রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


ঐ নূতনের কেতন ওড়ে...

বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। পৃথিবীর যেখানে যত বাঙালি আছেন, তারা সবাই উৎসবমুখর হয়ে বাংলা নববর্ষ পালন করেন। এই দিনটি যেমন আনন্দ উল্লাসের তেমনি পরস্পর কুশল বিনিময় ও কল্যাণ কামনার দিন। সারা বছরের সমস্ত গ্লানি মুছে দিয়ে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব চুকিয়ে প্রতি বছর আসে পয়লা বৈশাখ। নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনেই গ্রামে-গঞ্জে শহরে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। মেলা চলে বৈশাখ জুড়ে। এই মেলা বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য।

পয়লা বৈশাখ ব্যবসায়ী মহলে হালখাতার দিন। ‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত এবং ফরাসি দু’ ভাষাতেই পাওয়া যায়। সংস্কৃত ‘হল’ শব্দের অর্থ ‘লাঙল’। তার থেকে বাংলায় এসেছে ‘হাল’ শব্দটি। আর ফরাসি ‘হাল’ মানে নতুন। আগেকার দিনে পয়লা বৈশাখের দিন ছিল ব্যবসায়ীদের কাছে নতুন খাতা খোলার দিন। তখন চাষবাস নির্ভর করত সৌর বছরের উপর। কৃষকদের বারবার খাজনা দিতে হতো। সেইজন্য মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সে সময় এর নাম ছিল ‘ফসলি সন’। পরে তাই-ই ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিত হয়। আবার অনেকের মতে, বাংলার রাজা শশাঙ্ক এই বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। কথিত, এই দিনটিতে
হজরত মহম্মদ শাসকদের অত্যাচারে মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যান। এর ৯৬৩ বছর পর আকবর সিংহাসনে বসেন। তখন থেকেই হজরত মহম্মদের স্মৃতিবিজড়িত এই দিনটি পালন শুরু হয়।

আগেকার দিনে নববর্ষের ধারণা ছিল একেবারেই অন্যরকম। শীত ঋতু থেকে বর্ষ গণনা শুরু হতো। মানুষেরা আশা করতেন তারা যেন শতশরৎ জীবিত থাকতে পারেন। বর্ষা ও শরৎকালের সন্ধিক্ষণেই বলা হত নববর্ষ উৎসব। অষ্টমী পুজোর শেষকেই ধরা হতো পুরনো বছরের শেষ আর নতুন বছরের শুরু বলে। পরবর্তীকালে এই ভাবনা থেকে সরে গিয়ে এই অনুষ্ঠান ‘শারদোৎসব’ পরিণত হয়।

প্রধানত বাঙালির উৎসব হলেও এই নববর্ষের উৎসবে মহানন্দে যোগ দিতেন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি ধর্মের মানুষ। এই দিন একে অপরের বাড়িতে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠতেন। তাই বাংলা নববর্ষ সংস্কৃতির এক প্রধান অঙ্গ।

পয়লা বৈশাখকে যিনি বাঙালির মনে প্রাণে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় রবি ঠাকুর। তাঁর কবিতা, গান, নাটক প্রভৃতির মাধ্যমে নতুন বছরকে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। এ যেন পুরোনো জীবনের অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে নতুন এক জীবনের প্রবেশের আনন্দের অনুভূতি।

শান্তিনিকেতনে তখন প্রচন্ড তাপদাহ। গরমের ছুটির জন্য ২৫ বৈশাখ শান্তিনিকেতনের আশ্রম বিদ্যালয় প্রায় শূন্য । আশ্রমিকরা সবাই মিলে ঠিক করলেন ১৯৩৬ সালের নববর্ষের দিন বর্ষবরণের পরের দিনই কবির জন্মদিন পালন করা হবে। কবি তখন পঁচাত্তরে। একথা শুনে কবি খুব আনন্দ পেলেন। সম্মতিও দিলেন। এরপর থেকে নববর্ষের দিন শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিন পালন করা হতো। ১৯৪০ সালে নববর্ষ ও কবির জন্মদিন উপলক্ষে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জ নাচ, গান, কবিতাপাঠের মাধ্যমে মুখর হয়ে উঠেছিল। কালবৈশাখীর শুচিস্নান ইত্যাদির মাধ্যমে নববর্ষের দিনে মহাজীবনের উত্তরণের সন্ধান করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সেই সন্ধান আজও বাঙালির মনের মণিকোঠায়। তাই পয়লা বৈশাখ এখনও আপামর বাঙালির কাছে এক অনন্য অনুভূতি।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content