শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


বসন্ত সমাগত। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনবার্তা আকাশে বাতাসে। ষড়ঋতুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বসন্তই পারে মনের জীর্ণ পুরাতন আবর্জনা সরিয়ে এক নতুন প্রাণসঞ্চার ঘটাতে। তাই এই সময়ে প্রায় সমস্ত দেশের মানুষ মেতে ওঠেন বসন্ত বা রঙের উৎসবে। দোল বা হোলি উৎসব হিন্দুদের পবিত্র উৎসব হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন অন্য জাতি উপজাতিরাও। শুধু ভারতেই নয় তার বাইরেও রঙের উৎসব পালিত হয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় তার ‘পূজাপার্বণ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘কেহ কেহ দোলযাত্রাকে বসন্তোৎসব মনে করিয়াছেন কিন্তু বসন্তোৎসব নামে কোন উৎসব পাঁজিতে নাই, স্মৃতিতে নাই, পুরাণে নাই। পূর্বকালে মদনোৎসব হইত, বহুদিন অজ্ঞাত হইয়াছে৷’ যদিও এই মদন উৎসব ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হত না। সেটি হত চৈত্র মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে। যুবক-যুবতীরা ওইদিন তাদের সঙ্গী-সঙ্গিনীদের খুঁজে নিতেন। তাদের বসনে ভূষণে যেমন থাকত রঙের ছোঁয়া তেমনি মনেও। এই কারণেই সম্ভবত প্রেমের দেবতা মদনের নাম অনুসারেই উৎসবটির নামকরণ হয়েছিল। তৃতীয়, চতুর্থ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতের প্রায় সব জায়গায় মদন উৎসব অনুষ্ঠিত হত। যদিও বর্তমানে ভারতীয়দের মধ্যে আর বসন্ত উৎসবে প্রেমের দেবতা মদন জড়িয়ে নেই। আছেন প্রেমের প্রতীকরূপী রাধা কৃষ্ণ। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন শ্রীকৃষ্ণ বরসানায় রাধিকার গ্রামে গিয়ে রাধিকা ও তার সখীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই থেকেই এদেশে হোলি খেলা শুরু হয়। তাকে স্মরণ করেই বেশিরভাগ জায়গাতেই বৃন্দাবনের আদলে রং খেলা ও বৈষ্ণব রীতি মেনে কৃষ্ণ পূজা হয়।

এখন প্রশ্ন হল হোলি নামটির উৎপত্তি কবে থেকে? বাৎস্যায়নের রচনায় আমরা দেখেছি হোলি উৎসব হোলিকা নামে পরিচিতি পেয়েছে। এ বিষয়ের সন্ধানে আমাদের ফিরে যেতে হবে পৌরাণিক আখ্যানে। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা। হোলিকা নামের এই রাক্ষুসী প্রহ্লাদকে তাঁর দেবভক্তির কারণে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ বেঁচে গেলেও হোলিকাকে আগুনে পুড়ে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। দোল উৎসবের আগের দিন যে চাঁচর বা চর্চরী উৎসব হয় তা হল আসলে হোলিকার মতো অশুভ শক্তির বিনাশের শেষে শুভশক্তির প্রতিষ্ঠা লাভের উৎসব। চাঁচর বা চর্চরী—এর শব্দগত অর্থ থেকেই বোঝা যায় অগ্ন্যুৎসবাদি হর্ষ ক্রীড়াই হল এই উৎসবের অঙ্গ। এই উৎসবের দেশজ নাম ন্যাড়াপোড়া। ন্যাড়া অর্থে সেই অশুভ শক্তিকেই ইঙ্গিত করে। স্কন্দপুরাণে বলা কৃষ্ণ এই ন্যাড়াপোড়া উৎসবে মাততেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে এই উৎসব বর্ষব্যাপী সঞ্চিত মনের কালিমাকে আহুতি দেওয়ার এক আনুষ্ঠানিক আচার।

এরপরে খুব সংক্ষেপে আসা যেতে পারে দোল এই নামকরণের ব্যাখ্যায়। ‘দোল’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল ‘ইতস্তত দোলন’ বা ‘সঞ্চালন’। পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডের বর্ণনায় এই সময় সর্বপাপ বিনাশক দোলাস্থ বিষ্ণুকে পূজা করবার রীতি আছে। একারণেই বৈষ্ণব মন্দিরগুলিতে তাদের আরাধ্য বিষ্ণুকে দোলমঞ্চে এনে পূজা করা হয়। দোলায়িত বিষ্ণুর পূজার্চনা থেকে দোল নামটি আসতে পারে। এছাড়া ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন থেকে সূর্যদেব উত্তরায়ণ থেকে দক্ষিণায়নে যেতে শুরু করে।সূর্যের এই যে দোলা বা গমন তার থেকেও দোল নাম আসা অসম্ভব নয়।

