শাস্ত্রীয় নৃত্যজগতের অন্যতম কাণ্ডারি বিরজু মহারাজ। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
শাস্ত্রীয় নৃত্যজগতের অন্যতম কাণ্ডারি বিরজু মহারাজজির দেহাবসান হয়েছে গত ১৬ জানুয়ারি। মঞ্চ আজ শোকস্তব্ধ, থেমে গেল চিরতরে ‘লয়ের পুতুল’-এর ঘুঙুর। তাঁর বিদায়কালে এহেন অভাবনীয় শিল্পীসত্তার প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
মুখ দামিনী সি দমখত চল মাতয়ারি
চল মাতয়ারি, চল মাতয়ারি’
ঝাড়বাতির চতুর্ভেদী আলোর ছটায় সুসজ্জিত এক ‘রঙমহাল’এ জুঁই, রজনীগন্ধা আর আতর সুবাসিত পথ ধরে এসে দাঁড়ালেন যিনি তাঁর চলনে শাস্ত্রীয় শিক্ষার স্পর্শ যেন পরতে পরতে। দু পায়ে দুশো দুশো চারশো ওজনের ঘুঙুর নিয়ে যথাযথ সেলামির পর তিনি আরম্ভ করবেন গৎ ভাও, অতঃপর তালের রাজার আরাধনার মাধ্যমে আরম্ভ হবে তৎকার ও পরণ, তোড়া, চক্রদর তোড়সহ এক নিটোল শাস্ত্রীয় নৃত্যের পরিক্রমা। কিন্তু শিল্পীর আগমন পরবর্তী সেলামির পরেই কেটে গেল পরিবেশে ও প্রতিবেশের তাল লয়, ছন্দ। সামনে বসে থাকা পুরুষ দর্শকদের মধ্যে থেকে ধেয়ে এল অসুস্থ উল্লাসের আক্রমণ, দাঁত-নখ বসানো একটি সম্বোধন ‘বাইজি’ সমস্ত শিক্ষার, শিল্পীর সমস্ত অধ্যবসায়কে এক হেঁচকা টানে রক্তাক্ত করে নামিয়ে আনল যেন পঙ্কিল জলাভূমির আবর্তমাঝে। বাইজি শব্দের মূলগত অর্থ কী ছিল বা অর্থের সংকোচনের ফলে তার আজ এই অবনতি কেন? কোন বিশেষ আর্থ-সামাজিক লিঙ্গবৈষম্য বা জৈবিক নির্ধারণবাদ তাকে এই পর্যায়ে উন্নীত করেছে সে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন আলোচনা। সে আলোচনায় আমাদের এই মুহূর্তে যাওয়ার সুযোগ নেই, পরে কখনও সময় সুযোগ হলে নিশ্চয়ই এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। কিন্তু আমাদের এই মুহূর্তের আলোচনার যে বিষয় এবং যিনি বিষয়ী তাঁকে নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে মাথা নত করে দাঁড়াতে এই সম্ভাষণের যে পঙ্কিলতা সেই পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে, নতমস্তকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে উত্তর ভারতের এই প্রাচীনতর শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীর কাছে এবং তাকে লালন করে এসেছেন যারা নিজেদের অন্তরাত্মার সঙ্গে একীভূত করে সেই শিল্পীদের কাছে। আমরা ‘কথক’-এর কাছে চিরঋণী যে ঋত অজস্র অবমাননার পরেও আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে আমরা তার সান্নিধ্য পেয়েছি কখনও সখনও। প্রারম্ভে এই ক্ষমা চাওয়ার কারণ হল যাঁকে স্মরণ করে লিখতে বসা তাঁর শিকড়, তাঁর পরিচয় সমস্তকিছুই নিহিত রয়েছে এই বিশিষ্ট নৃত্যশৈলীটির মধ্যে। তিনি পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর যাঁকে ‘লয়ের পুতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। লখনউ ঘরানার প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী ছিলেন কথকের ‘মহারাজ’। ১৯৩৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কথকের মহারাজা পরিবারে জন্ম তাঁর। জন্মসূত্রে নাম ছিল বৃজমোহন নাথ মিশ্র। সাতপুরুষ ধরে যে পরিবারের সঙ্গে নৃত্যের সম্পর্ক সেই পরিবারের উত্তরাধিকারী হিসাবে যে মহারাজজিও নৃত্যের যথার্থ সন্তান হয়ে উঠবেন সেকথা বলাই বাহুল্য। শৈশবেই আরম্ভ হয় তালিম বাবা অচ্ছন মহারাজের কাছে। ১৩ বছর বয়সেই দিল্লির সংগীত ভারতীতে আরম্ভ করেন নৃত্যশিক্ষা। কলকাতার সঙ্গে যোগ ছিল নিবিড়। কলকাতাতেই ১৯৫২ সালে মন্মথনাথ ঘোষের বাড়িতে প্রথম মঞ্চানুষ্ঠান করেন। ততদিনে পিতৃবিয়োগ হয়েছে, লড়াই আরম্ভ হয়েছে নিজের মতো করে। পরবর্তীকালে রামপুর নবাবের দরবারেও বহুদিন নৃত্য প্রদর্শন করেছেন তিনি। মাত্র ২৮ বছর বয়সে পান সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। তারপর ১৯৮৩ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে সম্মানিত হন এবং পরবর্তীকালে কালিদাস সম্মান, বঙ্গবিভূষণ সহ পেয়েছেন আরও অনেক সম্মান।
