রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


আজ শুরু নবদ্বীপের ঐতিহ্যশালী রাস উৎসব। ধীরে ধীরে সেজে উঠেছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, বর্তমানের ‘হেরিটেজ সিটি’—সুপ্রাচীন এই নগর।

আমরা সকলেই রাসকে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠান বলেই জানি। রস ধাতু থেকে রাস শব্দটির সৃষ্টি। রস ধাতুর অর্থ ‘রসয়তি’ আস্বাদন অর্থে বা ‘রসয়তু’ আনন্দিত অর্থে গ্রহণ করা হয়। রাসের সৃষ্টি কবে এবং কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে ‘ভাগবত’-এর দশম স্কন্ধে ‘রাস পঞ্চাধ্যায়ে’ উল্লিখিত আছে। সেখানে একথাও বলা আছে কৃষ্ণকে পতি হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্রজের গোপীগণ গোটা কার্তিক মাস জুড়ে কাত্যায়নী ব্রত পালন করেছিলেন। গোপ জাতির মধ্যে নারী-পুরুষে মিলিত হয়ে যে নৃত্য, গীত হত তাই ছিল রাস। তাদের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী কাত্যায়নী কার্তিক মাসের পূর্ণিমার দিন যাতে গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের মিলন হয় সেই বর দিয়েছিলেন। কৃষ্ণও নিজের শক্তিকে বহু-ভাগে বিভক্ত করেছিলেন যাতে বৃন্দাবনের প্রায় ১৬০০০ গোপিনী তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। বিষ্ণুপুরাণ ও মৎস পুরাণে এই বর্ণনাই আছে। বিষ্ণুপুরাণে গোবিন্দ-সহ রাস ক্রীড়ার কথা আছে।
বৃন্দাবনের আদলে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, নবদ্বীপ ও শান্তিপুরে ব্যাপকভাবে রাসযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শান্তিপুর ও কোচবিহারে বৃন্দাবন কেন্দ্রিক রাসোৎসব পালিত হলেও নবদ্বীপে এই রীতি বেশ কিছুটা আলাদা। বৃন্দাবনের আদলে নবদ্বীপের স্বল্প কিছু বৈষ্ণব মন্দিরে চক্ররাস পালিত হয় ঠিকই, তবে নবদ্বীপের রাসোৎসব সম্পূর্ণ ভাবে বৈষ্ণবীয় রাস নয়। আসলে নবদ্বীপের রাস উৎসবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র। তাঁর দ্বারা ১৭৫২ সাল থেকে ৫৬ সালের মধ্যবর্তী কোনও সময় নবদ্বীপে শক্তি রাসের সূচনা হয়েছিল বলে জানা যায়। নবদ্বীপ শহরের দক্ষিণ দিকে এলানে শিবতলা অঞ্চলে এলানে কালীমাতার মাধ্যমে প্রথম রাসপুজোর সূচনা হয়েছিল। এরপর নবদ্বীপে আরও তিনটি কালীপুজো হয়। এ ভাবে রাস সূচিত হলেও ধীরে ধীরে কালী ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মূর্তি পুজো এখানে শুরু হয়। বৈষ্ণব ছাড়াও শাক্ত, শৈব, গাণপত্য ও লৌকিক পূজার্চনা প্রমাণ করিয়ে দেয় ‘শক্তিঃ শক্তিমতোরভেদা’। অর্থাৎ শক্তি শক্তিমান অভেদ। পাশাপাশি প্রমাণ করায় নবদ্বীপের মিশ্র সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৪: সুন্দরবনের রাজমাতা দেবী নারায়ণী

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪১: তদন্ত শুরু

আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা বা লক্ষ্মী পুজোর দিন থেকে নবদ্বীপে রাসের সূচনা হয়ে যায়। হয় পাট পুজো। এটা একটা লৌকিক রীতি। পাট অর্থে মাটির মূর্তিটি যে কাঠের পাটাতনের উপর থাকবে তাকেই বোঝানো হয়। মূল পুজো যাতে নির্বিঘ্নে হয় তাই এই আয়োজন।