হোলি বা দোল উৎসব বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় বিভিন্ন ভাবে। বৃন্দাবন, মথুরায় হোলি উৎসব সম্পূর্ণভাবে ব্রজলীলার অঙ্গ। নন্দগ্রাম থেকে এখনও ছেলেরা রং খেলতে যায় রাধার জন্মভিটে বরসানায়। সেখানে চলে মেয়েদের সঙ্গে রং বিনিময়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতি মেনে এখানে কৃষ্ণের পূজার্চনা চলে। অন্যদিকে নবদ্বীপের দোল উৎসবের তাৎপর্য কিছুটা ভিন্ন। দোলযাত্রা ব্রজলীলার অঙ্গ হওয়ার কারণে বৃন্দাবনের সঙ্গে এখানকার উৎসবের মিল রয়েছে ঠিক কিন্তু ১৪৮৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর কোল আলো করে নবদ্বীপের ভূমিকে পুণ্যভূমিতে পরিণত করেন শ্রীচৈতন্যদেব। মাত্র ৪৮ বছর জীবিত থাকলেও সেই স্বল্প সময়ে রচিত হয়েছে বাঙালির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর উদার প্রেমধর্ম মানুষের প্রাণের সম্পদ। তিনি বাঙালিকে শুধু নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন তাই নয় তার উদার বাণী বাঙালিকে নতুন জীবনবোধে জাগরিত করেছিল। এই কারণেই ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে নবদ্বীপ মেতে ওঠে তাদের প্রাণের ঠাকুর গোরার জন্মোৎসব পালন করতে। এই বিশেষ তিথিতে নবদ্বীপের বৈষ্ণবগণ সারাদিন উপবাসে থেকে সন্ধ্যায় সংকীর্তন-সহ সদলে গঙ্গাজল এনে গৌরাঙ্গ দেবের অভিষেকে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। তাদের বিশ্বাস দ্বাপরের শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধারাণীর মিলিত তনুই হচ্ছেন গৌরাঙ্গদেব তথা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। তাই নবদ্বীপের ভক্ত বৈষ্ণবদের কণ্ঠে গীত হয় — ‘এসেছে ব্রজের বাঁকা কালো সখা দেখবি আয় তোদের এই নদীয়ায়/ রঙ ফিরেছে ধঙ ফিরেছে কালো এখন চেনা দায়।’

এভাবেই নদের মানুষ বোঝাতে চান দ্বাপরের কৃষ্ণ রং পরিবর্তন করে কলিযুগে গৌরবর্ণরূপী গৌরাঙ্গে পরিণত হয়েছেন।
দোল উৎসবে মথুরা, নবদ্বীপের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের কথাও উল্লেখ করা জরুরি। এখানে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি একেবারে ভিন্ন । কবিগুরুর কাছে বসন্ত ছিল যৌবনের জয়গান। এখানে দোল কোনও ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ নয়। শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে থাকলেও কবির কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথের হাত ধরেই এই উৎসবের সূচনা হয়। ১৯০৭ সালে এক সরস্বতী পূজার দিন ঋতু উৎসব নামে যে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল তাই পরবর্তীকালে বসন্ত উৎসবে পরিণত হয়। দেশ-বিদেশের বহু মানুষের সমাগম একে সার্বজনীন রূপ দেয়।

বাংলার বাইরেও মহাসমারোহে হোলি উৎসব হয়। উত্তরপ্রদেশ, বিহারে হোলি জনপ্রিয় উৎসব। দক্ষিণ ভারতের মানুষেরাও হোলি উৎসবে মাতোয়ারা হয়। হোলিকা নিধনের পর সেই ছাই দিয়ে এরা টিকা পরে সুস্বাস্থ্যের জন্য। ছত্তিশগড়ের মানুষেরাও এইদিন পুঁতি ও জরি দিয়ে রাজবেশ ধারণ করে।
মাথায় মুকুট পরে নাচ-গান করে। অন্ধ্রপ্রদেশের বানজারা আদিবাসী, রাজস্থানের ভিল আদিবাসীরা নিজেদের মতো করে হোলি উৎসব পালন করে।

এভাবেই কোথাও হোলি, কোথাও দোল, কোথাও বা কালার ফেস্টিভ্যাল বলে অনুষ্ঠিত হয় রঙের উৎসব। রঙে মাখা সব মুখই একরকম। নেই তাতে জাত ধর্মের ভেদাভেদ। তাই রঙের উৎসব এক সার্বজনীন উৎসবের চেহারা নেয়। সমস্ত বিভেদ ঘুঁচিয়ে সকলেই এক আঙিনায় এসে পড়ে। আর সেজন্যই বসন্ত চলে যেতে ফাগ রাঙা মনে ছুঁয়ে যায় বিষাদের সুর। বেজে ওঠে কবির তান—
‘চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন
দূর শাখে পিক ডাকে বিরামহীন।’
ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content