি–নীতীন্দ্রনাথ। কন্যার বিবাহিত জীবনের বিড়ম্বনায় ক্ষতবিক্ষত মনের ওপরে যেন এক অনস্বীকার্য আদরের প্রলেপ এই ছেলেটি। বহুগুণে সমন্বিত নীতুকে মনে মনে বড় আঁকড়ে ধরেছিলেন কবি।
দুঃখের তিমির অতিক্রম করে চির মঙ্গলালোককে খুঁজে ফেরার দুর্দম অনমনীয়তা কিন্তু প্রথমবার টলে গেল নীতুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। অন্নপ্রাশনের দিনে নামকরণ করা থেকে শুরু করে বরাবর দৌহিত্রকে নিজের মনের মতো করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯২২-এর সেপ্টেম্বরে ‘শারদোৎসব’ নাটক কলকাতায় দ্বিতীয় বার মঞ্চস্থ হয়। কবির সঙ্গে অভিনয় করেন নীতীন্দ্রনাথ। এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘সকলের চেয়ে আমাদের ভাল লাগিল উপানন্দের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রের অভিনয়।’ নীতীন্দ্রনাথ শুধু ভালো অভিনয়ই করতেন না, গানও গাইতেন ভালো।
ইতিপূর্বে ১৯১৩ সালে কবি তখন লন্ডনে, নাতির জন্য প্রবাসে বসেও তাঁর মন উতলা। নীতীন্দ্রের ছবিও নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে। খবর পেলেন, নাতি এগজিমায় আক্রান্ত হয়েছিল। কন্যাকে নাতির জন্য হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন তিনি।
শান্তিনিকেতনে আশ্রমে নীতীন্দ্রকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ চান ছেলেকে কাছে রেখে পড়াতে। ফের শুরু টানাপড়েন। কবি চিঠিতে লিখেছিলেন, খোকার ইশকুলের ব্যাপারটা নিয়ে তিনি চিন্তিত। বিদেশে বাবা-মায়ের কাছে থেকে স্কুলের পাঠ শেষ করতে যান নীতীন্দ্রনাথ। তারপর, বিদ্যালয়ের পাঠশেষে দেশে ফেরেন ১৯৩০ সালে। ফিরে ছাপাখানা ও প্রকাশনার ব্যবসার পাঠ নিতে গেলেন বম্বেতে। ব্যাপারটা কবির পছন্দ হয়নি। নাতির জন্য তিনি জার্মানিতে কাজের খোঁজ করতে থাকেন। ১৯৩১-এ নীতুকে জার্মানি পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু, সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লেন নীতীন্দ্রনাথ। বছর কাটলেও সুস্থ হলেন না। বাধ্য হয়ে মীরাদেবী গেলেন জার্মানি। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই, মাত্র একুশ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটালেন নীতীন্দ্র। দিনটা ছিল ১৯৩২-এর ৭ অগস্ট, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ। কলকাতায় বসে শোকাতুর কবি চিঠিতে মেয়েকে লিখেছিলেন, ”নীতুকে খুব ভালোবাসতুম…আমার শোকের দায় আমিই নেব— বাইরের লোকে কি বুঝবে তার ঠিক মানেটা।”
“অন্তরগ্লানি সংসারভার” চিরদিন ভূমায় সমর্পিত রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাত্তর বৎসর বয়সে সবার অলক্ষ্যে নিজের হাতে মুছে ফেললেন আপন স্বাক্ষরের ‘শ্রী’ টুকু। নীতীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে আর শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, কবির নাম লেখা হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নীতীন্দ্রনাথের প্রয়াণজনিত অকালক্ষত সেই অসহ-সহন মৃত্যুঞ্জয়ী দার্শনিকতায় যেন নিঃশব্দ-স্বাক্ষর রেখে গেল। আর কোনও দিন বাংলা কাব্য তথা সাহিত্যজগত “শ্রী” রবীন্দ্রের সাক্ষাৎ পেল না। এর ঠিক নয় বছর বাদে, এক আশ্চর্য সমাপতনে “প্রভাতের কপালে সূর্য উঠল না”, সেও এক বাইশে শ্রাবণ, রাখিবন্ধন তিথি — মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে অস্তাচলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শেষ বজ্রপাত অশেষ হল আবারও। মাত্র একুশ বছর বয়সে পরপারের খেয়ায় ভাসলেন রবীন্দ্রনাথের একমাত্র দৌহিত্র আদরের নীতু। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র নীতীন্দ্রনাথের স্মরণে, বলা ভালো অকালে হারানো গৃহলক্ষ্মী মৃণালিনীদেবীর অতুল স্নেহের আকরের স্মরণে কন্যা অতসীলতার (মীরাদেবী)-র পুত্রের নাম রেখেছিলেন কবি–নীতীন্দ্রনাথ। কন্যার বিবাহিত জীবনের বিড়ম্বনায় ক্ষতবিক্ষত মনের ওপরে যেন এক অনস্বীকার্য আদরের প্রলেপ এই ছেলেটি। বহুগুণে সমন্বিত নীতুকে মনে মনে বড় আঁকড়ে ধরেছিলেন কবি।
