শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মোবাইল ফোন যাকে আমরা বাংলায় আদর করে মুঠোফোন বলি, তাকে তামিলে বলা হয় কাইপেসি। এই অদ্ভুত যন্ত্রটি আজকাল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা অবধি প্রতিদিনকার জীবনের সঙ্গে যে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন সব্বার হাতে হাতে মানে মুঠোতে ওই একটাই যন্ত্র, মোবাইল ফোন। স্বয়ং ভগবান আগে জানলে হয়তো মানুষের দুটি হাতের জায়গায় তিনটে হাত বানিয়ে মর্ত্যে পাঠাতেন। একটা হাত ওই ‘এক্সলুসিভ’ স্মার্টফোনটি ধরার জন্য। উইকিপিডিয়াতে দেখছিলাম, ভারতে নাকি ২২০ মিলিয়ন অর্থাৎ ২২ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। চিনের পরেই নাকি ভারতের স্থান। এমনকি, আমেরিকার উপরে ভারতের স্থান। দেখছেন না, এখন গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই কেমন মোবাইল ফোনে ছেয়ে গিয়েছে।

এমনটা কিন্তু ছিল না বছর পনেরো আগেও। খোদ আমেরিকাতেও ১৯৮৩ সালে একটা মোবাইল ফোনের দাম ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। আর এখন একেবারে নামমাত্র টাকাতেই মোবাইল ফোন পাওয়া যাচ্ছে আমাদের দেশে। আজকাল সব্বার হাতেই দেখবেন ওই মোবাইল ফোন। এমনকি, বাড়ির পরিচারক- পরিচারিকারা হোয়াটসঅ্যাপ কল করে জানিয়ে দিচ্ছেন, আজ আসতে পারবে না কাজে।

মোবাইল ছাড়া যেন আমাদের জীবন ‘ইমমোবাইল’। এই তো মিজানুর এসেছিল বউয়ের চোখ দেখাতে। ওর বউয়ের চোখ মাঝে মাঝেই একটু লাল হয়। আর মিজানুর বউয়ের চোখ একটু লাল হল কি না হল, আমাকে একবার মোবাইলে কল করবে। সে দিনকে ফোন করে বলল, সাবান দিয়ে স্নান করার পর বউয়ের চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, সাবান দিয়ে স্নান করলে আমারও চোখ লাল হয়। মিজানুর পত্নিপ্রেমে শাহজাহানকেও পর্যন্ত টেক্কা দিতে পারে।

মনে আছে, আগে একটা ইন্টারন্যাশনাল (আইএসডি) কল করতে কত ঝামেলা ছিল। অপারেটরকে কল করে প্রথমে টোকেন নম্বর নাও, তিন ঘণ্টা পর আপনার সময় আসতো। শুধু তাই নয়, অনেক টাকাও লাগতো একটা আইএসডি কলের জন্য। এখন সবই হাতের মুঠোয়।
এসটিডি কোড টিপে নম্বর লাগান। সঙ্গে সঙ্গে ফোন লেগে যাবে। মোবাইল ফোন ছাড়া কাজ চলতো না তখন? চিঠিতে লিখে দেওয়া হত ট্রেন থেকে নেমে ইঞ্জিনের পাশে বা হিগিনবোথামের বইয়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। না, কেউ হারিয়ে গিয়েছে এমনটা চেনা জানার মধ্যে শুনিনি কখনও।
আমারও অনেকদিন পর্যন্ত মোবাইল ফোন ছিল না। অনেকে বলছিলেন, একটা মোবাইল ফোন নিয়ে নিতে। শেষমেষ বাংলাদেশের এক বৃদ্ধা যখন বললেন, “দাদা, একটা মোবাইল লইয়া নিন। অতদূর থেকে আর আসতে পারুম না। মোবাইল হইলে জানাইতে পারুম কেমন আছে চক্ষুটা”। কথাটা ফেলতে পারিনি। প্রথমে নিয়েছিলাম একটা ডাব্বা ফোন নোকিয়া। ‘কানেক্টিং পিপল’। ফোনটা বাথরুমে পড়ে জল লেগে নষ্ট হয়ে যায়। তারপর কিনলাম মোটোরোলার মোবাইল ফোন। সেটা একদিন আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে গেল।

