রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


শালী নদী।

‘উত্তরে শালি নদী কুলুকুলু বয়
দক্ষিণে শালবন ফুলে বনময়…’


সৌন্দর্যপিপাসু কাজী নজরুল ইসলাম শালি নদী সম্পর্কে যথার্থই বর্ণনা করেছেন তাঁর এই ছোট্ট কবিতায়। শালিনী নাম থেকে অপভ্রংশ হয়ে শালি নদী বাঁকুড়ার একান্তই নিজস্ব নদী। বাঁকুড়ার গঙ্গাজলবাটি ব্লকের অন্তর্গত বেলবুনি ও রাজামেলা গ্রামের মধ্যভাগ থেকে নদীটি সৃষ্টি হয়েছে; অর্থাৎ, নদীটি মেজিয়া এবং বাঁকুড়ার মধ্যবর্তী স্থানে কোরা পাহাড়ের পশ্চিমাঞ্চল থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ভূতত্ত্বগতভাবে বলা যেতে পারে, শালি নদী বাংলা বেসিনের পশ্চিমাঞ্চলের নদী। এটি উৎপত্তিস্থল থেকে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে, ইন্দাস ব্লকের অন্তর্গত সোমসার নামক গ্রামে দামোদর নদীতে পতিত হয়েছে, অর্থাৎ, নদীটি বাঁকুড়ার উত্তর-পূর্ব অংশের নদী। শালি নদী প্রায় ৮০.৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি নদী, সেই অর্থে বলা যেতে পারে, নদীটি খুব দীর্ঘ নদী নয়। বৃষ্টির জলে পুষ্ট এই নদীতে সারা বছর জল থাকে না।
এর অববাহিকাটি ৭২৭.১৩ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত, অববাহিকার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হল যথাক্রমে-৬৪.৫১ কিলোমিটার ও ১১ ২৭ কিলোমিটার এবং এর পরিধি হল ১৬১.০৬ কিমি। ছোট্ট এই নদীটি কুলুকুলু ধারায় প্রবাহিত হয়েছে বাঁকুড়ার বেলবনি, রাজামেলা, অমরকানন, বেন্দা, হাটকৃষ্ণনগর, খোশালপুর, পারুল, নারানপুর, পিঁপড়েবনি, মহেশপুর, সোনামুখী, বেলিয়াতোড়, পাত্রসায়ের ও সোমসার ইত্যাদি গ্রাম ও শহরের মধ্য দিয়ে। শালি নদীর একটি ছোট্ট উপনদী আছে, তার নাম বোদাই। বৃষ্টির জলে পুষ্ট এই ক্ষুদ্র, ক্ষীণকায় ধারাটি পাত্রসায়রের কাছে শালি নদীতে মিলিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:

উদ্ভিদ থেকে তৈরি কৃত্রিম মাংসই খেয়াল রাখবে স্বাস্থ্যের, দাবি গবেষণায়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর

এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই নদীর সমগ্র অববাহিকার প্রায় ১৫ শতাংশ অংশে খণ্ডিত ও প্রায় ২৩ শতাংশ অংশে ঘন, শুষ্ক ক্রান্তীয় বনভূমি লক্ষ্য করা যায়। যেসকল গাছ দেখা যায়, তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল—শাল, ইউক্যালিপটাস, সোনাঝুরি, আকাশমনি, মহুয়া, পলাশ, শিমুল, গুল্ম এবং তৃণ ইত্যাদি। উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব অংশের মাটি হল উর্বর, তাই সেখানে চাষবাস ভালো হয়ে থাকে। চাষের মধ্যে ধান চাষ বেশি হয়।

সমগ্র নদী অববাহিকায় বরাবর লাল ল্যাটেরাইট মাটি অথবা হলুদাভ-বাদামি লালমাটি বা হলুদাভ অ্যালুভিয়াল মাটি লক্ষ্য করা যায়। মালভূমি অঞ্চলের ন্যা য় কাঁকুরে শক্ত লালমাটির আধিক্যের জন্য এবং নদীটির প্রাবল্য কম থাকার জন্য নদী খাতের গভীরতা এবং প্রস্থ কোনওটাই অধিক নয়। এখানে উপক্রান্তীয় শুষ্ক ও ভিজে ধরনের আবহাওয়া লক্ষ্য করা যায় এবং মাসিক উষ্ণতা ২০-৪০℃ এর মধ্যে ওঠানামা করে। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১০০-১৪০০মিমি, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে অন্তত ৬৯ দিন, বৃষ্টির দিন বলে চিহ্নিত করা গেছে।

