শ্যামল মিত্র।
তখনও ভারত স্বাধীন হয়নি। সেই উত্তাল, অগ্নিগর্ভ সময়ে বাড়িতে দেখতেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্যদের যাতায়াত। একসঙ্গে পঁচিশ-তিরিশ জন এসে থাকতেন, খেতেন। সেই সময় বাড়িতে আসতেন সলিল চৌধুরী। তিনি তখন আইপিটিএ-র (IPTA) অন্যতম সদস্য। সেই থেকে তাঁর সলিল চৌধুরীর সঙ্গে সখ্যতা, বন্ধুতা। বাড়ি মানে নৈহাটির বাড়ি যেখানে ১৯২৯ সালের ১৪ জানুয়ারি তাঁর জন্ম হয় আর তিনি স্বয়ং বাংলার প্রখ্যাত গায়ক, সুরকার ও সংগীত শিল্পী শ্যামল মিত্র।
সুধীরলাল চক্রবর্তী।
বাবা ছিলেন নৈহাটির বিখ্যাত ডাক্তার সাধনকুমার মিত্র। স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়ের ছাত্র। সেই সূত্রে তাঁকে বাড়িতে আসতেও দেখেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বাবা চাইতেন ছেলে তাঁর মতো ডাক্তার হবে। কিন্তু ছেলের তো গান অন্ত প্রাণ। মা প্রতিভাময়ী ও স্থানীয় গায়ক মৃণালকান্তি ঘোষের তত্ত্বাবধানে গানের প্রতি আকর্ষণ আরও বাড়ে। কিন্তু সামাজিক প্রকাশ যে গণনাট্য সংঘের ‘ও আলোর পথ যাত্রী’ গেয়ে ঘটবে তা কখনও ভাবেননি। যে স্বপ্ন তাঁকে মৃণালকান্তি ঘোষ ও স্বয়ং সলিল চৌধুরী সেই সময় দেখাচ্ছিলেন সেই স্বপ্নকেই বাস্তবায়িত করে তোলেন তাঁর হুগলি মহসিন কলেজের বন্ধু দিকপাল সংগীত সাধক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি তাঁকে নৈহাটি ছেড়ে গায়ক হওয়ার লক্ষ্যে কলকাতা যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেই মতো তিনি ১৯৪৬ সালে নৈহাটির রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায় তাঁর পিসির বাড়ি চক্রবেড়িয়া রোডে।
সেই বাড়ির খুব কাছেই গিরিশ মুখার্জী রোডে তখন উত্তমকুমার থাকতেন। একজনের চোখে নায়ক হওয়ার স্বপ্ন আর একজনের গায়ক হওয়ার। খুব তাড়াতাড়ি দু’জনের বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। উত্তমকুমারের মৃত্যু পর্যন্ত সেই বন্ধুত্বে কখনও চিড় ধরেনি। কিন্তু সেই সময় পেশাদার গায়কের যে পরিমাণ তালিমের প্রয়োজন তার অভাব তিনি নিজেই নিজের মধ্যে অনুভব করছিলেন। সেই মতো তৎকালীন বিখ্যাত গায়ক সুধীরলাল চক্রবর্তীকে গুরু হিসেবে মেনে নিয়ে চক্রবেড়িয়া থেকে উঠে আসেন লেক মার্কেটের মেসে। চলে পাঁচ বছরের নিরলস পরিশ্রম। শিষ্য যে শ্যামল মিত্র! তাই গুরুর প্রিয় হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগে না।
১৯৪৮ সালে প্রথম স্বপ্নপূরণ হয়, প্রথম গান রেকর্ড করেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে।
ছায়াছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ আসে ঠিক তার পরের বছর ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে। সহ শিল্পীরা ছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ এবং প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৪৮ সালে প্রথম স্বপ্নপূরণ হয়, প্রথম গান রেকর্ড করেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে।
ছায়াছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ আসে ঠিক তার পরের বছর ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে। সহ শিল্পীরা ছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ এবং প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন:
দশভুজা: ‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-২: প্রসঙ্গ ছত্তিসগড়
