সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


কাউকে শিখিয়েছিলেন পিতার ধর্ম, কাউকে পুত্রের, কাউকে আবার মাতার। আর যাঁকে শিখিয়েছিলেন সমাগতা লক্ষ্মীকে উপেক্ষা করতে নেই, সেই দুর্যোধন অধর্মের পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন, সূচ্যগ্র ভূমিদানেও তিনি অসম্মত হয়েছিলেন। ওদিকে পাণ্ডবদের চোখের জল মোছানোর জন্য ছিলেন মুগ্ধমধুসূদন। কিন্তু সবার তো তা নয়। তাই তো তাঁর এইসব চিরকালীন উপদেশ। আর ন্যায্য প্রাপ্য ফেরানোর উদ্দেশ্যে একসময় ঘোর অমাবস্যা তিথিতে পাঞ্চজন্য-দেবদত্ত শঙ্খনাদ যেন হৃদয়বিদারী হয়ে উঠেছিল, সেখানে বাসুদেবশ্চ সংযন্তা যোদ্ধা চৈব ধনঞ্জয়ঃ। দুর্যোধনের অসংখ্য সৈন্য নিধন করার কথা ছিল বলবান সত্যবিক্রম তেজস্বী অর্জুনের। জগজ্জননীর স্তোত্রপাঠের পর যখন তিনি কৌরবপক্ষীয়দের দিকে তাকালেন তখন গুরুজন এবং বন্ধুবান্ধবদের দেখে নির্বেদগ্রস্ত হলেন।
ভিক্ষাবৃত্তিও তাঁর কাছে শ্রেয় মনে হয়েছিল এই যুদ্ধ জয়ের চেয়ে। বসে পড়লেন, ধনুর্বাণ ত্যাগ করলেন আর তারপরেই কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি যোগ আলোচিত হল কৃষ্ণার্জুন সংবাদে—কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। উপদিষ্ট হলেন স্বয়ং পার্থ। আর সেই উপদেশ ছিল, নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন। উপদিষ্ট হলাম আমরাও —যে মোক্ষের পথে আপামর দেশবাসী হাঁটতে পারবে, যে বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হলে কর্মবন্ধন প্রকৃষ্টরূপে ত্যাগ করতে পারব, সেই জ্ঞানই তিনি শুনিয়েছেন। তাই তো তা গীতা, যে গান আজও বিক্ষিপ্ত মনের আরাম, প্রলেপ আর উপশম, কর্মই এখানে মানুষের শ্রেষ্ঠ পথ বলে নির্দিষ্ট হয়েছে কারণ কর্মেই মানুষের কর্তৃশক্তি বা আধ্যাত্মিকতার বলবৃদ্ধি হয়।
আরও পড়ুন:

যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে

প্রবৃত্তির সাহায্যে কর্মের সাধন এবং কর্মের দ্বারা প্রবৃত্তির দমনই সর্বোৎকৃষ্ট। আর আমরা শুনেছি শ্রী ভগবানের সেই বিখ্যাত উক্তি: সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ—সমস্ত আমি, আমার ভাব ত্যাগ করে আমাতে চিত্ত স্থির কর। স্বধর্ম পালনই তাঁর কাছে শ্রেয়। তা সে অর্জুনের ক্ষত্রিয়ধর্মই হোক পশুমাংস বিক্রেতা ধর্মব্যাধের ধর্ম হোক অথবা পাটলিপুত্রের বারাঙ্গনা বিন্দুমতীর ধর্মই হোক; স্বধর্ম পালন যে গঙ্গাস্রোতকেও উল্টোদিকে বইয়ে দেয়। ধর্ম আর কর্ম এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। তাই তো কৃষ্ণের মুখে কখনও ব্রাহ্মণের স্তব বা শূদ্রের নিন্দা শোনা যায় না। তিনি বলেছিলেন মানুষে মানুষে ভেদ যেমন আছে তেমনি মানুষের ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যও মূল্যবান। চারবর্ণকে যেদিন তিনি গুণ ও কর্ম অনুসারে বিভক্ত করেছিলেন সেদিনই তিনি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্রের থেকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও সবটা বোঝাতে তাঁর আঠারোটি অধ্যায়ের প্রয়োজন হয়েছিল। দ্বিতীয় অধ্যায়ে উত্থাপন করেছিলেন সেই বিখ্যাত যুক্তি, আত্মা জন্মমৃত্যুরহিত—ন হন্যতে হন্যমান শরীরে।
আর ভারত যুদ্ধের প্রারম্ভে দেখিয়েছিলেন তাঁর ভয়ানক করালরূপ যেখানে অর্জুনের প্রিয় পরিচিতরা লগ্ন হয়ে ছিল। তাঁদের মৃত্যুও পূর্বাবধারিত হয়েছিল শ্রী ভগবানের দ্বারা। এখানে সব্যসাচী শুধুই নিমিত্ত, যাঁকে কর্তব্যের সম্মুখীন হতেই হতো। ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য তাঁকে ছাড়তে হতো। যোগেশ্বর তিনি এমন যোগের শিক্ষা দিয়েছেন যার ফলে কর্ম করলেও বন্ধন হয় না। সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের উদ্দেশ্যে তাঁর এই কর্মরহস্য, তাই তো পূজা-অর্চনা, আচার-ধ্যান এই সব এর প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। ব্যক্তিগত ও দৈহিক সুখকে প্রাধান্য না দিয়ে কর্মের যাপনই তো তিনি শিখিয়েছিলেন। অনাসক্তি যোগ অবলম্বন করে এমন কর্ম করতে হবে যেখানে ফল আমি ভোগ করব এবং ফলটি আমার—এই ভাব কোনও দিন মনের মধ্যে আসবে না। স্বামীজি বলতেন, মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে, একা থাকতে পারে না আর একা থাকা যায় না বলেই মানুষ অপরের সেবা করবে।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১০: সাবিত্রীদেবীর দৃষ্টিতে টুকরো সময়

প্রথম আলো, পর্ব-৫: বিশ্বের প্রথম ঘড়ি কোনটি? আবিষ্কারক কে?

সমত্বং যোগ উচ্যতে—মানুষকে সব সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা দেয়। সেই ক্ষমতা অর্জন করে জীবনে সাফল্যের সৌরভ অনুভব করা যায়। তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব—গৃহী যোগী থেকে সন্ন্যাসী হওয়া সবেতেই তাঁর মত। অর্জুনকে তিনি বলেছিলেন, আমার এই পৃথিবীতে কিছু পাওয়ার নেই, তবুও আমি কাজ করি। মহাভারত থেকে দিল্লি ও দ্বারকার পারস্পরিক দূরত্বের কথা জানা যায়। রাষ্ট্রীয় শক্তির বিকাশের জন্য, লোককল্যাণের জন্য তিনি বারবার দিল্লি থেকে দ্বারকা যাতায়াত করেছেন। সকলের কল্যাণের জন্য অনাসক্ত হয়ে কর্ম করাই আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ, কর্ম না করে শরীর রক্ষা সম্ভব নয়—নিয়তং কুরু কর্ম ত্বম্, তুমি সতত নিজের কর্তব্যকর্ম পালন কর, কাম ক্রোধ সীমা ছাড়ালে তবেই শত্রু। না হলে সবার মধ্যেই এগুলি বর্তমান। বিবেকজ্ঞানকে ঢেকে রাখে এই কাম। আরও গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে বলেছেন—ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে। অর্থাৎ শরীর নয়, ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি এই তিনটি কামের আশ্রয়।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৮: প্যায়ার করনে ওয়ালে প্যায়ার করতে হ্যায় শান সে— আশার কণ্ঠ ও আরডি-র সুর, অনবদ্য

ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধিকে বিমোহিত করে এই কাম ক্রোধাদি আমাদের অনেক পাপ কর্ম করায়। স্থূলদেহ থেকে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্রিয় থেকে মন, মন থেকে বুদ্ধি, বুদ্ধি থেকে আত্মা। সুতরাং সর্বাগ্রে ইন্দ্রিয়, তারপর মন ও বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সমস্ত জীবন গীতার যোগ অভ্যাস করতে হয়। এটি কোনও অলৌকিক ব্যাপার নয়, কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, কাজ কীভাবে করতে হবে এ সব নিত্য প্রয়োজনীয় কথাই ভগবান গীতায় আমাদের বলেছেন। আর বলেছেন যে কোনোভাবে তুমি আমার কাছে আসবে সেই ভাবেই আমি তোমাকে গ্রহণ করে শুদ্ধ করে তুলব। যেকোনও রাস্তা ধরে তুমি আসবে আমি সেই রাস্তা থেকেই তোমায় গ্রহণ করব—যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
ষষ্ঠ অধ্যায় তিনি বলেছেন, তুমিই তোমার বন্ধু, তুমিই তোমার শত্রু—আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ। যখন আমরা আমাদের বিবেক জাগ্রত করে চাওয়া পাওয়াগুলো সংযত করতে পারব, তখনই প্রকৃত অর্থে আমরা আমাদের বন্ধু হব। না হলে আমরা আমাদের শত্রু হয়ে যাব। ওদিকে মহাধনুর্ধর ভগবানকে বলেছিলেন, মন যে চঞ্চল, বায়ুকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, সেইরূপ মনকেও বশীভূত করা যায় না—চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্। আর ভগবান এর উত্তরে দিয়েছেন অভ্যাস ও বৈরাগ্যের ওষুধ, যা পান না করলে চঞ্চল মন আনমনা হবেই। নিঃশ্রেয়স ও আত্যন্তিক কল্যাণের জন্য তাঁর এই গীতাশাস্ত্র। স্বামীজি বলতেন, গীতা ব্যবহারিক বেদান্তের আদর্শ গ্রন্থ।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

একেবারে শেষের দিকে ভগবান বলেছেন, মানুষের গুণ তার কর্মে, চিন্তায়, রুচিতে, দানে, তপস্যায় ফুটে ওঠে। মোক্ষ যোগে অর্জুন সন্ন্যাস ও ত্যাগের বিষয়ে জানতে চেয়ে উত্তর পেয়েছেন, স্বর্গ প্রভৃতি ফলের ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে আর সকল কর্মফলের ত্যাগকে ত্যাগ বলে। সমস্ত অহংভাগের অর্পণই এর মূল। কিন্তু কিছুই তিনি মানবসভ্যতার উপর চাপিয়ে দেননি। বলেছিলেন, যথেচ্ছসি তথা কুরু। অর্থাৎ পরম জ্ঞান বললাম এবার যা ইচ্ছে হয় তাই অনুষ্ঠান কর। আর তাতেই সব সংশয় কেটে গিয়েছে। অর্জুনের মতো আমরাও বলতে পারি—নষ্টো মোহঃ স্মৃতির্লব্ধা। অমৃতবর্ষী এই উপদেশগুলিকে তাই কালও গ্রাস করতে পারেনি। বিগত দেড় হাজার বছর ধরে বয়ে চলা বাণীগুলি জিজ্ঞাসু মনে বরাবর প্রাণসঞ্চার করে চলেছে ও চলবে।—শেষ।

ছবি সৌজন্যে: রাজা রবি বর্মা।

ঋণ স্বীকার:
মহাভারতের কথা: বুদ্ধদেব বসু
মহাভারতের চরিতাবলী: সুখময় ভট্টাচার্য
শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতার রূপরেখা: রঙ্গনাথানন্দজী
প্রাকৃতবৈভব: দেবার্চনা সরকার।
* বিশেষ নিবন্ধ (Special Article): যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে (Greatness of Janmashtami and Srikrishna) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content