এখানে, অন্তত ৭৮% বৃষ্টিপাত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে হয়ে থাকে এবং নদী অববাহিকার উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে সংরক্ষিত অরণ্য লক্ষ্য করা যায়। বর্ষার সময় নদীটি জলের প্রাচুর্যে ভরা যৌবনবতী। এর ফলে আশেপাশের গ্রাম এবং তার অববাহিকার ধারে অবস্থিত ক্ষুদ্র জনপদগুলির মানুষের অশেষ দুর্গতি লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২০: অক্টোবর মাসের ষোলো, কী হল! কী হল?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

১৯৭৮ এবং ২০০০ সালের বন্যা তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য। ওই দুটি বন্যায়, বিশেষ করে প্রথমোক্ত সালের বন্যাটিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের মৃত্যু পরিলক্ষিত হয়েছিল। এর কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে, নদীর পাড়ের ব্যাপক বৃক্ষছেদন এবং ভূমিক্ষয়। এর ফলে নদীর গর্ভ মজে গিয়েছে। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলেই নদীর জল উপছে চারিপাশে বন্যা ঘটায়। এছাড়াও, অবৈজ্ঞানিক এবং অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ বা সেতু নির্মাণের ফলে নদী তার স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে বারেবারে তার গতিপথ পাল্টায়। এর ফলে নদীর গতিপথে বিভিন্ন জায়গাতে দেখা যায়, ছোট-বড় গভীর বা অগভীর জলাশয়, যা বর্তমানে মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।

নদী পথের বহুস্থান কচুরিপানা ও শ্যাওলায় পরিপূর্ণ, বর্ষাকাল ব্যতীত নদীতে যখন জল থাকে না, সেই সময়ে নদীগর্ভের উপর দিয়ে ক্ষণস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। যার উপর দিয়ে মানুষসহ সকলেই যাতায়াত করে থাকে। ফলে নদী তার শক্তি এবং শ্রী হারিয়ে ফেলে। এইভাবে সৌন্দর্যশালী শালিনী নদী, আজ রূপহীন শালি নদীতে পর্যবসিত হয়েছে। নদীটির ওপর বেশ কিছু জায়গায় কতগুলি সেতু আছে, যা দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে থাকে; যেমন— সোনামুখীর উপর স্থাপিত সেতু, বাঁকুড়া-দুর্গাপুরের সংযোগস্থলে শালি নদীর ওপর সেতু, বাঁকুড়া-রানীগঞ্জ জাতীয় সড়কে শালি নদীর উপর সেতু ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৪: মধুপুর ধাম, বাণেশ্বর মন্দির ও ধলুয়াবাড়ি সিদ্ধ নাথ শিবমন্দির

বাঁকুড়া জেলার গ্রামাঞ্চলের অন্যতম নদী এই শালি নদী। তাই একে ঘিরে মানুষের নানান উৎসব, লোকাচার ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। এখানে পৌষ সংক্রান্তিতে মকর স্নান, টুসু পূজা, তসলা, নফরদাসের মেলা ইত্যাদি হয়ে থাকে। তসলাতে এখানকার স্থানীয় মানুষরা মাটির সরা করে প্রদীপ অথবা বাতি জ্বালিয়ে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পুর্বের মতো না হলেও, এখনও এই নদীর তীরে টুসু গান, কীর্তন, মেলা ইত্যাদি হয়ে থাকে। সোমসারে স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজের জন্মস্থান, তাই এখানে রামকৃষ্ণদেব, মা সারদা, স্বামীজি ও স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজের জন্মদিন পালন করা হয়ে থাকে এবং তাকে ঘিরে বিরাট উৎসব অনুষ্ঠান হয়।

যেহেতু নদীর তীরে বড় কোন শিল্প গড়ে ওঠে নাই, তাই নদীর জল এখনও স্বচ্ছ ও প্রায় দূষণমুক্ত। কিন্তু নদীর গভীরতা কমে গেছে, তাই সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে নদীকে আরও গভীর করার জন্য। পঞ্চায়েত থেকে ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে, নদীর তীরে আরো বেশি বৃক্ষরোপন করা প্রয়োজন। কারণ যত বেশি গাছ থাকবে, ভূমিক্ষয়জনিত কারণে নদীর গভীরতা কমবে না।

সকলেরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মৃতপ্রায় এই নদী আবারও বেঁচে উঠবে, এ আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।
* ড. সুনাম চট্টোপাধ্যায়, সহ-শিক্ষক, সাঁচড়া হাই স্কুল, সাঁচড়া, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content