কবি জীবনানন্দ দাশ। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
জীবনের বর্ণাঢ্য বরণীয়তা পাশে সরিয়ে রেখে আমরা যখন সাহিত্যেও বুঁদ হয়ে ছিলাম সংস্কারগত বর্ণাশ্রমে, সেই চরম শৌখিনতার পাশে চুপি চুপি একা এক অনন্যবোধে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, কবি জীবনানন্দ দাশ, সোনালি ডানার প্রগাঢ়পথিক এক—
“এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় না কো আর”!
তাঁর সে প্রায় অনুচ্চারিত অথচ অনস্বীকার্য আগমনে গোলাপ-জাতী-যূথির বাঁধন কেটে কোকিলা-ময়ূরী-ময়না
-বুলবুলির মিঠেতান দূরে সরিয়ে জানা হল, কবিতার জন্য এমনকি ইঁদুর-ব্যাঙও অপাংক্তেয় নয়। ফুল-চাঁদের সিদ্ধমহিমা সপাটে উজাড় করে মন দুলল—
“বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে / চমৎকার, ধরা যাক দুয়েকটা ইঁদুর এবার”!
আসলে বিষয়ের গৌরবে নয়, কবিতার চিত্তচাহনির সোনার কাঠিটি নিহিত মূলত তার অভিব্যক্তিতে— এই বোধের শুভ জন্মদিন বুঝি তাঁর কলমেই চিনল বাংলা কবিতার জগৎ—
“একদিন কোনো এক আঞ্জির গাছের ডালে
সকালের রোদের ভিতর
সোনালি সবুজ এক ডোরাকাটা রাক্ষুসে মাকড়কে আমি
একটি মিহিন সুতো নিয়ে দুলে নির্জন বাতাসে
দেখেছি স্বর্গের থেকে পৃথিবীর দিকে এল নেমে,
পৃথিবীর থেকে ক্রমে চলে গেল নরকের পানে ;
হয়তো সে ঊর্ণনাভ নয়,
অগস্ত্যের মতো নানা আয়ুর সন্ধানে
চোখে তার লেগেছিল ব্রহ্মার বিস্ময়”
তাঁর সে প্রায় অনুচ্চারিত অথচ অনস্বীকার্য আগমনে গোলাপ-জাতী-যূথির বাঁধন কেটে কোকিলা-ময়ূরী-ময়না
-বুলবুলির মিঠেতান দূরে সরিয়ে জানা হল, কবিতার জন্য এমনকি ইঁদুর-ব্যাঙও অপাংক্তেয় নয়। ফুল-চাঁদের সিদ্ধমহিমা সপাটে উজাড় করে মন দুলল—
আসলে বিষয়ের গৌরবে নয়, কবিতার চিত্তচাহনির সোনার কাঠিটি নিহিত মূলত তার অভিব্যক্তিতে— এই বোধের শুভ জন্মদিন বুঝি তাঁর কলমেই চিনল বাংলা কবিতার জগৎ—
সকালের রোদের ভিতর
সোনালি সবুজ এক ডোরাকাটা রাক্ষুসে মাকড়কে আমি
একটি মিহিন সুতো নিয়ে দুলে নির্জন বাতাসে
দেখেছি স্বর্গের থেকে পৃথিবীর দিকে এল নেমে,
পৃথিবীর থেকে ক্রমে চলে গেল নরকের পানে ;
হয়তো সে ঊর্ণনাভ নয়,
অগস্ত্যের মতো নানা আয়ুর সন্ধানে
চোখে তার লেগেছিল ব্রহ্মার বিস্ময়”
"হয়তো মানুষ নয়, হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে..."
ধানসিড়ির চিত্রঋণ : নওয়াজেশ আহমেদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
বাস্তবিক, কবিতার সোনার তরীতে এত দিনের ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ আর্তস্বর চমকে জানল— ‘আছে আছে স্থান’। জোনাকি, বোলতা,শ্যামাপোকা,কাঁচপোকা, পিঁপড়ে, নীলমাছি, মশার মৃদুগুঞ্জন বা বাটা, সরপুঁটি চাঁদামাছ থেকে কেউটে, শঙ্খচূড়ের হিসহিসানি পেরিয়ে কবিতার ঊর্ধবাহু নাগালে পেয়েছে বেবুন-উট-বেজি-বিড়াল-গাধা-গরু-বানর-ম্যামথ- ডাইনোসরদের পর্যন্ত। এককোষী অ্যামিবাও সেখানে ব্রাত্য নয়! বস্তুত জীবনানন্দের এই তথাকথিত ‘অনভিজাত’ প্রকৃতিপ্রেমের চলনটি কোথাও যেন ‘পথের কবি’ বিভূতিভূষণের সঙ্গে একাকার। বাংলাকাব্যে আর কথাসাহিত্যে এই অনন্যপূর্ব যুগলবন্দিও আমাদের স্বীকার্য বৈকি!
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এককথায় দেগে দিয়েছিলেন— ‘চিত্ররূপময়’। সে রূপময়তাতেই অধিকাংশ পাঠকমন আটকে রইল এ যাবৎ। রূপসীবাংলার অপরূপ খোয়াবনামা খসিয়ে এই নির্জনতম কবি-পৃথিবীর রূপ দেখতে যাওয়া হল কই আর তেমন করে?
অথচ দু’ পা গেলেই জানা হত—
“পরের ক্ষেতের ধান মই দিয়ে নক্ষত্র লাগানো সুকঠিন নয় আজ”
কিংবা
“নিরাশার খাতে ততোধিক লোক উৎসাহ বাঁচায়ে রেখেছে” —এর মতো অমোঘ বোধবিকীরণকে।
ছোট্ট একটি পেরেক তবু অবসরহীন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়—“সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”!
হয়তো তাই রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যভাষার সবচেয়ে বেশি আলোড়িত অথচ সবচেয়ে কম সম্পূর্ণতায় আলোচিত কবির জন্মদিনটিতে বেদনার তারে মীড় দেয় তাঁরই নিঃশ্বাসচাপা অনুভব—“কালি আর কলমের পর বসে আছে সিংহাসনে—কবি নয়—অজর অক্ষর অধ্যাপক”;
সত্যিই, কবিতা বুঝবার নয় যে, বাজবার! হায় চিল!
“তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে”!
জন্মদিনের প্রণাম।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এককথায় দেগে দিয়েছিলেন— ‘চিত্ররূপময়’। সে রূপময়তাতেই অধিকাংশ পাঠকমন আটকে রইল এ যাবৎ। রূপসীবাংলার অপরূপ খোয়াবনামা খসিয়ে এই নির্জনতম কবি-পৃথিবীর রূপ দেখতে যাওয়া হল কই আর তেমন করে?
অথচ দু’ পা গেলেই জানা হত—
ছোট্ট একটি পেরেক তবু অবসরহীন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়—“সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”!
হয়তো তাই রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যভাষার সবচেয়ে বেশি আলোড়িত অথচ সবচেয়ে কম সম্পূর্ণতায় আলোচিত কবির জন্মদিনটিতে বেদনার তারে মীড় দেয় তাঁরই নিঃশ্বাসচাপা অনুভব—“কালি আর কলমের পর বসে আছে সিংহাসনে—কবি নয়—অজর অক্ষর অধ্যাপক”;
সত্যিই, কবিতা বুঝবার নয় যে, বাজবার! হায় চিল!
জন্মদিনের প্রণাম।