এই ফোনগুলোর মাথায় যে কী থাকে ভগবান জানে। এরপর কিনলাম ব্ল্যাকবেরি। নখ না থাকলে ওই ফোন ভুলেও কিনবেন না। কিপ্যাডটা এত ছোট যে কী আর বলবো। বন্ধুবান্ধব থেকে ছাত্ররা পর্যন্ত বলতে শুরু করল, “কী সাবেকি ফোন ব্যবহার করছেন স্যার!” না ‘স্মার্ট’ হতে হবে তোমাকে স্মার্ট। তোমাকে নিতে হবে স্মার্টফোন। তাই নিলাম স্যামসাং গ্যালাক্সি স্মার্টফোন একবছর আগে। এতে নাকি অ্যাপ দিয়ে গান শোনা থেকে ট্যাক্সি ডাকা পর্যন্ত করা যায়। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ।

সত্যিই মোবাইল ফোন ছাড়া ‘ইমমোবাইল’ আমাদের জীবন। ঘনঘন ফোন আসবে, আসতেই থাকবে। সব থেকে ফ্রিকোয়েন্ট ডায়ালগ ওই একটাই, “হোয়ার আর ইউ?” একদিন বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, আমি এখন নেপচুনে। নেপচুনের নাম শোনেননি। মানুষ আজকাল পারেও বটে। এত কথা, এত কথা। রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটা লাইন আছে না, “এত কথা আছে, এত গান আছে, প্রাণ হয়ে আছে মোর…”। প্রথমটুকু তো খুবই সত্যি। একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম এয়ারটেলের। হিল স্টেশন। চারধারে কিছু পাহাড়ি লোকজন। এক তরুণ দুই হাত মেলে আনন্দে বলে উঠল, ‘এখানে ফোর-জি’ নেই’। তখন আর এক পাহাড়ি ছেলে দূর থেকে দৌড়ে ওর কাছে এসে বলছে, “দেখো ফোর-জি এসে গিয়েছে”।
আরও পড়ুন:

প্যারিস, ইউট্রেকট, আমস্টারডাম হয়ে ব্রাসেলস—স্বপ্নের ভ্রমণ ডেসটিনেশন/১

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫: আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?

আমরা সিকিমের একটা হিল স্টেশন রবংলায় গিয়েছিলাম। সেখানে আমার এয়ারটেলের কানেকশন পাওয়া গেল না। হোটেলের রিসেপশনের লোকেদের সাহায্য নিয়ে ট্যাক্সি ডাকতে হয়েছিল বৈকি। কিন্তু জায়গাটা এত ভালো লেগেছিল যে কি বলবো। তার একটা কারণ অবশ্য সেখানে একবারও মোবাইল ফোন ধরতে হয়নি।

আমাদের ডাক্তারদের জীবনে দরকারে অদরকারে মোবাইল ফোনে কল আসে। মাঝে মাঝে তাই মোবাইলহীন দুনিয়াতে থাকতে খারাপ লাগে না। কিন্তু আজকালকার অল্প বয়সীদের কথা একদম আলাদা। ওদের মোবাইল হাতে না থাকলে মনে করে যেন অথৈ জলে পড়েছে। একে নাকি ‘নেমোফোবিয়া’ নাম দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে ওই মোবাইল নামক যন্ত্রটি। মিসড কল এবং এসএমএস। তার সঙ্গে এক নতুন আপদ জুটেছে হোয়াটসঅ্যাপ। যাতে করে চোখের ছবি, এমন কি ভিডিও, এক্স-রে মায় সিটি স্ক্যান অবধি পাঠানো যায়। রোগীরা প্রায়ই বলেন, ডাক্তারবাবু সব রিপোর্ট পাঠিয়েছি। সতেরোটা রিপোর্ট ছিল, ইউরিন থেকে অ্যাঞ্জিওগ্রাম অবধি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪: সুন্দরবনের লবণ-বৃত্তান্ত

আমাদের ছেলেবেলার জীবন এমন ছিল না কিন্তু। মনে আছে, বাবা কুড়ি বছর সরকারি চাকরির পর টাকা জমিয়ে, আমাদের দুর্গাপুজোর জামাকাপড় কেনার খরচ কমিয়ে কিনেছিলেন মারফি ট্রানজিস্টর। তাতে পাওয়া যেতো দুটো স্টেশন, ‘কলকাতা-ক’ আর ‘কলকাতা-খ’।

