শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ভাষা দিবস পালনের প্রস্তুতি। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

আমাদের মফস্বলি ছেলেবেলায় একুশে ফেব্রুয়ারির মাতামাতি ছিল না কোথাও। হ্যাঁ, সচেতনেই উচ্চারণে আনলাম শব্দটা— ‘মাতামাতি’! এখন তো জামায়-শাড়িতে, বিশেষ বিজ্ঞাপনী দেখনদারিতে ভাষাদিবস চাকচিক্যে ঠাসা।সে চকমকির কোথায় যে আগুন, তা জানে হাতেগোনা কয়জনা, জানা নেই, তবে এও একরকমে বেশ ! অন্তত বছরে একবার করে মায়ের ভাষার মর্যাদার কথাটা মনে পড়ে তো আমাদের অধিকাংশ উত্তর প্রজন্মের।

যা বলছিলাম,—ভাষার জন্য, বিশেষত নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান ‘দেখানোর’ জন্য কখনও গোটা একটা দিন সরিয়ে রাখা যায়, সে দিনটাতে অশ্রুরুদ্ধ পুষ্পস্তবক হয়ে ওঠা যায় বুকের রক্তদোলায়— জানত না আমার অবোধ শৈশব-কৈশোর। এমনকী বিচিত্র ভাষাভাষী আমার এই স্বদেশের পথে প্রান্তরে কালেভদ্রে বেড়াতে গেলেও নিজের বুলিটিই চালনা করার চেষ্টা করেছি সেসব দিনে; তাতে ভাবগত আদানপ্রদানের কাজটি যথাযথ চলুক না চলুক, অন্তত চুপ করিয়ে তো দেয়নি কেউ! কিন্তু আমার পাশের দেশটাতে? বলা ভালো বাড়ির পাশে ওই আরশিনগরটিতে? সেখানে যে কী রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে আমারই মাতৃভাষাতুতো ভাইবোনেরা ছিনিয়ে এনেছেন মায়ের বুলির মর্যাদা-মান!
কিচ্ছুই জানা ছিল না এ মুখ্যু মফস্বলির।

আর তাই, নব্বই দশকের শান্তিনিকেতনে প্রথম ছাত্রীদশার দিনে—
‘আপা, কাল কী করছেন আপনেরা?’—বিভাগে নতুন আসা অনুজার এমত প্রশ্নে একটু অবাকই হয়েছিলাম মনে পড়ে। চমকে উঠে ভাবনা এসেছিল, কাল? কাল কি কোনও বিশেষ দিন? ছাত্রী আবাসের কারুর না কি বিভাগের কারুর জন্মদিন? আমার বোবাচোখে তাকিয়ে সে মেয়ে কী যে বুঝেছিল জানি না তবে আলতো করে ছুঁয়েছিল আমার আঙুল আর অস্ফুটে বলেছিল, ‘তৈরি থাকবেন, খুব ভোরে আসব শ্রীসদনের সামনে’।

তৈরি আর কী! সাদা শাড়িটা আরও একটু আগে আগে পরে নিয়ে চিরকেলে ছটফটানো উচাটনে পায়ে পায়ে চৈত্যে-র সামনে দাঁড়ানো! পাঠভবনের কচিরা তখনও সূর্য জাগানোর গান ধরেনি সেদিন। কেবল ‘ওঁ পিতা নোহসি শুনতে প্রস্তুতি নিচ্ছে গৌরপ্রাঙ্গণের ছায়াতরুর দল। আমের মঞ্জরীর মিঠে ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কানে বাজল শালবীথি ধরে আবছা এগিয়ে আসা নরম কিন্তু তীব্র একটা সুর, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি!’—
নাঃ, শান্তিনিকেতনের আগে এই দিনটা আমার জীবনের কোথাও অন্তত ছিল না।আমাদের এপারে মুখের ভাষাকে তো কখনও থেমে যেতে হয়নি আচমকা। বাড়িতে বড়রা নিজেদের মধ্যে পুববাংলার নিজের নিজের জেলার ভাষায় আর সামাজিকভাবে মান্যচলিত বাংলাভাষায় কথা বলতেন দেখেই বেড়ে উঠেছি। ওই ‘নিজের’ ভাষাটা বলার সময়ে তাঁদের মুখের আলোটুকুও নজর করেছি, কিন্তু ওই পর্যন্তই। সে ভাষাকে বলার জন্য এমন আত্মাহূতির কাহিনি তো জানা ছিল না?!

নিজের একান্ত আগ্রহে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী হয়ে পড়তে এসে, যেখানে সমগ্র বিশ্ব নীড় খুঁজে পায় তার রাঙামাটিতে দাঁড়িয়ে সেদিন আপাদমস্তক রাঙা হয়েছিল এই মূর্খ কালোমেয়ে।ওই আবেগমথিত ভালোবাসার পিছন পিছন কলাভবন-সংগীতভবন হয়ে আশ্রম পরিক্রমার মাঝেই বিদ্যুৎ চমকের মতো বুঝতে পেরেছিলাম কেন এই বাংলায় এতদিন থাকা, পড়াশোনা- কাজকারবার করার পরেও ওপারের একদা ভিটেমাটি হারানো মানুষেরা নিজেদের ক্রমবিলীয়মান বৃত্তে ওপারের বুলি ব্যবহার করে এত আনন্দ পান!
“কইতো যাহা আমার দাদায়/ কইছে তাহা আমার বাবায়/ এহন, কও দেহি ভাই, মোর মুখে কি অইন্য ভাষা শোভা পায়?”