পাট পুজো বা কাঠামো পুজোর পর দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় ঠাকুরের চাল তৈরির কাজ। নবদ্বীপের বারোয়ারি কমিটির সদস্যরা বহু দূর দূরান্ত থেকে ভালো বাঁশ কিনে আনেন। অত বড় বড় ঠাকুর যার ওপরে থাকবে সেই ভিত শক্ত হওয়ার দরকার। বাঁশ, দর্মা দিয়ে অতি দ্রুত সুন্দর কাঠামো তৈরি করে নিপুণ হস্ত শিল্পের পরিচয় দিয়ে থাকেন এখানকার ঘরামিরা। এরপর শুরু হয় সেই চালির উপর ঠাকুর তৈরির কাজ। অনেক দূর থেকে মৃৎশিল্পীরা নবদ্বীপে এসে ঠাকুর তৈরি করেন। এটা একটা প্রাচীন রীতি। যদিও সেই রীতিরও পরিবর্তন আসছে। শুধু আর্থিক কারণ নয়। মনের টানেই মৃৎশিল্পীরা বছরের পর বছর এখানে ছুটে আসেন।
শোনা যায়, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সময়ে কার্তিক পূর্ণিমায় যে সমস্ত মৃৎশিল্পী মাটির মূর্তি তৈরি করতেন তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মৃৎশিল্পীকে পুরস্কৃত করতেন। কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তর পুরুষ সতীশচন্দ্র পর্যন্ত এই ধারা বর্তমান ছিল। শিল্পীদের সত্ত্বার বিকাশে এ জাতীয় ভাবনা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কৃষ্ণচন্দ্রের আগে নবদ্বীপের বৈষ্ণবীয় রাসের ছবিটা কিছুটা আলাদা ছিল। ১৫৩৩ সালে চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর বৈষ্ণবীয় মঠ মন্দিরে রাস হত। সেই সময় রাসলীলার বিষয়ে পটুয়াদের দিয়ে বড় বড় পট আঁকিয়ে মঠে-মন্দিরে প্রদর্শন করা হত। তাই রাসপূর্ণিমার অন্য এক নাম ‘পট পূর্ণিমা’। সে রীতি কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকেই আর নেই।
মৃৎশিল্পীদের রূপদান সম্পন্ন হলে শোলা শিল্পীরা তাঁদের অসাধারণ শৈল্পিক ছোঁয়ায় সম্পূর্ণ করেন প্রতিমার চালচিত্র। বড়, মেজো, সেজো, ছোট শ্যামা, বিন্ধ্যবাসিনী, গৌরাঙ্গিনী, শবশিবা প্রমুখ অনেক ঠাকুরকেই যে সাজে সাজানো হয় তাকে বলা হয় ‘ডাকের সাজ’। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে কলকাতার বনেদি বাড়িগুলিতে দুর্গাপুজো বাড়তে থাকে। তখন প্রতিমার সাজ আসত সুদূর জার্মানি থেকে। ডাক মারফত সেই সাজ আসতো বলে একেই বলা হত ডাকের সাজ। এখন স্থানীয় শিল্পীদের মাধ্যমেই এই কাজ হয় তবু নামটা থেকেই গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-২: দু’ চোখ ভরে স্বপ্ন পূরণের আনন্দাশ্রু, অদূরেই যে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন

