শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


তিনি ও সলিল চৌধুরী।

উত্তমকুমার ডাকতেন ‘মিত্তির কায়েত’ আর ‘বাবু’ বলে। দাদরার প্রতি ঝোঁক ছিল বলে কিশোর কুমার ডাকতেন ‘দাদরা বাবু’ বলে, আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও ভদ্র একজন মানুষ। তিনি মনে করতেন, শ্যামল মিত্র সুরকারের থেকেও শিল্পী হিসেবে বেশি সাফল্য পেয়েছিলেন। তাঁর পুরুষালি, সুরেলা, দরদ ভরা কণ্ঠের গান একেবারে মনের ভেতরে গিয়ে নাড়া দিত। তাঁর বিশেষ গুণ ছিল যে, কখনও কারও সমালোচনা করতেন না। সাফল্য তাঁকে অহঙ্কারী না করে বরং বিনয়ী করে তুলেছিল। সহজ মনের মানুষ ছিলেন। শিল্পী-সুরকার-গীতিকারদের যথাযোগ্য সম্মান দিতেন। উপযুক্ত মুহূর্তে রসিকতাও করতেন। আনন্দ করে বাঁচতে চাইতেন।

সঙ্গতে উত্তমকুমার।

প্রয়াত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় একবার স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, তাঁর সুরে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাজল নদীর জল’, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কই গো কৈ গো কই, আমার বকুল ফুল কই’, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আবছা মেঘের ওড়না গায়ে ওগো চাঁদের মেয়ে’, অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর ‘আঁখি জলে তোমারই নাম লিখে চলে যাই’, হৈমন্তী শুক্লার প্রথম ছায়াছবির গান ‘এমন স্বপ্ন কখনও দেখিনি আগে’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
তিনি নিজেও তাঁর সুরারোপিত ‘দেয়া নেয়া’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘কলঙ্কিনী’, ‘রাজবংশ’, ‘অজস্র ধন্যবাদ’, ‘হাসি শুধু হাসি নয়’, ‘ হঠাৎ দেখা ‘, ‘গড় নসিমপুর’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্টেন্ট’ প্রভৃতিতে অনবদ্য সব গান গেয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘গড় নসিমপুর’ ছবিতে উত্তমকুমারের উর্দু সংলাপের সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় একটা বাংলা গজল গেয়েছিলেন। গানের কথা ছিল, ‘যে গোলাপ কাঁটার ঘায়ে কাঁদায় প্রেমিক পাপিয়ারে’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। শ্যামল মিত্রের প্রত্যেক জন্মদিনে গায়িকার ফুল, মিষ্টি নিয়ে উপস্থিতি, আবার গায়িকার বিবাহবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতে তাঁর কখনও ভুল হতো না। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাহচর্যে ভরা ছিল তাঁদের সম্পর্ক।

তিনি ও আরতি মুখোপাধ্যায়।

সাল ১৯৬২, প্রযোজক হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বইতে হিন্দি ছবি ‘বিশ সাল বাদ’ এর জন্য উত্তমকুমারকে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু মহানায়ক তখন কলকাতায় বেশ কিছু ছবির কাজে ব্যস্ত থাকায় মাস খানেক পরে চেষ্টা করবেন বলে জানান। এই ঘটনা দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরায়। এরপরেই উত্তমকুমারের জন্য মান্না দে এবং শ্যামল মিত্রের গাওয়া গান শুনতে পান দর্শক-শ্রোতা। সেই সময়ের উজ্জ্বলতম ছবি ছিল ‘দেয়া নেয়া’। ওদিকে যে বন্ধুত্ব উত্তমকুমারের মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, সেই বন্ধুত্বে উভয়েরই অধিকারবোধ ছিল তীব্র। সাল ১৯৬৩, শুটিং চলছিল ‘দেয়া নেয়ার ‘। ছবির প্রযোজক, সুরকার, মুখ্য পুরুষ কণ্ঠে স্বয়ং শ্যামল মিত্র।
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র্য: নাম রেখেছি বনলতা…/১

