মাষ্টারদা সূর্য সেন।
এক অনন্যসাধারণ শিক্ষক ও তাঁর অন্যরকম ছাত্রেরা — সাল ১৯৩৩, অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর গৈরালা গ্রামে বিভিন্ন ছদ্মবেশে থাকা তাঁর মাস্টারদাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয় চক্রান্তকারী নেত্র সেন। আর তার বদলা নিতে ঠিক পরের বছর এগিয়ে আসে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র কিরণময় সেন। কোনও ভয় ভীতি ছাড়া এক রাতে নেত্র সেনের বাড়িতে পৌঁছে রামদার কোপে খুন করেন তাকে। প্রমাণাভাবে ব্রিটিশ পুলিশের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আমৃত্যু নিষ্কলুষ জীবন কাটান কিরণময়। নেত্র সেনের স্ত্রীর প্রত্যক্ষ সহায়তা পেয়েছিলেন তিনি। বেঁচে থাকতে কখনও স্বামীর হন্তাকে চিনিয়ে দেননি তিনি, মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন কারণ তিনি ছিলেন মাষ্টারদার একনিষ্ঠ ভক্ত। এমনি প্রভাব ছিল জনমানসে মাষ্টারদা সূর্য সেনের। ছাত্র পড়ানো ছিল তাঁর রক্তে।
পিতা শিক্ষক রমণীরঞ্জন সেন এবং মাতা শীলা বালা দেবীর সন্তান ২২ মার্চ ১৮৯৪-এ অবিভক্ত বাংলাদেশের নোয়াপাড়া, চট্টগ্রামে যেদিন জন্মেছিলেন সেদিন কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করেননি যে সেই ছেলেটি একদিন হয়ে উঠবে ভারতবর্ষের পূর্বীয় প্রান্তে মোতায়েন ব্রিটিশ অফিসার ও সাধারণ ব্রিটিশ কর্মচারীদের ত্রাস। তাদের অস্ত্রে তাদেরই শেষ করার পরিকল্পনা সেই প্রথম। সাল ১৯১৬, সূর্যকুমার সেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ. পড়াকালীন গুরু হিসেবে পান যুগান্তর বিপ্লবী দলের সদস্য সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীকে। তাঁর বিপ্লবী আদর্শ সূর্য সেনের চট্টগ্রামের ওরিয়েন্টাল স্কুলের অঙ্কের শিক্ষকের নিশ্চিত জীবনকে প্রভাবিত করে। সে প্রভাব ছিল অন্যরকম, তৎকালীন চট্টগ্রামের বাঙালি ঘোষাল, সেন, গুপ্ত , রায়, দত্তদের বাড়ির তেরো, চোদ্দ, পনের, ষোলো, কুড়ি বছরের কোমলমতিদের নিয়ে তৈরি হয় পঞ্চাশ-ষাট জনের দল, যারা অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেয়। খুঁজে খুঁজে বের করে ব্রিটিশ সরকারের পুড়িয়ে মারার হুমকি বৃথা যায়। কারও চায় খেলার মাঠ, কারও বন্ধুকে মারধোরের প্রতিশোধ, একটু বড় হলে চায় স্বাধীনতা, কারও শুধু প্রিয় মাষ্টারমশাই এর সান্নিধ্য।
সশস্ত্র কঠোর অনুশীলন, দেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ, তীব্র অসহযোগ, রাউন্ডের পর রাউন্ড গুলি আর অকথ্য পুলিশি অত্যাচার, জেরার নামে উঁচু জায়গা থেকে ছুঁড়ে ফেলা। মায়ের নিশ্চিন্ত আঁচল, মাছের ঝোল, বইখাতা, শ্লেট-পেনসিল ছেড়ে শুধু মানুষের মতো মানুষ হওয়ার টান। আর হাসতে হাসতে প্রাণ দেওয়ার, একসঙ্গে চলার অঙ্গীকার, ক্লাসে সকলের একসঙ্গে হাত তোলার অঙ্গীকার। একদিনে চট্টগ্রামের পুলিশলাইন, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, আর রেললাইন অচল করার অঙ্গীকার, শুধু তাদের প্রিয় মাষ্টারদার মুখের দিকে তাকিয়ে। সঙ্গে ছিল নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত চক্রবর্তী, কল্পনা দত্ত, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের প্রত্যয়।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৩: রবীন্দ্রনাথের মাস্টারমশায়
ভালোবাসা এবং ভরসা
পুজোর আগে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ডেঙ্গি, একদিনে ২৯২ জন আক্রান্ত, হাসপাতালে ভর্তি ৯১ জন
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২৮: অনুপুষ্টিতে ভরপুর পুঁটিমাছ ছোটদের দৃষ্টিশক্তির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
১৯৩১ এর ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের তুমুল যুদ্ধে হরিগোপাল বল (টেগরা), প্রভাস বল, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, মতি কানুনগো, অশোক দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাশগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিন ঘোষ, অর্ধেন্দু দস্তিদার শহীদ হন। যুদ্ধবিরতিতে মৃতদেহগুলো একে একে আনা হলে প্রত্যেকের বুকে পর পর কান দিয়ে মাষ্টারদা বসে থাকেন কিছুক্ষণ। যদি! সর্বকনিষ্ঠ নির্মল লালার মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকেন, পরমস্নেহে মাথাটা কোলে তুলে নেন। সন্তানতুল্য সঙ্গীদের এমন অবস্থা তাঁকে যন্ত্রণায় রিক্ত করে, তাঁর দৃষ্টি শূন্য হয়। যারা বেঁচে থাকেন তারা ঠিক দুবছর পর তাদের প্রিয় মাষ্টারদার প্রধান প্রধান ইন্দ্রিয় আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিনিময়ে, অজ্ঞান অবস্থায় মধ্যরাতে মৃত্যুকে বরণ করার কথা শোনেন। স্বাধীন ভারতের স্বপ্নে বিভোর এক মাষ্টারমশাই এর স্বপ্ন তারও চোদ্দ বছর পর সার্থক হয়।
তথ্যসূত্র: প্রহর.ইন, উইকিপিডিয়া, খেলে হম জি জান সে, চিটাগাং
তথ্যসূত্র: প্রহর.ইন, উইকিপিডিয়া, খেলে হম জি জান সে, চিটাগাং
আরও পড়ুন:
ছোটদের যত্নে: শিশুকে কোন ওষুধ কখন খাওয়াবেন? ওষুধ খাওয়ার সঠিক নিয়ম কী? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
এর মধ্যে প্রীতিলতা ও কল্পনা চট্টগ্রামের ড. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের অভিন্নহৃদয় বন্ধু এবং সশস্ত্র বিপ্লবে যোগদানের পক্ষপাতী ছিলেন। বিদ্যালয়ে আর্টস ও সাহিত্যে দড় প্রীতিলতা আর বিজ্ঞানে দড় কল্পনার স্বপ্ন কলকাতার বেথুন কলেজ হয়ে মাষ্টারদার অনুগামী পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখায় যোগদানের মাধ্যমে সার্থক হয়। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের শেষে এই দুই ব্রতীর মধ্যে প্রীতিলতা ১৯৩২ সালে পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাব দখলের সময় পুলিশের আটক এড়াতে সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন আর অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কিন্তু এত প্রত্যয়ও নিরবচ্ছিন্ন আশ্বাস দিতে পারেনি।