রাস পূর্ণিমার আগের দিনই নবদ্বীপের প্রায় সমস্ত প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ হয়ে যায়। অবশেষে হয় সব প্রতীক্ষার অবসান। পূর্ণিমা তিথিতে শুরু হয় পূজার্চনা। নবদ্বীপের শ্যামা, দুর্গা পুজো গুলো হয় শাক্ত রীতিতে। অন্যদিকে বিন্ধ্যবাসিনী, কৃষ্ণকালী, বিশ্বরূপ দর্শন পুজোর রীতি বৈষ্ণব। তার মধ্যে চন্ডী পুজো হয় লৌকিক রীতিতে, শৈব ও গাণপত্য রীতিতে পুজো হয় সতীর দেহত্যাগ ও বিভিন্ন গণেশ মূর্তির। তবে নবদ্বীপের বেশ কিছু শাক্ত পুজোতে এখনো পশুবলি হয়।
রাস পুজোর দিন এই শহরে এক লৌকিক রীতি দেখা যায়। প্রত্যেক বারোয়ারি কমিটি তাঁদের নিজেদের পুজোর পাশাপাশি একটা পুজো নিবেদন করেন গ্রাম্য দেবী পোড়ামাতার থানে। বাজনা বাজিয়ে ফল নৈবেদ্য সহ শোভাযাত্রা সহকারে গ্রাম্য দেবীর কাছে পুজো পাঠানো হয়। শুধু রাসোৎসবেই নয় হিন্দুদের দশবিধ সংস্কারের মধ্যে অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ ইত্যাদিতেও নবদ্বীপবাসী এই দেবীর উদ্দেশ্যে বিশেষ পুজো নিবেদন করেন। লোকমাতা কীভাবে এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন এ তার এক বড় দৃষ্টান্ত।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৪: মুশকিল ঘরে, মুশকিল বাইরে, মুশকিল বিশ্বময়!

নবদ্বীপের রাসের আরও এক অন্যতম দিক হল এর বর্ণময় শোভাযাত্রা। রাস পুজোর পরের দিনই প্রতিমাকে লোহার বল বেয়ারিং গাড়িতে ওঠানো হয়। এরপর বাজনা-সহ নবদ্বীপ প্রশাসন কর্তৃক নির্দিষ্ট পথে চক্রাকারে তাদের ঘোরানো হয়। সেদিন সারারাত ধরে চলে এই অনুষ্ঠান। তবে নবদ্বীপে যোগনাথ তলার গৌরাঙ্গিনী ও রাজার বাজারের শ্যামা প্রতিমার শোভাযাত্রা বেহারার কাঁধে করেই বের হয়।

শোভাযাত্রার পরদিন বিসর্জন। সব ঠাকুরের পুজোর ঘট বিসর্জন হয়ে যায় পুজোর পরদিনই। কিন্তু মূর্তির বিসর্জন হয় শোভাযাত্রার পরদিন। যদিও এরও ব্যতিক্রম আছে। নবদ্বীপের কিছু শ্যামা মূর্তির বিসর্জন দেওয়া হয় শোভাযাত্রার পরই, গভীর রাত্রে। সেও এক দেখবার জিনিস। লোহার বল বেয়ারিং গাড়ি থেকে কি সহজে ও সুন্দর ভাবে প্রতিমা গঙ্গা গর্ভে চলে যান।
এ ভাবেই শেষ হয় নবদ্বীপের ঐতিহ্যমন্ডিত রাসোৎসব। মাত্র একদিনের এই পুজোয় এতো আতিশয্য ও ব্যয় দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। পাশাপাশি প্রায় চার শতাধিক প্রতিমার বৈচিত্র্য অবাক করে। বর্তমানে থিম পুজোও শুরু হয়েছে। এই জন্যই হয়তো নবদ্বীপের রাস উৎসবের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী। রাস উৎসবকে সুষ্ঠ ভাবে পরিচালনার জন্য নবদ্বীপের প্রশাসন খুব বড় দায়িত্ব নেন। তবে একথাও বলা জরুরি সম্প্রতি নবীন প্রজন্মের কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা রাসের মহিমাকে কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন করছে। নারী পুরুষের প্রকাশ্যে মদ্যপান ও বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপ এই অনুষ্ঠানের মাধুর্যকে ব্যাহত করছে বলেই অনেকে মনে করেন। আমরা যদি সকলে মিলে বিষয়টি নিয়ে ভাবি তাহলে নিশ্চয় এইটুকু ত্রুটি দূর হবে।
* ড. আত্রেয়ী সিদ্ধান্ত, অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, ইন্দাস মহাবিদ্যালয়।

Skip to content