আজকের প্রজন্ম একুশের উদযাপন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। দুদিন আগে থেকেই জামাকাপড়ের বর্ণপরিচয়ে বা দিবসপালনের পরিকল্পনায় তাদের সংবেদনশীল মনগুলো উপচে ওঠে আবেগে। সালাম- বরকত-রফিক-শফিউর- জব্বারদের ইতিকথায় আজ দশমশ্রেণির রচনাবইও জ্বলজ্বলে। এমনকী বাহান্নর ঢাকার পরে একষট্টির বরাক আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের কথাও অজানা নেই নন্দনচত্বরবিলাসীদের।তবু, কোথাও যেন ওই এপার-ওপার একাকার করা ছোট্ট প্রভাতফেরীর দলটার অভাব বাজে বুকে। কেবলমাত্র একটি দিনের স্মরণসভার মতো দায়সারা কর্তব্যবোধে নয়, সারাজীবন ধরে তার চর্চা রাখা দীপ্তমননে আর শুদ্ধপ্রয়োগে, বিশেষত আমার মায়ের ভাষাকে সম্মান করার পাশাপাশি অন্যের মাতৃভাষার প্রতিও যথাযথ সম্মান রাখা–এসব গভীরতায় ডোবে কই আমার চেয়ে কয়েক যোজন বেশি আলোকময় আমার উত্তরপ্রজন্ম?
তবে, নিপাতনে সিদ্ধ ব্যতিক্রমীরাও আছে বইকি, যারা যত্ন করে নীরবে মুছিয়ে দেয় আমার সব অক্ষমতার গ্লানি, সাজিয়ে দেয় আদরের মাতৃভাষার নতুনতর আখর, তারাই তো , “ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে”–এ বিশ্বাসে অটল থাকতে সহায়তা দেয় আজও।
আরও তৃপ্তির—আমার মায়ের ভাষার ফিনিক্স হয়ে ওঠার দিনটি সারা পৃথিবীর ভাষাময় মানুষের ভাষা-ভালোবাসা দিন— ভাষাদিবস।
একান্ত নিজস্ব প্রার্থনায় চাই,—একুশে ফেব্রুয়ারির অশোকে পলাশে রাঙুক প্রতিটি দিনের বোধযাপন। তবু, এপারের আনন্দময় এ উদযাপনে একটা অন্যতর বোধে জেগে উঠে ভাবি,—আমার কোনও নির্দিষ্ট ভাষাদিবস নেই।

আমার বাবা যখন বেনোজলের ধাক্কায় এপারে এসে
নতুনমাটির ঠাট্টা থেকে চাটিগ্রামী উচ্চারণ বাঁচাতে মরিয়া,
তাঁর সেই প্রতিটি পেরেকস্মৃতি-আমার ভাষাদিবস।

আমার দিদা যখন পাথরের গেলাসে জামিরের রস হাতে দাদুকে বলতেন,
“খায়্যা লয়্যা খানিক জিরুন লাগে আফনের”—
দেশহারানো সেই ভাষানীড়-প্রেম—আমার ভাষাদিবস।

আমার উৎকলী সইটি যখন ঠোঁটের কোণে ব্যথার আপ্লুতিতে লুকিয়ে রাখে তার ঢেঙ্কানলী উচ্চারণের আলো—
সেই প্রতিটি রক্ত চোঁয়ানো কান্না—আমার ভাষাদিবস।
পুরুলিয়ার পিসেমশাই থেকে রায়গঞ্জের নতুনকাকিমা,
মুর্শিদাবাদের আলমভাই থেকে দার্জিলিংয়ের বোন জুলিয়ানা লেপচা—
সবাই-সব্বাই-যখন পোশাকি ভাষায় বাধ্যত আড়ষ্ট জিভের আড়ালে নিজের নিজের নিঃস্বরে ‘মা’ ডেকে নিজেকেই শোনায়—
সেই অস্বস্তিধোয়ানো প্রতিটি আশ্বস্ত আশ্রয় আমার ভাষাদিবস।
তবু, একান্ত অনুভবগুলির নির্লজ্জ একাধিপত্যে চাই :
আমার ভাষাদিবসে ভরদুপুরের ভাতের থালায়
লঙ্কা-কাগজিলেবু আর লবণের রোদ্দুর পিঠোপিঠি বাড়ুক রোজ।
আর—হাত ধরাধরি বাঁচুক চর্যাপদ থেকে গীতবিতানের আনন্দচারিতা।

আহা রে আমার
অলচিকি কিংবা আলতামিরার ছাঁদের
মরমী হাত!
ও হাতে
ওতঃপ্রোত রাখি
স্বপ্নের উত্তরাধিকার হস্তান্তরের
স্ব-ভাষ যোগ্যতা,
শেষমেশ!

Skip to content