বুধবার সাড়ে নয়টা ছিল অনুরোধের আসর। আর শুক্রবার সাড়ে নয়টাতে হত ছায়াছবির গান। সন্ধে সাড়ে সাতটায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবাদ সমীক্ষা। রবিবার দুপুর দেড়টায় বাংলা নাটক। মহালয়ার দিন ভোর রাতে মহিষাসুরমর্দিনী। নতুন ব্যাটারি লাগানো ট্রানজিস্টরে শুনতাম “যা দেবী সর্বভূতেষু…”। আমরা কি খুব কষ্টে ছিলাম? আজকাল সুবিধা বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও বেড়েছে। এখন আমাদের শান্তিতে পেচ্ছাপ করারও উপায় নেই। বাজলেই কথা ছিল, ভাইব্রেশন মোডে থাকলে তো বেশ মুশকিল।

তবু ফোন মানে স্মার্টফোন না হলে চলে না আজকের জীবন। কী নেই এতে, কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে, ক্যামেরা, ক্যালকুলেটর, মিউজিক, ভিডিও, গেমস, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেজ, ইমেল ইত্যাদি। এমনকি, সেদিন দেখলাম আমার অপথালমোলজিস্ট সহকর্মী চোখ দেখছে স্মার্টফোনের টর্চ দিয়ে। এ সব কারণেই আজ আট থেকে আশি, সবাইকেই মুঠোবন্দি করে ফেলেছে এই মোবাইল ফোন, থুড়ি মুঠোফোন।

সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আজকের দিনের অল্প বয়সীরা ষোলো ঘণ্টার মধ্যে অন্তত একশো আট বার মেইল কিংবা মেসেজ চেক করে। আমার এক সহকর্মীকে দেখলাম আঙুলের ডগাটা ক্ষয়ে গিয়েছে এসএমএস করতে করতে। মোবাইল থেকে মাথাই তুলতেই চায় না আজকালকার ছেলেমেয়েরা। কথা বললে ‘মনোসিলেবল’-এ উত্তর দেয়, ‘ওয়েট’।

আমার এক বন্ধু এক রবিবারের বিকেলে পরিবার নিয়ে এসেছিল নির্ভেজাল আড্ডা দিতে। বন্ধুর সঙ্গে এসেছিল ওর বছর কুড়ির কন্যাও। আমরা ঘণ্টা দুয়েক গল্প করেছিলাম নানা বিষয় নিয়ে। মেয়েটি কিন্তু মুখ ডুবিয়ে রেখেছিল ওর মোবাইল ফোনে। গুগল থেকে ইউটিউব, ইউটিউব থেকে হোয়াটসঅ্যাপ, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে মেসেজ এই নিয়েই মেয়েটি ব্যস্ত ছিল প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। শুধু যাওয়ার সময় বলেছিল, “বাই আঙ্কল”। এটা খারাপ কিছু বলছি না। আমিও তো এখন জিমে গেলে স্মার্টফোনে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনি ট্রেডমিল করতে করতে। আমার স্মার্টফোনে তিনশো কুড়িটা গান লোড করে দিয়েছে আমার কন্যা।

মনে আছে, বছর পনেরো আগেও ওয়াকম্যান কোমরে বেঁধে জগিং করতে যেতাম। ক্যাসেটের এক পাশের গান শেষ হলে, থেমে গিয়ে পাল্টাতে হত। এখন ওসবের দরকার হয় না। স্মার্টফোনই আপনার জন্য ম্যাচ করা গান খুঁজে দেয়। আজকাল গাড়ির চালককে বসিয়ে রাখলেও ওদের কোনও অসুবিধা হয় না। এই তো সেদিন বেশ দেরি হয়ে হয়ে গেল, এক ঘণ্টা বলে তিন ঘণ্টা পরে এলাম মিটিং শেষ করে। ফিরে এসে চালককে সরি বলতে যাচ্ছিলাম, ও বললো না স্যার, আমি মোবাইলে রজনীকান্তের একটা তামিল ছবি দেখছিলাম। সুবিধাই হয়েছিল ওর। স্মার্টফোন আজকাল সব পারে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২২: কেস কালাদেও: ফাইল নম্বর ১

এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন, বোরিং মিটিংয়ে আপনাকে আর ভুগতে হবে না সময় কাটানোর জন্য। আঙুলের ডগার ছোঁয়ায় বিনোদনের সমুদ্রের গভীরে চলে যেতে পারবেন। সময় কীভাবে কেটে যাবে বুঝতেই পারবেন না। তবে অসুবিধাও আছে। ওই আঙুলের ডগার ছোঁয়ায় কমবয়সী ছেলে বা মেয়েরা গুগল ধরে এমন সব সাইটে চলে যাবে, যা নজরে পড়লে ষাটের দশকের আপনি ছোটখাট হার্ট অ্যাটাকের সম্মুখীন হতে পারেন। আমার পঁচাশি বছরের শাশুড়িমাতা কথামৃত, গীতা নয়, এই মুঠোফোনে পাশের বাড়ি থেকে প্যারিসে ছেলেকেও নেটওয়ার্কে ধরে নিয়েছেন। লিভ উইথ দ্য টাইম ম্যান।

