রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


মাসি যেমন সুন্দর বাংলা বলতেন, তেমনই সুন্দর ইংরিজি। আর আগ্রার প্রভাবে হিন্দি তো প্রায় মাতৃভাষা। দিল্লি থেকে জাতীয় কার্যক্রমে সেই সময়ের ‘ঘরানা অউর পরম্পরা’ অনুষ্ঠানে মাসিকে দেখে খুব ভালো লাগতো। বেশ কয়েকবার অনেক গুণী শিল্পীর সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা দেখেছি। ওঁর বাচনরীতি আমায় সেই বয়সেই খুব টানত।

এতটা সফল মানুষ যাঁর অমন সহজ ভঙ্গিতে ‘মানুষকে আপন করে নেওয়া’, তখন সেটা না ভাবালেও এখন যেন আমাকে কিছুটা অবাকই করে। এখন নামি-দামি মানুষের আচার-ব্যবহারই যেখানে দস্তুর — সাধারণের উপস্থিতি, অপেক্ষা বা সময়ের মূল্য দেওয়াটাই যখন অস্বাভাবিক, তখন এমন একজন বিশিষ্ট মানুষের এতো অমায়িক ব্যবহার! আশপাশের সকলের জন্যে এতটা গুরুত্ব কী করে দিতেন তিনি!
এমনও হয়েছে যে, কোন এক রবিবার হয়ত উনি থাকবেন না। এখনকার মতো হাতে-হাতে মোবাইল ছিল না আর আমাকে ফোনে জানাবার সুযোগও ছিল না। পাছে গিয়ে ফিরে আসি সেক্ষেত্রে সর্বদা নিজে আগে থেকেই চিঠি লিখে জানাতেন চন্দ্রাণী অমুক তারিখ আমি ডেলহি (দিল্লি) যাচ্ছি… অমুক তারিখে ফিরবো।

— ইতি মাসি।
এতটা স্নেহ ও কর্তব্যবোধ বোধ হয় এ যুগে বিরল।
আরও পড়ুন:

ফেলে আসা স্মৃতি: সুরসম্রাজ্ঞী দীপালি নাগ, পর্ব-৩: সেই প্রথম হল শোনা ‘আমার মনের বেদনা’

রিভিউ: জুটির প্রত্যাবর্তন, মনের জটিলতা নিয়ে সহজ প্রেমের গল্প কিয়ারা-কার্তিকের ‘সত্যপ্রেম কি কথা’

আর খুব ভালো লাগত বাড়িঘেরা বড় বাগানটা। বাড়ির সদর দরজা, সিঁড়ি থেকে সবুজ বাগানের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় গেট পর্যন্ত লম্বা কংক্রিটের রাস্তা। মনে পড়ছে এক শীতের সকালে সেই বাগানে বনভোজনের কথা…।

সেদিন আমার মতো একের পর এক অনেক ছাত্রী এসেছিল। গানঘরের পুরোটাই প্রায় ভরে গিয়েছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল মজার খেলা। এক সুন্দর পাত্রে একসঙ্গে রাখা সাদা কাগজে মোড়ানো ছোট ছোট অনেক চিরকুট। তাতে লেখা ছিল বিভিন্ন হিন্দি বাংলা সিনেমার নাম। নানা রাগ নানা তাল ইত্যাদি। যার হাতে যে চিরকুট উঠছে তাকে সেই গান করতে হচ্ছে।

একের পর এক সব চিরকুট অনুযায়ী কেউ কেউ গাইলো সিলসিলার গান। কেউ-বা ‘এক দুজেকে লিয়ে’র দু-এক লাইন। বেশ মজা লাগছে। রাগসঙ্গীত শেখানো হয় কিন্তু পিকনিকের দিন গানের কোন বাদ-বিচার নেই। ভাবছি আমার কপালে কী আছে? দেখলাম লেখা আছে ‘কাহারবা তাল’। বুঝলাম কাহারবা তালের কোন একটা গান গাইতে হবে। চার চার আট মাত্রা। ধাগে নাতি নাগে ধিনা। গাইলাম মীরাবাঈ-এর ভজন।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

আর সেই কাহারবা তালে মাসি আমার সাথে তবলা বাজিয়েছিলেন। এখন ভাবলে অবাক লাগে তবে এটা নতুন কিছু ছিল না। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গানের সঙ্গে তবলা বাজাতেন মাসি নিজে। আজ এসব আমার কাছে স্বপ্নের মতো…।

এই খেলা চলার কিছুক্ষণের মধ্যে এক অবাক করা মুহূর্ত। গানঘরের লাগোয়া সাজানো ঘরটিতে দু’জন মহিলা এসে বসলেন। একবার তাকিয়েই তাদের চিনতে একমুহূর্ত সময় লাগলো না আমার। সরলমনে আনন্দে বলেই ফেললাম—

— আপনারাই তো আমার বড়িশা অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনের রাগপ্রধান গানের জাজ ছিলেন।

আসলে বয়স অল্প থাকলে কে কী ভাববেন এসব ভয়ডর থাকে না। তাই কোন সংকোচও থাকে না। বুঝতে ভুল হয়নি যে ওঁরা মাসির দুই সিনিয়র ছাত্রী। নামও বেশ স্পষ্ট মাথায় আছে— ইলা মণ্ডল আর পুতুল দত্ত।

ওঁরা দুজনেই হাসলেন। বললেন—
— তুমি বুঝি এখন দিদির কাছে গান শিখছো?

(বাঁ দিকে) পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে কথোপকথনে শ্রীমতি দীপালি নাগ। দীপালি নাগের অন্যতম শিক্ষাগুরু উস্তাদ ফৈয়াজ খান (বাঁ দিক)। ছবি: সংগৃহীত।

এতদিন বাদে স্মৃতির টুকরোদের জুড়তে বসে মনে পড়ে গেল সেই ফিরতি পথে রেজাল্ট জানার কথা। খেয়ালের কম্পিটিশান আগেই হয়েছিল। সেদিন সকালে রাগপ্রধানের কম্পিটিশনের শেষে মা-বাবা আর আমি শীলপাড়ায় এক মাসির বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেই মেসোমণির রাগপ্রধানের রেজাল্ট জেনে আসার কথা ছিল।

বিকেলে আমরা যে মিনিবাসে ছিলাম— এই জাজ দু’জন সেই মিনিবাসেই উঠেছিলেন। ওঁদের দেখে মা একটু দোনোমোনো করে জিজ্ঞেস করেছিলেন সকালের কম্পিটিশনের রেজাল্ট কি বেরিয়েছে? আমাকে ওঁরা দেখেননি। মা’র কাছে নাম জানতে চেয়েছিলেন। নামটা শুনেই মিনিবাসেই জানিয়েছিলেন আমি রাগপ্রধানে ফার্স্ট হয়েছি।

আসলে জীবন বোধহয় এরকমই। যেখানে অনেক সাম্প্রতিক ঘটনা মন থেকে ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু বহু পুরনো কথা যা স্মৃতির কোটরে আজীবন থেকে যায়। তাই বোধহয় স্মৃতি সততই সুখের। খেলা শেষ। শুরু হল খাওয়ার পালা। আমরা ছোটবড় সবাই একসাথে হইহই করে চলে এলাম নিচের বাগানে। —চলবে।
* লেখিকা চন্দ্রাণী সরকারের ভালোবাসা গান, সংসার, বেড়ানো, ভ্রমণকথা লেখা।

Skip to content