শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বাঁ হাত ভাঁজ করে চিবুকের কাছে ধরে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে কয়েক মূহুর্ত আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর উনি আমাকে হারমোনিয়ামে সা এবং পা রিড ধরে সপ্তস্বর গলায় লাগাতে বললেন। আমি সরগম শোনালাম। তারপর আমার পছন্দের যেকোনও রাগের আরোহ অবরোহ শুনতে চাইলেন।

আরোহ অবরোহ হল রাগের আরোহণ এবং অবরোহণ। উপরে ওঠা আর উপর থেকে নামা। সঙ্গীতের পরিভাষায় নিচের স্বর থেকে উপরের দিকে গেয়ে বা বাজিয়ে গেলে সেই ক্রিয়াকে আরোহণ বলে। রাগ অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্বরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া। আবার নেমে আসা হল অবরোহণ।
আমি রাগ পূরবী শোনালাম। খুব সচেতন ছিলাম। যাতে কোনও ভুলচুক না হয়। ভারতীয় রাগ সঙ্গীত অঙ্কের মতো, তার নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও ফর্মুলা আছে। সব রাগে সাতসুর লাগে না। কোনও কোনও রাগে ছয়টি বা পাঁচটি স্বরও লাগে। আর যে যে স্বরে আরোহণ— সেই ভাবেই অবরোহণ নাও হতে পারে। স্বরের কড়ি বা কোমলের ব্যবহার হয়ে থাকে। রাগ পূরবীর আরোহ-অবরোহেও তেমন আছে।

আমি গান শোনালাম। উনি চোখ বুজিয়ে ছিলেন। তারপর তাকালেন। মা ওঁর কাছে জানতে চাইলেন যে আমি ঠিকঠাক পেরেছি কিনা। উনি জানালেন—
—হ্যাঁ, যাঁর কাছে ও এতদিন শিখছে তা সঠিক। তবে কি মা জানো তো যে, ধ্রুপদী গানে নিয়মিত অভ্যাস কতটা জরুরি?
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র, পর্ব-১: প্রায় ৪২ বছর আগেকার কথা, আমি তখন ফ্রক পরা স্কুলের মেয়ে

রিভিউ: ‘ঘুমর’ আসলে জীবনকে ফিরে পাওয়ার গল্প

এই কথাবার্তার ফাঁকে হঠাৎই চোখ পড়লো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে উনি দাঁড়িয়ে। একই সঙ্গে দুজনের সাদাকালো ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে। এভাবেই মাসির (দীপালি নাগ) সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়। আমার মতো স্কুল পড়ুয়ারা ওঁকে মাসি বলেই ডাকতাম।

প্রথম সাক্ষাতের পর পরের সপ্তাহের রবিবার। গান শেখার প্রথম দিন। সেই সে দিনের গানঘরে এসে বসলাম। আর বাবা বসলেন গানঘর লাগোয়া সুন্দর ঘরটিতে। শেখানোর শুরুতেই রাগপ্রধান গান নিয়ে লেখা ওঁর একটি বই আমাকে দিলেন, যা আমার কাছে সারাজীবন এক বহুমূল্য রত্ন হয়ে থেকে যাবে।

পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা ও অন্যান্য গুণীজন সান্নিধ্যে শ্রীমতী দীপালি নাগ। ছবি: সংগৃহীত।

আজ এতবছর পেরিয়ে এসে নানান ব্যস্ততায় বা কখনও নিছক অলসতার কারণেও হারমোনিয়াম নিয়ে হয়তো নিয়মিত বসা হয় না। কিন্তু একা একা অনেক সময় আমার গানের পুরোনো খাতা নাড়াচাড়া করতে করতে মাসির দেওয়া সেই বহু পুরোনো হয়ে যাওয়া বইটা সাবধানে খুলি। মাসির হাতে “চন্দ্রাণীকে” লেখার ওপরে আলতো আঙুল বোলাতে বোলাতে ভাবি সত্যিই শ্রীমতি দীপালি নাগের কাছে সরাসরি গান শেখার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল আমার? শুধু আমার নামটুকু লেখা— পোশাকি রীতি মেনে অটোগ্রাফের বালাই নেই। ব্যবহারেও অমন ঘরোয়া। নিরুচ্চার।
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-৫: ঈশ্বরের আনন্দ ও সংসার—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

সেদিন কিশোরী বয়সে সেই সৌভাগ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করিনি। আজ বুঝতে পারি। তবে এটাও ভাবি যে সেদিন বুঝিনি বলেই খুব সহজভাবে তাঁর মাপের সঙ্গীতগুরুর পায়ের কাছে বসে হয়তো সামান্য হলেও কিছুটা শিখতে পেরেছিলাম।

গান শেখার মাঝেই এলো শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক সবার জন্য মিষ্টি সিঙ্গাড়া নিমকি সঙ্গে চা। এ শুধু প্রথম দিনই নয় শেখার সঙ্গে খাওয়া চলতো প্রতি সপ্তাহেই। গুনে এবং মনে এমন মানীমানুষ আমি খুব বড় একটা দেখিনি। এখন লিখতে বসে অগোছালো ভাবে কত কত ছোট ছোট ঘটনা মুহূর্তেরা স্মৃতিতে ঘোরাফেরা করছে।
আরও পড়ুন:

সব লেখাই বিজ্ঞানের, শব্দদূষণ প্রতিরোধ করবে এই গ্রিন মাফলার, জানতেন?

যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…,

আমার মায়ের গানবাজনার সঙ্গে আরেক শখ ছিল নানারকম খাবার বানানো। খাওয়াতেও বেশ ভালোবাসতেন। মায়ের বানানো কেক আমি একদিন মাসির জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। পরের সপ্তাহে যখন গান শিখতে গেলাম গানঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই, মাসি বাবাকে বলে উঠলেন, মিস্টার দাস চন্দ্রাণীর মাকে বলবেন যে ড. নাগচৌধুরী কেক খেয়ে অত্যন্ত প্রশংসা করেছেন।

মাসির সহস্ত শুভেচ্ছা। লেখিকার নিজস্ব সংগ্রহ থেকে।

ড. নাগচৌধুরী মানে সঙ্গীতপ্রজ্ঞা শ্রীমতি দীপালি নাগের স্বামী, দেশের প্রথিতযশা পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানী, ভারত সরকারের বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা, এদেশের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স গবেষণার অন্যতম আদিপুরুষ, দেশে সাইক্লোট্রোন যন্ত্র প্রথম তৈরি করার বিরল প্রতিভা, প্ল্যানিং কমিশনের বিশিষ্ট সদস্য দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণপ্রাপ্ত ড. বাসন্তী দুলাল নাগচৌধুরী।

এরকমই শীতকালে আমরা একবার উল নিয়ে গিয়েছিলাম। হাতে দেওয়া মাত্র ছোট্ট শিশুর মত বলে উঠলেন, বাহ! উল! কি ভেবেছ? আমি কিন্তু বুনতেও জানি। ডেলহি (দিল্লি) যাবার সময় ফ্লাইটে বুনতে বুনতে চলে যাব।—চলবে।
* লেখিকা চন্দ্রাণী সরকারের ভালোবাসা গান, সংসার, বেড়ানো, ভ্রমণকথা লেখা।

Skip to content