মুঠোফোনে শুধু মুঠো মুঠো সুখই নয়, দুঃখও পেতে পারেন মুঠো মুঠো। সবাই এখন ব্যস্ত। কোন কাজে ব্যস্ত? মোবাইল ফোনে। শুনতে পাবেন মোবাইল ফোন বলছে, “দ্য পারসন ইউ আর টকিং, ইজ বিজি টকিং উইথ সামওয়ান এলস। কে সেই ‘সামওয়ান এলস’ আপনি জানতেও পারবেন না। তিরিশ বছর আগে ছাত্রাবস্থায় আমেরিকায় গিয়েছিলাম। ডায়াল করার পর ল্যান্ডলাইনে এই মেসেজটা শুনেছিলাম, “প্লিজ চেক দ্য নম্বর অ্যান্ড কল এগেন”। মনে আছে, আমি বলেছিলাম, “আই হ্যাভ চেকড দ্য নম্বর”। তখন কি জানতাম ওটা রেকর্ডেড মেসেজ।

এখন সব থেকে অমধুর মেসেজ, “দ্য পারসন হুম ইউ আর কলিং ইজ নট অ্যাকসেপটিং ইয়োর কল”। সেটা যদি আপনার মেয়ে অথবা বউয়ের মোবাইল ফোন থেকে আসে, তাহলে মনে হয় বাড়ি গিয়ে একহাত নিয়ে আসি। এটাও শুনবেন, “দ্য পারসন হুম ইউ আর কলিং ইজ নট আভেইলেবল ফর ইয়োর কল রাইট নাউ”। কেন? জানতে ইচ্ছে করবে আপনার। ফোন তুলতে কি অসুবিধা হচ্ছে ওঁর? হাত ভেঙে গিয়েছে? উনি কি এখন অন্য গ্রহের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন? সব থেকে খারাপ হল, আপনি মিসড কল পেয়ে যখন ‘কল ব্যাক’ করলেন তখন তিনি “দুসরি কল পর ব্যস্ত রহা হ্যায়”। মনে হয় দৌড়ে গিয়ে একটা চাঁটি মেরে আসি।

শুধু এ সবই নয়, আরও আছে। আপনার মোবাইল নম্বর অনেক সময় আপনার ফোন কোম্পানি পয়সা নিয়ে বিক্রি করে দেয় অন্য সংস্থার কাছে। মারুতি গাড়ির সেলসম্যান থেকে প্রোপারটি ডিলার আপনাকে কল করবে যখন তখন। আজে-বাজে ব্যাংক চাইবে আপনাকে লোন দিতে। ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি জানতে চাইবে ক’দিন আগে আপনি যে সাত হাজার টাকা খরচ করেছেন সেটা সস্তা ইএমআই-এ কনভার্ট করতে চান কিনা। এ সব কল আসবে যখন আপনি ওপিডিতে পেশেন্ট দেখছেন, অথবা সায়েন্টিফিক মিটিংয়ে আছেন। বুঝতে পারবেন না কোনটা দরকারি, কোনটা অদরকারি ফোন। এমনকি শুনেছি, ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছেও নাকি এরকম ফোন আসে। অবশ্য শোনা কথা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৯: পঞ্চমের সুরে লতার গাওয়া ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গান শুনে শুনেই প্রস্তুতি শুরু করেন কিশোর

স্মার্টফোন নিয়েছেন চলছে, ভালো কথা। কিন্তু একবার খারাপ হলে বিশাল ঝামেলা। এদিক ওদিক ঘুরতে হবে সঠিক জায়গা পাবার জন্য যেখানে সারাতে পারবেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওর মায়া ত্যাগ করতে হবে। বলতে হবে ‘হে বন্ধু বিদায়’।

স্মার্টফোন হানিকারক কিনা বা বেশি ব্যবহার করলে ক্যানসার হতে পারে কিনা এসব নিন্দুকেরা বলাবলি করে। না, মোবাইল থেকে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এতে এত কম রেডিয়েশন হয় যে, সেটা নগন্যই বলা যায়। তবে সেদিন মেডস্কেপ নামে একটা ওয়েবসাইটে দেখছিলাম শুয়ে শুয়ে, মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে নাকি অস্থায়ী ভাবে দৃষ্টিশক্তি (টেম্পোরারি ভিশন লস) হারানোর সম্ভাবনা থাকে। এই তথ্য কতদূর সত্যি, তা আমি জানি না। তবে আমার এক শ্রদ্ধেয় লেখক বন্ধুর বউ নিজের মোবাইল ফোনকে ভুল করে জামাকাপড়ের সঙ্গে ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে দিয়েছিলেন। মোবাইল ফোনকে এত অপমান আগে শুনিনি।