বহু চলচ্চিত্রে কোরিওগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছেন তিনি। তার মধ্যে উল্লেখ্য হল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ ছবিতে দুটি গানে তার কোরিওগ্রাফি, যার মধ্যে ‘কানহা ভে তোসে হারি’ অন্যতম স্থান দখল করে আছে। ‘বিশ্বরূপম’ ছবির জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। দেবদাস ছবিতে ‘কাহে ছেড় ছেড় মোহে’-তে এক অনন্য নৈসর্গিক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল পণ্ডিতজির নৃত্যভঙ্গিমা, অভিব্যক্তির মাধ্যমে, একথা স্বয়ং মাধুরী দীক্ষিত নিজে স্বীকার করেছিলেন।
কেবল কথক নয়, কথক ছাড়াও শাস্ত্রীয় কণ্ঠসঙ্গীত ও তবলাতেও সমান পারদর্শী ছিলেন। কণ্ঠশিল্পী অনির্বাণ ভট্টাচার্য নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলছেন—‘৩, ৪ বছর আগে ওঁর ৮টি গান নিয়ে আমরা বন্দিশ-ই-বৃজশ্যাম করেছিলাম। বৃজশ্যাম ওঁর ছদ্মনাম বলা যেতে পারে, যার মানে কৃষ্ণ। উনি যখন স্টেজে ঢুকতেন সংগীতে, সেতারে, শিষমুকুটে ইন্ট্রো মিউজিক বাজত। মনে হত সত্যিই স্টেজের ওপর ভগবান কৃষ্ণ প্রকট হয়েছেন। ‘কাহে ছেড় ছেড় মোহে’র মুখড়ার শুরুটুকুও পণ্ডিতজির নিজের কণ্ঠে গাওয়া। এহেন ছন্দময় মানুষের পা এবং কণ্ঠ থেমে গেল চিরতরে। যেন লয়হীন হয়ে গেল শাস্ত্রীয় নৃত্যের জগৎ। গত রবিবার অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি নাতির সঙ্গে খেলা করতে করতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, হাসপাতালে নিয়ে গেলেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
আমাদের জগতে আজও নৃত্যের সমঝদার যে সেভাবে নেই সেকথা স্পষ্টভাবে বলতে কোনও কষ্ট অন্তত আমার নেই। রিয়্যালিটি শোয়ের মঞ্চে নাচ এখন জিমন্যাস্টিক্স এবং গ্ল্যামার জগতের চাবিকাঠির নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে এতদিন পর্যন্ত মহিলা নৃত্যশিল্পীদের চোরাগোপ্তা পথে অপমান করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন মানুষজন। শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পীদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে জগৎ কতটা অগ্রগামী ছিল বরাবর সেকথা তো শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। আফসোস শুধু এইটুকুই লয়ের পুতুল এবং তার চর্চিত শিল্পকে আমরা এতকাল অবমাননার হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি। আজ অন্তত তাঁর সম্মান রক্ষার্থে এই প্রচেষ্টায় আমাদের ব্রতী হওয়া উচিত যে আমরা শিল্পের মর্যাদায় কোনও অভাব রাখব না। শিল্পীর পরিচয়ে তার চর্চিত শিল্পের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়, তার লিঙ্গ বা ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে তার কোনও প্রতিফলন ঘটে না, অন্তত এইটুকু স্বীকার করে শিল্পীর প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মানে, নতমস্তকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোক ভারতীয় সমাজ যে শিল্পী শিল্পীর মর্যাদায় তার জীবন অতিবাহিত করবেন, এই সম্মান এবং অধিকার রাষ্ট্র এবং সমাজ তাকে দেবে, আগামীর প্রতি এই অঙ্গীকার আমরা পালন করে যাব নিঃস্বার্থভাবে, এটাই আমাদের প্রথম এবং অন্যতম সামাজিক কর্তব্য।
