মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


কাজী নজরুল ইসলাম যে কয়েকটি নারী জাগরণের গান বেঁধেছেন, বাংলা সাহিত্যে ও সংগীতে তা অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়ে যাবে। নারীর আত্মশক্তিতে বিকশিত হবার মন্ত্রে পরিপূর্ণ গানগুলি অনন্য অনুপ্রেরণা হয়ে আজীবন থেকে যাবে, তার অন্যতম কারণ গানগুলি আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নজরুল তাঁর ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন— ”বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।” তিনি বিশ্বাস করতেন— ”সেদিন সুদূর নয় —/ যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।”

ফলে, কবিতার পাশাপাশি তাঁর গানেও তিনি মুক্তকণ্ঠে নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন—
জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা।
জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা।।
দিকে দিকে মেলি’ তব লেলিহান রসনা,
নেচে চল উন্মাদিনী দিগ্‌বসনা,
জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী,
বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।।
ধূ ধূ জ্ব’লে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি,
জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী!
পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা
জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা,
মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালা
চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।।


নজরুল বলেছেন, নারীর মধ্যে শক্তির অফুরান সম্ভাবনা অন্তর্নিহিত রয়েছে। নজরুল তাঁর নারী জাগরণের গানগুলির মাধ্যমে সেই নারী শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। মনে পড়ে, তুরস্ক থেকে তুরস্কের নারী জাগরণের অগ্রদূতী খালিদা এদিব হানুম-এর কারমাইকেল হস্টেলে আগমন উপলক্ষে নজরুল লিখেছিলেন–
গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়
রূপে লাবণ্যে মাধুরী ও শ্রীতে হুরী-পরী লাজ পায়।।
নর নহে, নারী ইসলাম ‘পরে প্রথম আনে ঈমান
আম্মা খাদিজা জগতে সর্ব প্রথম মুসলমান।
পুরুষের সব গৌরব ম্লান এক এই মহিমায়।।
নবী-নন্দিনী ফাতেমা মোদের সতী-নারীদের রানী
যাঁর গুণ-গাথা ঘরে ঘরে প্রতি নর-নারী আজো গায়।।

রহিমার মত মহিমা কাহার তাঁর সম সতী কেবা
নারী নয় যেন মূর্তি ধরিয়া এসেছিল পতি-সেবা
মোদের খাওয়ালা জতের আলা বীরত্বে গরিমায়।।
রাজ্য শাসনে রিজিয়ার নাম ইতিহাসে অক্ষয়
শৌর্যে সাহসে চাঁদ-সুলতানা বিশ্বের বিস্ময়
জেবুন্নেসার তুলনা কোথায়,জ্ঞানের তপস্যায়।।
আঁধার হেরেমে বন্দিনী হল সহসা আলোর মেয়ে
সেইদিন হতে ইসলাম গেল গ্লানির কালিতে ছেয়ে।
লক্ষ খালেদ আসিবে যদি এ নারীরা মুক্তি পায়।।


আবার, মিস্ ফজিলাতুন্নোসার বিদেশ যাত্রা উপলক্ষে নজরুল গেয়েছিলেন সেই অপূর্ব গান—
জাগিলে ‘পারুল’ কি গো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে।
উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে॥
চলিলে সাগর ঘুরে
অলকার মায়ার পুরে,
ফোটে ফুল নিত্য যথায়
জীবনের ফুল্ল-শাখে॥
আঁধারের বাতায়নে চাহে সাজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা, টুটে ওই বন্ধ কারা।
থেকো না স্বর্গে ভুলে
এ পারের মর্ত্য কূলে,
ভিড়ায়ো সোনার তরি
আবার এই নদীর বাঁকে॥


নজরুল বারবার তাঁর কবিতায় তাঁর গানে বলেছেন, নারী কখনওই অবলা নয়। কোনও কোনও গানে তিনি সমকালীন নারীদের অনুপ্রেরণা জোগাতে অতীতের নারীদের জীবন উদ্ধৃত করেছেন, যেমন–
কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া
আসিলে আলোক-জননি।
প্রভায় তোমার উদিল প্রভাত
হেম-প্রভ হল ধরণি॥
ভগ্ন দুর্গে ঘুমায়ে রক্ষী
এলে কি মা তাই বিজয়-লক্ষ্মী,
‘মেয়্ ভুখা হুঁ’-র ক্রন্দন-রবে
নাচায়ে তুলিলে ধমনি ॥
এসো বাংলার চাঁদ-সুলতানা
বীর-মাতা বীর-জায়া গো॥
তোমাতে পড়েছে সকল কালের
বীর-নারীদের ছায়া গো॥
শিব-সাথে সতী শিবানী সাজিয়া
ফিরিছ শ্মশানে জীবন মাগিয়া,
তব আগমনে নব-বাংলার
কাটুক আঁধার রজনি॥


নজরুল তাঁর গানে নারীদের পরমা শক্তির আধাররূপে কল্পনা করে তাদের প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন, তাই তিনি লিখেছেন—
চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা, চাঁদের চেয়েও জ্যোতি।
তুমি দেখাইলে মহিমান্বিতা নারী কী শক্তিমতী।।
শিখালে কাঁকন চুড়ি পরিয়াও নারী,
ধরিতে পারে যে উদ্ধত তরবারি,
না রহিত অবরোধের দুর্গ, হতো না এ দুর্গতি।।
তুমি দেখালে নারীর শক্তি স্বরূপ–চিন্ময়ী কল্যাণী,
ভারত জয়ীর দর্প নাশিয়া মুছালে নারীর গ্লানি।
তুমি গোলকুণ্ডার কোহিনূর হীরা সম
আজো ইতিহাসে জ্বলিতেছে নিরুপম,
রণরঙ্গিণী ফিরে এসো,
তুমি ফিরিয়া আসিলে, ফিরিয়া আসিবে লক্ষ্মী ও সরস্বতী।।


নজরুল তাঁর কবিতায় যে নারীর ছবি এঁকেছেন, সেই ছবি তাঁর গানেও প্রতিফলিত হয়েছে—নারীর অধিকারের পক্ষে তাঁর কণ্ঠ বারবার গর্জে উঠেছে—নজরুল অবিরত নারী সমাজকে দৃপ্তকণ্ঠে সচেতন হওয়ার বাণী শুনিয়েছেন। তাঁর গানগুলি পড়লে (শুনলে তো বটেই) আজও শিহরিত হতে হয়। তবে একটি প্রশ্ন অবধারিতভাবে মনে জাগে, নজরুলের প্রগতিশীল চিন্তন আমাদের জীবনে কি কোনও ছাপ ফেলতে পেরেছে? সময় তার জবাব দেবে।

Skip to content