রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

“পাঁড়েজির ছাগলের একহাত দাড়ি,
অপরূপ রূপ তার যা‌‌ই বলিহারি!
উঠানে দাপটি করি নেচেছিল কাল
তারপর কি হ‌ইল জানে শ্যামলাল।”


বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য একদা কিছু বীর যোদ্ধা লড়াই করেছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখ তাই স্মরণীয়, বরণীয় শুধু এই কারণে নয় যে, আমরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলি, আমরা আন্তর্জাতিক স্তরে দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতে বাংলা গান শুনতে পাই কিংবা আত্মবিস্মৃত বলে খ্যাত বাঙালিকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিন ঘোষিত হয়েছে বচ্ছরকারের বাঁধা বুলি আউড়ে নেওয়ার জন্য…বরং অন্ধকারের উত্স থেকে উত্সারিত আলোর মতো বাংলা ভাষার অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত সামনে রেখে পৃথিবীর সকল মাতৃভাষা আর তার সুশীতল ছায়াতলের ভাষাভাষীদের আবেগে ভাসার জন্য একটা দিন ক্যালেন্ডার বছরে পৃথিবীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা রেখেছেন।

মাতৃভাষা নাকি মাতৃদুগ্ধের মতো অমৃতনিষ্যন্দী বলকারক… কেন, কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে ইত্যাদি নিয়ে অনেক বিসম্বাদ, পরিকল্পনা ও শূন্যতা আছে। ঔপনিবেশিকতার আশীর্বাদ ও অভিশাপ আছে, সব মিলিয়ে দিকশূন্যপুরে ঘুরে বেড়ানো পাপা-মাম্মা-মাম্মি-ড্যাডিরা আছেন, পরিহাস-উপহাস আছে। তবুও অনন্ত জাগে, অসীম বিস্মৃতির পাশেই।
শরতে ‘মা’ আসেন, ‘মাম্মির’ হাত ধরে ‘গডেস’ দেখে বিস্ময় জাগে বৈকি! কিছু ‘বুলশিট’ ভুল করার পর ‘হেব্বি বিন্দাস’ থাকতেই হয়, তবুও ঘাসের আগায় শিশিরের ফোঁটা, মায়াবীর নদীর পারের দেশের ফসলবিলাসী হাওয়া, কালের চিরচঞ্চল গতির স্তব্ধতার পাশে শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সূর্যোদয় থেকে যায়। আশাবরী বাজে স্বপ্নের ভোরে।

তবুও, মাতৃভাষায় কথা বলা বাধ্যতামূলক নয়। কারণ মানুষ তার অধিকার নিয়ে ভারি সচেতন। যাকে বলে, প্রচণ্ড। কারণ, নদীর ওপারেই সর্বসুখ এটা প্রমাণিত। কারণ, মাতৃভাষায় সব ব্যাখ্যা করা যায় না। তা অনাবশ্যক, ম্যাড়মেড়ে, ধ্যাড়ধ্যাড়ে গরুর গাড়ির মতোই অচল আধুলি, যাদুঘরের মমি। কারণ, মন বলে আমি মনের কথা জানি না। কারণ, দুঃখিনী মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ে আজকাল শীত কাটে না। কারণ, আজকাল শিশু নাকি জন্মের পরেই “হ্যাল্লো গাইজ” বলেই নিজেকে ইন্ট্রোডিউজ করে কাঁকিনাড়া থেকে কঙ্গো, বুদাপেস্ট থেকে বঙ্গো। কারণ… আরও অনেক।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৬: সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল হকিকত

মাতৃভাষায় কথা বলা একটা চয়েস। দরকার হলে মাতৃষ্বসার ভাষাতেই কথা বলতে হয়, কারণ, যস্মিন্ দেশে যদাচার আর মায়ের চেয়ে মাসির জন্য দরদ সবসময় বেশিই।

গুরুত্বপূর্ণ হল এটাই, কেন আমাদের মাতৃভাষা আজ আর মনে-মস্তিষ্কে-চেতনায়-বোধে রোমাঞ্চ জাগানোর মতো সম্মানের জায়গায় নেই?

কেন অন্য ভাষাশিক্ষা ও ব্যবহারের প্রসার ও মাতৃভাষার জন্য মমত্ববোধ ব্যস্তনুপাতিক?

কেন দরকার না হলেও অন্য ভাষায় কথা বলতে হয়?

কেন ভাষার ক্ষমতা শব্দ ছাড়িয়ে পেশীশক্তির সঙ্গে মেশে?