স্মার্টফোন আছে ভালো। কিন্তু হারালে ভীষণ বিপদ। ক্রেডিট কার্ড কিংবা এমনকি বউ হারানোর সঙ্গেও তুলনা করা যেতে পারে। বছর তিনেক ধরে জমানো চারশো লোকের কনট্যাক্ট হারিয়ে ফেলবেন এক মুহূর্তে। পড়বেন অথৈ জলে। তাই স্মার্টফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্টের একটা কপি করে কোথাও রেখে দিন। নোটবুকেও রাখতে পারেন। কেন না মোবাইল এখন আকছারই হারাচ্ছে। প্লেনের সিটের পকেটে, কাপড়ের দোকানের ট্রায়াল রুমে, অটোতে, ট্যাক্সিতে রোজ কেউ না কেউ ফোন হারাচ্ছেন।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৩: স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়-বন্ধু সকলের কাছে সব কথা না বললেই শান্তি ও সুস্থিতি বজায় থাকে সংসারে

স্মার্টফোনে কল আসছে ঠিক আছে। এসএমএস কিন্তু সাবধানে করবেন। আমি জানি জিমে ট্রেডমিল করতে করতে এসএমএস করার চেষ্টা করতে গিয়ে একজন পড়ে গিয়ে পা ফ্র্যাকচার করে ফেলেছিলেন। সেদিন একটা অটোতে উঠেছিলাম। অটো ড্রাইভার অটো চালাতে চালাতে টেক্সট করতে শুরু করল। আমি পয়সা দিয়ে নেমে পড়েছিলাম।

মোবাইল অ্যাডিকশন আজকালকার দিনের এক নতুন ব্যাধি। বিশেষ করে ইয়াং জেনারেশনের। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শতকরা ৬৭ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ফোন না বাজলেও তাদের ফোন চেক করেন। জাপানে নাকি ৯০ শতাংশ অল্প বয়সীরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। এমনকি, স্নানের সময়ও তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়। তাই ওদেশের অধিকাংশ মোবাইল নাকি ওয়াটারপ্রুফ।

মোবাইল ফোনের পাল্লায় পড়ে পড়াশুনো গোল্লায় যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের, এ কথা এখন সবাই বলতে শুরু করেছেন। এখন অধিকাংশ স্কুলই ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ নিষেধ করে দিচ্ছে। তাই এই ছোট্ট যন্ত্রটিকে আপনি ব্যবহার করছেন, নাকি যন্ত্রটাই আপনাকে ব্যবহার করছে—সেটা এ বার ভেবে দেখবার সময় এসেছে। সময় এসেছে উত্তর দেওয়ার যে, মোবাইল ফোন আজকে বুন (BOON), না বেন (BANE)। আশীর্বাদ না অভিশাপ? উত্তরটা আপনাকেই দিতে হবে।
* ডাঃ জ্যোতির্ময় বিশ্বাস সাহিত্যের জগতে পদচারণা করেন ডাকনামে। ‘সবুজ বিশ্বাস’ নামে তিনি একাধিক সাহিত্যকেন্দ্রিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাচিক শিল্পেও তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই মুহূর্তে বাচিকশিল্পে আমাদের রাজ্যে যাঁরা স্বনামধন্য, তাঁরা অধিকাংশই ডাঃ বিশ্বাসের বন্ধুস্থানীয়। ছাত্রজীবনে, এই শহরে এমবিবিএস পাঠকালে একসঙ্গে এ-মঞ্চে, সে-মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। পরে পেশাগত কারণে বিদেশযাত্রা ও গবেষণাকর্মের শেষে শংকর নেত্রালয়ে যোগদানের ফলে সেই বাচিকশিল্পের সঙ্গে সেই যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। চেন্নাই শহরের বাঙালিসমাজের যে কোনো অনুষ্ঠানে অবশ্য এখনো তিনি আবৃত্তি পরিবেশন করেন। ডাঃ বিশ্বাস চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বনামধন্য। ভারতের প্রথম শ্রেণির একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের অন্যতম ডিরেক্টর।

Skip to content