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৩: সবুজের নেশায় অভয়ারণ্য

হেলদি ডায়েট: একটুতেই নখ ভেঙে যায়? নখের স্বাস্থ্যের জন্য এই সব খাবার পাতে রাখতেই হবে

সেলিব্রেটি মানেই সব পেয়েছির দেশ, উপচে পড়া গ্ল্যামার, আলোয় আলো আর প্রচুর স্তাবক। কিন্তু ছবির নায়কের ক্ষেত্রে জীবন সেসব হিসেব মানেনি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে তখন সংকট। শেষদিন অবধি চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। নিজের ভবানীপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি সেই সময় ময়রাস্ট্রিটে তাঁর প্রিয় সহকর্মী সুপ্রিয়া দেবীর ফ্ল্যাটে এসে ওঠেন। অত্যন্ত বিরক্ত, বিব্রত শ্যামল প্রযোজক হিসেবে ছবির শুটিং বন্ধের ঘোষণা করেন এবং উত্তমকুমারকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু মহানায়ক সেইসময় প্রযোজক নন, কাছের বন্ধু শ্যামল মিত্রের কাছে সময় চেয়ে নেন। কথা দেন সম্পর্ক তৈরি না হলে বাড়ি ফিরে যাবেন, কিন্তু সেই সময় আর আসে না। শ্যামলও মহানায়কের প্রতি সুপ্রিয়া দেবীর টান চিরকালীন বুঝে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেন। আবার শুটিং শুরু হয় দেয়া নেয়ার।

প্রসঙ্গত গৌরী দেবী ও সুপ্রিয়া দেবী উভয়েরই অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন উত্তমকুমারের ‘বাবু’। উত্তমকুমারের বলিষ্ঠ অভিনয় এবং অতুলনীয় লিপ সিং, মহারাষ্ট্রের মিষ্টি নায়িকার মিষ্টি করে বাংলা বলা, শ্যামল মিত্রের নিজের প্রথম জীবনের কাহিনীকে ছবির গল্পে তুলে ধরা, তাঁর অসামান্য সংগীত পরিচালনা, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা এই চলচ্চিত্রের সংগীতময়তা আর সাফল্যকে অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল।

পঞ্চাশের দশকের এক জলসায়। বাঁ দিক থেকে ইলা বসু, শ্যামল মিত্র, শচীন গুপ্ত ও আরতি মিত্র।

‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’, ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে’, ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন’, মাধবী মধুপে হলো মিতালী’, ‘দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা’, ‘এ গানের প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়’, আজও সমান জনপ্রিয়। গায়ক হিসেবে নিজের উত্তরণকে কখনও থেমে যেতে দেননি তিনি, তাই সলিল চৌধুরীর সঙ্গে সেই চল্লিশের দশক থেকে তাঁর যে পরিচয়, নির্ভরতা, তারই যেন সঠিক অনুরণন ঘটেছিল ‘যা যা রে যা যা পাখি’ গানে। নানা ওঠাপড়ার মাঝে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল মিত্র দু’জনেই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, একে অপরের সুরে গাওয়া, দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া থেকে কখনও নিজেদের সরিয়ে রাখতেন না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৮: খোকা নয়, খুকি নয়

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২: এই প্রথম বার মনে হল জীবন কঠিন হতে চলেছে, তাই মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৩: বাবা বিশ্বনাথের দরবারে

শ্যামল মিত্রের সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন ‘যে চোখেতে দেখবে আমায়’, ‘বিধিরে এই খেয়া বাইবো কত আর’, ‘আমার নিয়তি আঁধার’, ইত্যাদি কালজয়ী গান আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে শ্যামল মিত্র গেয়েছিলেন ‘হারাই হারাই করিস’, ‘দ্যাখো দ্যাখো কালো’, ‘হে দেবী তুয়েঁ’, ইত্যাদি; দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলেন, ‘বিধিরে এই খেয়া বাইবো কত আর’, ‘তোমাদের স্বর্গ সে তো কাঁচে গড়া’। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলা বসু, সুপ্রীতি ঘোষ, তালাত মাহমুদ, কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি প্রত্যেকে তাঁর সুরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এছাড়া ‘খেয়া’, ‘রাজকন্যা’, ‘আমি সে ও সখা’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্টেন্ট’ ‘বনপলাশীর পদাবলীর’ মতো বিখ্যাত ছবিগুলোর সংগীত পরিচালনা করেছিলেন শ্যামল মিত্র।