সেই শুরু। তারপর প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি সংগীত পরিচালক এবং গায়ক হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্রথম গান রেকর্ডের পর ক্রমশ সুবল দাশগুপ্ত, অনুগম ঘটক, হিমাংশু দত্ত, বারীন চট্টোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত প্রমুখ বিখ্যাত সুরকারদের সুরে নিজেকে উজাড় করে দেন।
১৯৫২ থেকে শুরু হয় তাঁর হিট গানের জয়যাত্রা। এই সময় গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তীর দুঃখজনক মৃত্যুতে গুরুপ্রণাম স্বরূপ রেকর্ড করেছিলেন ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ আর ‘আশা বাঁধে ঘর’। এরপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন গুরু সুধীরলালকে। রোজ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বাড়িতে টাঙানো গুরুর ব্লো-আপে প্রণাম করে বেরোতেন। গুরু ভক্তির চরম নিদর্শন পাওয়া যায় ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে যখন গুরুর উপদেশ মেনে সামান্য মদ্যপান করে রেকর্ডিং স্টুডিও যান, যাতে গান আরও ভালো হয়!
১৯৫২ থেকে শুরু হয় তাঁর হিট গানের জয়যাত্রা। এই সময় গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তীর দুঃখজনক মৃত্যুতে গুরুপ্রণাম স্বরূপ রেকর্ড করেছিলেন ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ আর ‘আশা বাঁধে ঘর’। এরপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন গুরু সুধীরলালকে। রোজ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বাড়িতে টাঙানো গুরুর ব্লো-আপে প্রণাম করে বেরোতেন। গুরু ভক্তির চরম নিদর্শন পাওয়া যায় ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে যখন গুরুর উপদেশ মেনে সামান্য মদ্যপান করে রেকর্ডিং স্টুডিও যান, যাতে গান আরও ভালো হয়!
আরও পড়ুন:
বিচিত্রের বৈচিত্র্য: যে জীবন মানেনি বাধা…
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৯: দেখতে দেখতে ‘সদানন্দের মেলা’
নেপথ্য গায়নের পাশাপাশি ১৯৫৩ সালে ‘লাখ টাকা’ ছবিতে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। এরপর স্বয়ং উত্তমকুমারের মন রাখতে সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে ‘আমার এ যৌবন’ গানে অভিনয় করেন। এই গানে রিহার্সালের পর রিহার্সাল হয়ে কখন যে ফাইনাল টেক হয়ে যায় বুঝতেই পারেননি অভিনেতারা। সবই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু গান পাচ্ছিলেন না বন্ধু উত্তমকুমারের লিপে। কারণ উত্তমকুমারের লিপে গান মানেই তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। অবশেষে ১৯৫৬ সালে ‘সাগরিকা’ ছবিতে উত্তমকুমারের জন্য গাইলেন ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’। সব সমীকরণের ওলটপালট হয়ে গেল। উচ্ছ্বল প্রেমিকের গানে হয়ে উঠলেন অদ্বিতীয়। এমন নিজস্ব, অনায়াস ধরণ সৃষ্টি করলেন যে পঞ্চাশ ষাটের দশকের যুব হৃদয় তাঁর গায়কীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল। কোথাও কোনও বিশেষ বা সাধারণ হৃদয় নিবেদনে তাঁর গান হয়ে উঠলো অপরিহার্য মাধ্যম। ‘নাম রেখেছি বনলতা’, ‘কার মঞ্জির বাজে’, ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর’, বা ‘ভালোবাস তুমি শুনেছি অনেকবার’, ‘ভীরু ভীরু চোখে’, আজও সেইসব জোড়া আর ভাঙা হৃদয়ের গল্পই শুনিয়ে যায়।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল মিত্র।