দুঃখের তিমির অতিক্রম করে চির মঙ্গলালোককে খুঁজে ফেরার দুর্দম অনমনীয়তা কিন্তু প্রথমবার টলে গেল নীতুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। অন্নপ্রাশনের দিনে নামকরণ করা থেকে শুরু করে বরাবর দৌহিত্রকে নিজের মনের মতো করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯২২-এর সেপ্টেম্বরে ‘শারদোৎসব’ নাটক কলকাতায় দ্বিতীয় বার মঞ্চস্থ হয়। কবির সঙ্গে অভিনয় করেন নীতীন্দ্রনাথ। এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘সকলের চেয়ে আমাদের ভাল লাগিল উপানন্দের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রের অভিনয়।’ নীতীন্দ্রনাথ শুধু ভালো অভিনয়ই করতেন না, গানও গাইতেন ভালো।
ইতিপূর্বে ১৯১৩ সালে কবি তখন লন্ডনে, নাতির জন্য প্রবাসে বসেও তাঁর মন উতলা। নীতীন্দ্রের ছবিও নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে। খবর পেলেন, নাতি এগজিমায় আক্রান্ত হয়েছিল। কন্যাকে নাতির জন্য হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন তিনি।
শান্তিনিকেতনে আশ্রমে নীতীন্দ্রকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ চান ছেলেকে কাছে রেখে পড়াতে। ফের শুরু টানাপড়েন। কবি চিঠিতে লিখেছিলেন, খোকার ইশকুলের ব্যাপারটা নিয়ে তিনি চিন্তিত। বিদেশে বাবা-মায়ের কাছে থেকে স্কুলের পাঠ শেষ করতে যান নীতীন্দ্রনাথ। তারপর, বিদ্যালয়ের পাঠশেষে দেশে ফেরেন ১৯৩০ সালে। ফিরে ছাপাখানা ও প্রকাশনার ব্যবসার পাঠ নিতে গেলেন বম্বেতে। ব্যাপারটা কবির পছন্দ হয়নি। নাতির জন্য তিনি জার্মানিতে কাজের খোঁজ করতে থাকেন। ১৯৩১-এ নীতুকে জার্মানি পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু, সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লেন নীতীন্দ্রনাথ। বছর কাটলেও সুস্থ হলেন না। বাধ্য হয়ে মীরাদেবী গেলেন জার্মানি। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই, মাত্র একুশ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটালেন নীতীন্দ্র। দিনটা ছিল ১৯৩২-এর ৭ অগস্ট, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ। কলকাতায় বসে শোকাতুর কবি চিঠিতে মেয়েকে লিখেছিলেন, ”নীতুকে খুব ভালোবাসতুম…আমার শোকের দায় আমিই নেব— বাইরের লোকে কি বুঝবে তার ঠিক মানেটা।”
“অন্তরগ্লানি সংসারভার” চিরদিন ভূমায় সমর্পিত রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাত্তর বৎসর বয়সে সবার অলক্ষ্যে নিজের হাতে মুছে ফেললেন আপন স্বাক্ষরের ‘শ্রী’ টুকু। নীতীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে আর শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, কবির নাম লেখা হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নীতীন্দ্রনাথের প্রয়াণজনিত অকালক্ষত সেই অসহ-সহন মৃত্যুঞ্জয়ী দার্শনিকতায় যেন নিঃশব্দ-স্বাক্ষর রেখে গেল। আর কোনও দিন বাংলা কাব্য তথা সাহিত্যজগত “শ্রী” রবীন্দ্রের সাক্ষাৎ পেল না। এর ঠিক নয় বছর বাদে, এক আশ্চর্য সমাপতনে “প্রভাতের কপালে সূর্য উঠল না”, সেও এক বাইশে শ্রাবণ, রাখিবন্ধন তিথি — মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে অস্তাচলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।