শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

গতকালের সরস্বতী পুজোর রেশ এখনও কাটেনি। আজ সকালেও ভেসে আসছে টুকরো টুকরো শাঁখের আওয়াজ, ঘণ্টাধ্বনি ও ধুপধুনোর গন্ধ। সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি, ঠিক তখনই মুঠোফোনে এল একটি বুক-খালি-করা বার্তা— সুরসম্রাজ্ঞী কোকিলকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর আর আমাদের মধ্যে নেই! করোনা আর আমাদের কত রিক্ত করবে কে জানে! গতকাল রাতের খবরেই শুনেছিলাম শিল্পীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। মাকে বলেওছিলাম বোধহয়, ‘আর মনে হচ্ছে বেশি দিন নয়!’ কিন্তু কথাটা যে পরের দিন সকালেই এমনভাবে সত্যি হয়ে যাবে ভাবিনি!

প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাগদেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির আরাধনা এখনও চলছে, কিন্তু আমার জীবন্ত সরস্বতীর অকাল বিসর্জন হয়ে গেল। আরও একবার অনুভব করলাম স্বজন বিয়োগের দুঃখ। এ এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। আমার বাবা যখন চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, প্রথমে কয়েকটা মুহূর্ত কিছুই অনুভব করতে পারিনি। কীরকম যেন অসাড় একটা অনুভূতি ছিল সেটা। কিন্তু তার পরেই গ্রাস করেছিল এক অসীম অতল শূন্যতা। ঠিক একই অনুভূতির পুনরাবৃত্তি ঘটল আজ সকালে, লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণ সংবাদ শুনে।

চোখের সামনে ফুটে উঠছিল কত স্মৃতি, কানে ভেসে আসছিল টুকরো টুকরো গানের কলি। আমার ছোট-বড় সকল বেলার নেপথ্যে তো একজনেরই গান বেজে চলেছে। তাঁর কণ্ঠ হয়তো আজ স্তব্ধ হয়ে গেল, কিন্তু আমার চেতনায় তো তাঁর কণ্ঠ অমর। আমার ছোট্ট ‘ওয়াকম্যান’টা পাশে নিয়ে রাতের আকাশের নীচে মগ্ন হয়ে শুনতাম ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই শিকওয়া তো নেহি’ কিংবা ‘রেয়না বিতি যায়ে’ অথবা ‘হামনে দেখি হ্যায় উন আখোঁ কি মেহেকতি খুশবু’। প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় শুনেছি ‘আপ কি আখোঁ নে সামঝা পেয়ার কে কাবিল মুঝে’, ‘তেরে বিনা জিয়া যায়ে না’, ‘লগ জা গলে কে ফির ইয়ে হাসিন রাত হো না হো’, ‘ইয়ে কাহান আ গয়ে হম’। আমার মনে আছে ‘উও চুপ রহে তো মেরে দিল কে দাগ জ্বলতে হ্যায়’ শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ‘আজ সোচা তো আঁসু ভর আয়ে, মুদ্দতে হো গই মুস্কুরায়ে’ আজও আমার চোখে জলের ধারা আনে। ‘নয়নো মে বদরা ছায়ে’, ‘মোহব্বত কি ঝুঠি কাহানি পে রোয়ে’ কিংবা ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’— এই গানগুলো যে কতবার শুনেছি তার হিসেব নেই।

ঝমঝমে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আজও শুনি ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন, ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তোমাকে আমার মনে পড়েছে’। ‘না যেও না, রজনী এখনও বাকি’ শুনেছিলাম দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে— তখন বোধহয় চতুর্থ শ্রেণি, আর ‘ও সজনা বরখা বাহার আয়ি’ শুনেছিলাম আরও অনেক পরে, কিছুতেই ঠিক করতে পারিনি কোনটা বেশি ভালো। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ শুনে আমার মতো গায়ে কাঁটা দেয়নি এমন বাঙালি বোধহয় খুব কমই আছে! ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে’ শুনে রূপকথার জগতে যে কতবার ভেসে গিয়েছি, তার হিসেব নেই। আমার জীবনের এক একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এই গানগুলো। প্রায় প্রত্যেক গানের সঙ্গেই জড়িয়ে কত স্মৃতি।

‘আজ ফির জিনে কি তমন্না হ্যায়’ শুনলে আবার নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগে। ‘আল্লাহ তেরো নাম ঈশ্বর তেরো নাম’ চির সম্প্রীতির জয়গান গায়। ‘বন্দে মাতরম’ অথবা ‘মেরে ওয়াতন কে লোগো’ শুনলে মনে হয় যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে তবে তা যেন এই দেশেই হয়!

আজ সকালে লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুসংবাদ শুনে যে গভীর শূন্যতা বোধ করছিলাম, লেখাটা লিখতে লিখতে অনুভব করলাম শূন্যতাটা একটু একটু করে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। যতদিন ওঁর সৃষ্ট সংগীত থাকবে, ততদিন উনি আছেন, উনি থাকবেন। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন জুড়ে উনি আছেন, উনি থাকবেন। ‘ আওয়াজ নাম গুম জায়েগা, চেহেরা ইয়ে বদল যায়েগা, মেরি হি পেহচান হ্যায় গর ইয়াদ রহে!’ আমার সরস্বতী মা— তুঝে সালাম।

Skip to content