এর মধ্যে ‘নাম রেখেছি বনলতা’ গাওয়ার কথা ছিল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের। কিন্তু বনলতা তাঁর কোনও গুরুজনের নাম হওয়ায় তিনি গাইলেন না। সুধীন দাশগুপ্তের অসাধারণ অর্কেস্ট্রেশন আর নিজস্ব মুন্সিয়ানায় শ্যামল এমন গাইলেন যে সর্বকালীন রেকর্ড তৈরি হল। শুধু গান নয়, সিনেমা, সপ্তাহান্তে আড্ডা, ছবির মতো গল্প বলা, ফ্যাশনেবল জামাকাপড়, নামী ব্র্যান্ডের সিগারেট; জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতে, “শ্যামলবাবুর আওয়াজ খুব বড় নয়, কিন্তু খুব সুরেলা। সুর করতেনও খুব ভালো। ওঁর অনেক হিট গানেরই সুর ওঁর নিজের। খুব কাজে লাগিয়েছেন ওঁর অনুনাসিক ধ্বনি। আর গাইতেনও রোম্যান্টিক্যালি। ফলে সব মিলিয়ে একটা চমৎকার প্যাকেজ, যা ওঁকে দারুণ সাফল্য দিয়েছে।” পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক জুড়ে নানা স্বাদের চলচ্চিত্রের জন্য গান করেছেন এবং সংগীত পরিচালনাও করেছিলেন তিনি। ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘ভ্রান্তিবিলাসে’ অনবদ্য সংগীত নির্মাণেও অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৭: পুরীতে বাড়ি— রবীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১: পৃথিবী খ্যাত ডালটন হাইওয়ে এই শহরকে ছুঁয়েছে আর্কটিক বৃত্ত তথা উত্তরমেরুর সঙ্গে
পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ অবধি ‘অন্তরাল’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘ভানু পেল লটারি’, ‘কেরী সাহেবের মুন্সি’, ‘লালপাথর’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘শশীবাবুর সংসার’-এর মতো চলচ্চিত্রে তাঁর কণ্ঠ এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল। রাগাশ্রয়ী, লোকাশ্রয়ী, অতুলপ্রসাদী, রবীন্দ্রসঙ্গীত কোনও কিছুই বাদ যেত না তাঁর ব্যক্তিগত ভালোলাগা, ভালোবাসার কারণে।
প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে শ্যামল মিত্র ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
পুরোনো কলকাতার সেইসব সোনাঝরা সন্ধ্যায়, জলসায় তাঁর রম্য, শোভন, সহজ সরল উপস্থিতি, গানের সিলেকশন, লম্বা টানের গান দিয়ে আসরের সূত্রপাত ফ্যানেদের পাগল করে দিত। রক্ষণশীল বাড়ির মেয়েরা সারা রাত শুধু তাঁকে দেখবে, শুনবে বলে বসে থাকত। রাজেশ খান্নার মতো তাঁরও গাড়ি ঘেরাও হয়ে যেত অনুরাগীদের দ্বারা। আর তিনি স্টেজে উঠে কোনও অঙ্গভঙ্গি ছাড়া মুখ নীচু করে এমনভাবে গানের মধ্যে ডুবে যেতেন যা তাঁর রোম্যান্টিক স্টাইলকে আরও রোম্যান্টিক করে তুলতো। সেই পঞ্চাশ ষাটের দশকে উত্তম-হেমন্ত জুটির অনবদ্য প্রেমের গানগুলো যখন বাঙালি হৃদয়কে প্রত্যয়ী করে তুলছিল, গড়ে দিচ্ছিল প্রকাশের নিজস্ব ভাষা সেখানে উত্তম-শ্যামল জুটির ‘লাভার বয় সং’ যেন আর একটু বেশি উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে দিচ্ছিল ভাগাভাগির যন্ত্রণা, ক্ষত নিয়ে বয়ে চলা এক সমাজকে।—চলবে
* ড. বিদিশা মিশ্র, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, কলকাতা। সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখক গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রীণা মুখোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষারত।।