কেবল বাংলা চলচ্চিত্রেই নয় পঞ্চাশের দশকের গোড়াতে সলিল চৌধুরীর সুরে হিন্দি ছবি ‘বিরাজ বহু’তে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে নির্ভুল হিন্দি উচ্চারণে গেয়েছিলেন ‘তেরে ঘর আবাদ রহে’। পরে আবারও ‘অমানুষ’ (১৯৭৫), ‘আনন্দ আশ্রম'(১৯৭৭), ‘সফেদ ঝুট’ (১৯৭৭) প্রভৃতি ছবিতে কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে প্রমুখ প্রখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেন। এর মধ্যে ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর’ গাওয়ার জন্য কিশোর কুমার তাঁর কাছে এক মাস সময় চেয়ে নেন, তারপর তিনি যা গেয়েছিলেন তাতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর তাঁর সুরে গান গাইতে চাইতেন, মহম্মদ রফি তাঁকে বলতেন, কলকাতায় না থেকে বম্বে চলে আসুন। কিন্তু তিনি জানতেন নিজের কাজ, যা তিনি আজীবন নিষ্ঠা ভরে করে গিয়েছেন।

তিনি ও কিশোর কুমার।

কিন্তু সব হিসেব মেলেনি। প্রয়াত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি কি মৃত্যুর আভাস পেয়েছিলেন? না গভীর অভিমান? গায়িকাকে ‘চলে গেলাম আমি চলে গেলাম, সময় হলেই যেতে তো হবেই’ শেখাতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি, ১৯৬৯ সালে এক কনসার্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভয়ানক গাড়ি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। অনেক চেষ্টার পর প্রাণে বেঁচে ফিরে গেয়েছিলেন, ‘তোমাদের ভালোবাসা মরণের পার থেকে মোরে’, এই অ্যাক্সিডেন্টের বছর তিনেক আগে রেকর্ড করেছিলেন, ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন মোর যেতে নাহি চাই’। কিন্তু যেতে হয়েছিল, প্রিয় বন্ধু চলে যাওয়ার পর থেকেই অনিয়ম বাড়ে। শরীর আর সঙ্গ দিচ্ছিল না। এইসময় লাইভ পারফরমেন্সের রাশও ক্রমশই ভিন্ন হাতে যেতে শুরু করে। অথচ অডিয়েন্স বিচার করেই যুগের সঙ্গে নিজেকে মানাতে হচ্ছিল শ্যামল মিত্রকে।
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিকে ইংরেজিতে ভালো নম্বর পাওয়ার উপায় কি? দেখে নাও আজকের বিষয়: Seen Comprehension

স্বাদে-গন্ধে: মুরগির ঝোল কিংবা ঝাল নয়, এবার বানিয়ে ফেলুন দই মুরগি

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩২: শোকের আঁধারে আকাশ কালো—অযোধ্যায়

চার দশক জুড়ে শ্রোতার মনোরঞ্জনের পর অবশেষে ১৯৮৭ সালের ১৫ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান বাঙালির প্রিয় গায়ক। অথচ আজও তাঁর ‘শুভ্র শঙ্খ রবে’র মাধ্যমে সূচনা হয় বাঙালির অতি প্রিয় উৎসবের আর তিনি না থেকেও থেকে গেছেন অগণিত মানুষের হৃদয়ে।—শেষ
* ড. বিদিশা মিশ্র, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, কলকাতা। সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখক গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রীণা মুখোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষারত।

Skip to content