কেন অন্যান্য অনেক মানুষের মাতৃভাষা ও মাতৃভাষার জন্য যাদের লড়াই থেকে এই স্বীকৃতি, তাদের মাতৃভাষা বিপ্রতীপে থাকে? পৃথিবীর সকল মানুষের মাতৃভাষা সমান মর্যাদা পায় না কেন? কেন পৃথিবীর আনাচে কানাচে অনেক ভাষা ক্রমে ক্রমে মুছে যাচ্ছে? মুছে গেছে? কেন ভাষার অস্তিত্ব ও স্বীকৃতির লড়াইগুলি আপেক্ষিকতায় ভোগে? কেন সব ভাষার জন্য লড়াই সমান নয়? কেন একটা ভাষা শেষ পর্যন্ত শুধু ভাষা না থেকে ক্রমশঃ সরে আসে তার মুখ্য তাৎপর্য থেকে?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী

কেন মাতৃভাষা আমাদের কাছে বাংলা, শুধু বাংলা-ই? কেন অন্য জাতিগুলির মাতৃভাষার জন্য দরদ আমাদের কাছে শিক্ষণীয় নয়? অন্য ভাষাশিক্ষা প্রশংসনীয় হলে কিছু কিছু মাতৃভাষার চর্চা কেন নিরর্থক? ভাষা কি আজ কেবল অর্থকরী, মানুষের বোধের বিকাশে আজ কি তার ভূমিকা নেই? ভিন্নভাষীর মুখে নিজের মাতৃভাষা শোনার অভিজ্ঞতা চমকপ্রদ ও অভূতপূর্ব হলে, মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা কেন তেমনই চমকপ্রদ নয়?

কেন বাংলা ও মাতৃভাষা নিয়ে দ্বিচারিতা? বাংলা মাতৃভাষা বললে কেন প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যায়? বাংলায় কথা বলা অশিক্ষা কিংবা অর্ধশিক্ষার একথা কেন ও কীভাবে সমাজের মনে গেঁথে গেল? কেন বাংলাভাষী বাঙালি স্কুলের রচনায় মাতৃদুগ্ধের জয়গান করে কৃত্রিম প্রকল্পিত দুধেই বেশি আস্থাশীল? কেন অন্য ভাষাতে বাংলা ভাষা শিক্ষা করতে পারার মতো সোনার পাথরবাটি একরকম শ্লাঘার জন্ম দেয়?

কেন ভাষাবোধ সারস্বত বৈদগ্ধ্যের জগতে অপাঙক্তেয়, যেমন তেমন করে মনের কথা বলে ওঠার মতো আদিমতায় কেন আস্থা সভ্য জগতের? মাতৃভাষা ও অন্য ভাষার মধ্যে দূরত্ব কতটা? যদি মাতৃভাষা বাংলা না হয়ে অন্য কিছু হতো, তাহলে কি বেঁচে যেতো অনেকেই? মাতৃভাষার দিনেই কি শুধু তার জন্য অনুরাগ দেখাতে হয়? বিরাগ বা বিতৃষ্ণা কীসের জন্য; ভাষা না মাতৃভাষা? সকলেই বড় হয়ে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ কিংবা চিকিৎসক অথবা অন্য যা কিছু হবার হয়ে আকার ইঙ্গিতে কথা বলবে? না তো? তাহলে অন্য ভাষাতে তা হলে মাতৃভাষাতে নয় কেন? তাহলে দূর আজ নিকটবন্ধু, বিশ্বগ্রাম হয়ে হলটা কী?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮০: ঠাকুরবাড়ির ফরাসি-পাচক

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

আমি তারই হাত ধরে মানুষের কাছে আসতে পারছি না? চাইছি না? কোনটা? বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন এই শর্তে এক হতে পারে? দুখের রাতে সুখের স্রোতে ধরণী আজও কি ভাসে? মাতৃভাষা বাংলাভাষাকে নিয়ে হতাশ কেন হওয়া চলবে না? অথবা, হতাশ হতেই হবে কেন? কিংবা, আশা করার কীরকম কারণ আছে? কেন আছে?

তবুও অনায়াসে, জল খাওয়া যায়, মাথা খাওয়া যায়। আসি বলে চলে যাওয়া যায়। আমরা ছাতা ধরি। মাথা ধরে। ভূতে ধরে। দাম ওঠে। ঝড় ওঠে। সে, তাহারা পড়ে, বাজ পড়ে। তাল পড়ে। আমি তবু ভাবি। তবুও ভাবি। এসব হতে পারে। হতেই পারে। যদি তুমি যাও তবে আমি করবো। যদিও সন্ধ্যা নেমেছে মন্দমন্থরে…যাবোই আমি যাবোই, বাণিজ্যেতে। বেণীমাধব! তোমার বাড়ি যাবো।

সূক্ষ্মতার অভাব আছে মাতৃভাষায়?

বাঙালির বাংলাভাষার জ্ঞান দেখলে আজ হতচকিত হতে হয়। বাগাড়ম্বর আর ওস্তাদি দেখলে মনে হয় কেউ একজন এমন বাংলাতেই অনায়াসে বলে দিয়েছিলেন, আই গো আপ, উই গোডাউন। কিন্তু, ওই ওস্তাদিটা বাংলা। যেমন, ক্লাস, ক্লাব, চক, ডাস্টার।

আজ আমরা খুব খুব স্মার্ট, আগাপাশতলা। “আমি গাই” বললে কেউ তো প্রশংসা করে না, উল্টে দুধের দর জানতে চায়, এমন অবস্থায় সকল মহান, সকল বৃহত্কে বিনম্র শ্রদ্ধায় বরণ করেই বাংলায় গান গাইতে, স্বপ্ন দেখতে, দেখাতে, হাসতে, ভাসতে, তাকে মুক্ত জীবনানন্দে উদযাপন করতে অথবা প্রাণের সুখে মায়া ভরা পথে হাঁটতে পারছে তো এখনকার মানুষ?
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content