বহু চলচ্চিত্রে কোরিওগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছেন তিনি। তার মধ্যে উল্লেখ্য হল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ ছবিতে দুটি গানে তার কোরিওগ্রাফি, যার মধ্যে ‘কানহা ভে তোসে হারি’ অন্যতম স্থান দখল করে আছে। ‘বিশ্বরূপম’ ছবির জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। দেবদাস ছবিতে ‘কাহে ছেড় ছেড় মোহে’-তে এক অনন্য নৈসর্গিক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল পণ্ডিতজির নৃত্যভঙ্গিমা, অভিব্যক্তির মাধ্যমে, একথা স্বয়ং মাধুরী দীক্ষিত নিজে স্বীকার করেছিলেন।
কেবল কথক নয়, কথক ছাড়াও শাস্ত্রীয় কণ্ঠসঙ্গীত ও তবলাতেও সমান পারদর্শী ছিলেন। কণ্ঠশিল্পী অনির্বাণ ভট্টাচার্য নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলছেন—‘৩, ৪ বছর আগে ওঁর ৮টি গান নিয়ে আমরা বন্দিশ-ই-বৃজশ্যাম করেছিলাম। বৃজশ্যাম ওঁর ছদ্মনাম বলা যেতে পারে, যার মানে কৃষ্ণ। উনি যখন স্টেজে ঢুকতেন সংগীতে, সেতারে, শিষমুকুটে ইন্ট্রো মিউজিক বাজত। মনে হত সত্যিই স্টেজের ওপর ভগবান কৃষ্ণ প্রকট হয়েছেন। ‘কাহে ছেড় ছেড় মোহে’র মুখড়ার শুরুটুকুও পণ্ডিতজির নিজের কণ্ঠে গাওয়া। এহেন ছন্দময় মানুষের পা এবং কণ্ঠ থেমে গেল চিরতরে। যেন লয়হীন হয়ে গেল শাস্ত্রীয় নৃত্যের জগৎ। গত রবিবার অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি নাতির সঙ্গে খেলা করতে করতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, হাসপাতালে নিয়ে গেলেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
আমাদের জগতে আজও নৃত্যের সমঝদার যে সেভাবে নেই সেকথা স্পষ্টভাবে বলতে কোনও কষ্ট অন্তত আমার নেই। রিয়্যালিটি শোয়ের মঞ্চে নাচ এখন জিমন্যাস্টিক্স এবং গ্ল্যামার জগতের চাবিকাঠির নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে এতদিন পর্যন্ত মহিলা নৃত্যশিল্পীদের চোরাগোপ্তা পথে অপমান করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন মানুষজন। শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পীদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে জগৎ কতটা অগ্রগামী ছিল বরাবর সেকথা তো শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। আফসোস শুধু এইটুকুই লয়ের পুতুল এবং তার চর্চিত শিল্পকে আমরা এতকাল অবমাননার হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি। আজ অন্তত তাঁর সম্মান রক্ষার্থে এই প্রচেষ্টায় আমাদের ব্রতী হওয়া উচিত যে আমরা শিল্পের মর্যাদায় কোনও অভাব রাখব না। শিল্পীর পরিচয়ে তার চর্চিত শিল্পের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়, তার লিঙ্গ বা ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে তার কোনও প্রতিফলন ঘটে না, অন্তত এইটুকু স্বীকার করে শিল্পীর প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মানে, নতমস্তকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোক ভারতীয় সমাজ যে শিল্পী শিল্পীর মর্যাদায় তার জীবন অতিবাহিত করবেন, এই সম্মান এবং অধিকার রাষ্ট্র এবং সমাজ তাকে দেবে, আগামীর প্রতি এই অঙ্গীকার আমরা পালন করে যাব নিঃস্বার্থভাবে, এটাই আমাদের প্রথম এবং অন্যতম সামাজিক কর্তব্য।