রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


‘…সংসার গহনে নির্ভয় নির্ভর
নির্জনসজনে সঙ্গে রহো
চিরসখা হে, ছেড়ো না মোরে
ছেড়ো না…’


‘চিরসখা’ তো আর সহজে সকলকে বলা যায় না। তাকেই বলতে পারি, যে একাত্ম করে দিতে পারে আমাদের নিজ আত্মার সঙ্গে। নিজেকে চিনিয়ে দিতে, নিজের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারে যেই সুজন তাকেই একমাত্র ‘চিরসখা’ বলা যেতে পারে। ‘ভালোবাসা’ তো অন্বেষণ মাত্র, সকলেই খুঁজে চলেছে, খুঁজছে অনন্তকে। খুঁজে চলে মনের মানুষকে। সর্বদা এই আবিষ্কারের নেশায় মত্ত মানুষ। আসলে মানুষ খুঁজে চলে নিজেকে। কখনও মন মেলে, কখনও শরীর। কখনও শরীরে-মনে মিলিত হয়ে যায়। তবুও সে ভালোবাসার জন আমরণ থাকে না, হয় না চিরস্থায়ী। হয়তো ভিড়ে হারিয়ে যায় কিংবা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় একে অপরের থেকে। কিন্তু এই ‘চিরসখা’ লুকিয়ে থাকে নিজ অন্তরেই। আমরা আসলে খুঁজি আমাদের ছায়াকেই। ‘অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল’ একথা বলার মধ্যেই আশ্রয় খোঁজা। আর আমাকে একমাত্র আশ্রয় দিতে পারি তো ‘আমি’ই! ‘আমি’ই হতে পারি আমার শান্তির সেই নীড়। আমরা অবলম্বন তো করি তাকেই, যাকে নিজের মতই লাগে, আর যাকে নিজের মনে সেই আসন পেতে বসাই সেই চিরনূতন ‘চিরসখা’। কবিগুরুকে ছাড়া আর কাউকেই বসাতে পারি না সেই জায়গায়। তিনিই আমাদের অধনের ধন, অবলের বল, অনাথের নাথ।
সেই এক পঁচিশে বৈশাখের শুভলগ্নে শুধুমাত্র পূর্বগগনে নয়, বিশ্বজুড়ে যে রবির উদয় হয়েছিল তার অস্ত হয়নি আর। প্রতিদিন আমাদের প্রতিজনের জীবন সেই রবি কিরণে আলোকিত হয়ে চলেছে। বারবার তাঁরই কথা তাঁকে বলতে ইচ্ছে হয়।
‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো,
সেই খানে যোগ তোমার সাথে আমারও৷’

সবুজ-ঘেরা উপাসনা মন্দির, শান্তিনিকেতন। সকল প্রার্থণা যেখানে মুক্ত ধারায় বয়ে চলে। ছবি: লেখক

যিনি তাঁর প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সাদা ক্যানভাসকে রঙের আলোয় সজীব করে তোলেন তিনি কবি, কিন্তু উচ্চতর কবি তিনি যিনি রঙের বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিতৃপ্তির সুর আনেন। যিনি জীবনের সত্যকে সুন্দর করে ব্যক্ত করেন তিনি কবি, কিন্তু উচ্চতর কবি তিনি যার কবিতায় সেই জীবন জয়ের গীতিকে সুগম্ভীরভাবে ব্যক্ত করেন। যিনি ছন্দের মাধ্যমে সত্যের প্রতিষ্ঠা করেন পাঠকের মনে তিনি কবি, যাঁর নিজের আনন্দের এত বিস্তার পাঠক তার কণামাত্র আস্বাদন করে অনন্ত অপেক্ষায় নিমজ্জিত হতে থাকে তিনিই উচ্চতর কবি—বিশ্বকবি।

প্রতিবছরই পঁচিশে বৈশাখের এই দিনটিতে যেন আকাশে বাতাসে, প্রতিটি ধূলিকণায়, সংগীতের মূর্ছনায়। প্রস্ফুটিত সকল পুষ্পকোষে, ধূলায়িত সকল পুষ্পপত্রে যেন চিরনূতনের ডাক প্রতিভাত হয়। কবির উপস্থিতি এত প্রকটভাবে অনুভূত হয় আজও, মনে হয় শুধু জন্মই হয়েছিল তাঁর। কিন্তু মৃত্যুহীন তিনি। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পর থেকে তাঁদের পরিবারে জাতকর্ম থেকে আরম্ভ করে সকল অনুষ্ঠান অপৌত্তলিক প্রণালীতে সম্পন্ন হতে শুরু করেছিল।

তিনি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁর নামকরণ উৎসবে একটি পিঁড়িতে তাঁর নাম লিখে নামের চতুর্দিকে ছিদ্র করে করে তাতে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছিল। আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয়েছিল তাঁর নাম, এটাই নাকি ছিল তাঁর শ্রদ্ধালু পিতা মহর্ষির আশীর্বাদ কবির প্রতি। যে আলোক সেদিন প্রজ্বলিত হয়েছিল তাঁর নামের তা চিরন্তনী মন্ত্রে মন্ত্রিত ছিল সেই শুভক্ষণেই। যা আর নেভেনি কোনওদিন। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তন-মনন-আবেগ-সুখ-শান্তি-স্বস্তি-ক্লান্তি-কল্পনা ইত্যাদির অথবা অস্তিত্বের মৃত্যু হতেই থাকে, কিন্তু প্রতিটা মৃত্যুর পর প্রাণ এনে দেন যে জন্মদাতা তিনিই রবীন্দ্রনাথ। জীবনের প্রতিটা ঝড়, বিষাদ, অন্ধকারে বা বহু কঠিনত্বে তাঁর বাণীই সহজ পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলে আবারও। অপরপক্ষে, প্রতিটা প্রেম, পূজা, শুভ অনুভূতি তিনি ছিলেন বলেই আরও বেশি করে অনুভূত করতে শিখেছি। কোনও এক এমন দিনে তাঁর জন্ম হয়েছিল রেবতী নক্ষত্রে। আজও সেই নক্ষত্র একইভাবে প্রজ্বলিত মধ্যগগনে… তাঁর শুভ জন্মদিনে আমাদের শুভত্বের এমনই এক ক্ষণে তাঁকেই অর্পণ করা যায় তাঁর এই পংক্তিগুচ্ছ—
‘ভুবন বলে তোমার তরে আছে বরণমালা
গগন বলে তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা৷’

Skip to content