বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


অবনীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ বই-ই শিশুসাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত। ছোটদের নিতান্ত ছোট ভেবে অবজ্ঞায়, অবহেলায় লেখা নয়, রীতি মতো দরদ দিয়ে, আন্তরিকতার সঙ্গে লেখা। রয়েছে বিষয়গত বৈচিত্র্য, উপস্থাপনে অভিনবত্ব। বলা যায়, অবনীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গতানুগতিক শিশুসাহিত্যের নতুনত্ব আসে, প্রাণসঞ্চার হয়!

অবনীন্দ্রনাথকে তাঁর ‘রবিকাকা’ এনেছিলেন সাহিত্যের অঙ্গনে। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধেই রচনারম্ভ। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে রয়েছে সে-বিবরণ। একদিন উনি বললেন, ‘তুমি লেখো না, যেমন করে তুমি মুখে গল্প করো, তেমনি করে লেখো। আমি ভাবলুম, বাপরে লেখা— সে আমার দ্বারা কস্মিনকালেও হবে না। উনি বললেন, তুমি লিখোই না, ভাষার কিছু দোষ হয় আমিই তো আছি।’

রবীন্দ্রনাথের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ‘এক ঝোঁকে’ লিখে ফেললেন প্রথম বই ‘শকুন্তলা’। লেখার পর দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। আগাগোড়া খুঁটিয়ে পড়ে একটিও শব্দ বদল করেননি ‘রবিকাকা’। প্রবলভাবে উৎসাহিত হয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। সেই আনন্দ-অনুভূতি প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘প্রথম জানলুম আমার বাংলা বই লেখার ক্ষমতা আছে।’
‘শকুন্তলা’র প্রকাশ বছরে ১৮৯৫-তে সুকুমার রায়ের সাহিত্যের আসরে আবির্ভাব। তখন তিনি নিতান্তই ছোট, আট বছরের বালক। শিবনাথ শাস্ত্রী ‘মুকুল’-এ প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা, ‘নদী’। অবনীন্দ্রনাথ-উপেন্দ্রকিশোর -রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল উপস্থিতি বাংলা শিশুসাহিত্য অচিরেই আলোকিত হয়ে ওঠে।

অবনীন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই ব্যতিক্রম। স্বাতন্ত্র্য উজ্জ্বল। তিনি জানতেন, শিশুকাল ন্যাকামি দিয়ে আপনাকে ব্যক্ত করে না, সে যথার্থই ভাবুক এবং আপনার চারিদিকে সে সত্যই হৃদয় দিয়ে ধরতে চায়, এবং বোঝাতে চায়।’ ‘রংমশাল’-এ প্রকাশিত এই বক্তব্য যোলোআনা। সত্যি! সেই সত্যতা ধরা পড়েছে অবনীন্দ্রনাথের রচনাতেও। বোধের এই স্বচ্ছতা অবনীন্দ্রনাথের রচনাকর্মে যে এক স্বাতন্ত্র্য মাত্রা যুক্ত করেছিল, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। মৌলিক রচনা বলতে যা বোঝায়, অবনীন্দ্রনাথের প্রায় গল্প-উপন্যাস তা নয়। কাহিনি কখনও গৃহীত হয়েছে পুরাণ, লোকসাহিত্য থেকে, কখনও ইতিহাস বা বিদেশি-রচনা থেকে। প্রভাবিত রচনা, তা সত্বেও প্রতিটি লেখাতেই রয়েছে মৌলিকতা আশ্চর্য মোড়ক, দেশজঘ্রাণ। রূপকথার ঢঙে লেখা, মনে হয়, পাশে বসে গল্প বলছেন বোধ হয়। অনেক লেখাই শিশু-উপযোগী, কিছু বালক-কিশোরপাঠ্য। অদ্ভুত সুন্দর উপস্থাপন, বারবার মূর্ত হয়ে উঠেছে অবনীন্দ্রনাথের নিজস্বতা, মৌলিকতা। ‘শকুন্তলা’ দিয়ে অবনীন্দ্রনাথের রচনারম্ভ পরিণত বয়সে। চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি তখন খ্যাতির শিখরে। শুধু রং-তুলিতে নয়, শুরু হয় গল্প-উপন্যাসে ছবি আঁকা। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে ‘ছবির রাজা ওবিন ঠাকুরে’র নতুনতর পথ পরিক্রমা।

অবনীন্দ্রনাথ তাঁর সোনালি শৈশব, ছেলেবেলাকে আজীবন ধরে রেখেছিলেন, আশ্চর্য দক্ষতায়। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, তাঁর ‘মাসি’ গল্পের সেই চরিত্রটির কথা। অবুর কথা। মাসিকে অবু বলেছে, ‘মাসি, আমার মনে হয় আমি ঠিক তেমনই আছি, ছোট্টটি। অবুই যেন অবনীন্দ্রনাথ। পরিণত বয়সে তাঁর মনে হয়েছে, ‘এখনো এক একদিন স্বপ্ন দেখি যেন বাবা-মশায় ফিরে এসেছেন, আর আমি ছোট্ট বালকটি হয়ে গেছি। একেবারে নিশ্চিন্ত। আনন্দে ভরপুর হয়ে যাই স্বপ্নেতে। এ স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি।’ মনের বয়স বাড়তে দেননি বলেই অবনীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সবকিছুই রঙিন, স্বপ্নালু‌। অনুকরণীয় প্রকাশভঙ্গি, মায়াময় তাঁর গল্প-উপন্যাসের উপস্থাপন।
অবনীন্দ্রনাথের প্রথম বই ‘শকুন্তলা’ মৌলিক রচনা নয়। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত। মূল গল্পটি বহুব্যবহৃত, বহুচর্চিত। চির-চেনা কাহিনীটুকু অবনীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন। শকুন্তলার গল্প আছে মহাভারতে, আছে কালিদাসের নাটকে এমনকি ভাগবতে, পদ্মপুরাণে। অনেক অনেক পরে কালিদাসের নাটকটিতে গদ্যকাহিনির আকারে পরিবেশন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ ছোট নাটক নয়। সাত অঙ্কের। অবনীন্দ্রনাথের ‘শকুন্তলা’ খুবই ছোটো লেখা, এক ফর্মার বেশি নয় কিছুতেই। বলা যায়, কালিদাসের সংক্ষিপ্তরূপ। শিল্পীর সামান্য আঁচড়ে বিন্দুতে সিন্ধু স্বাদ মিলেছে। উপস্থাপনের মধ্যে বারবারই মূর্ত হয়ে উঠেছে অবনীন্দ্রনাথের নিজস্বতা, মৌলিকতা। অবনীন্দ্রনাথের ‘শকুন্তলা’ আগাগোড়া শিশু- উপযোগী। রূপকথার ভঙ্গিতে, গল্প বলার ঢঙে, কথকতার মেজাজে লেখা। দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা প্রেম, পরিণয় সবই বলা হয়েছে অনায়াসে, সাবলীলভাবে। শকুন্তলার প্রকৃতি -প্রীতি হরিণশিশুর জন্য তার কাতরতা সহজেই মুগ্ধ করে। দুষ্মন্ত যে আসলে প্রেমিকপুরুষ তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আগাগোড়া নিপুণ-হাতে রূপকথার মেজাজ রক্ষিত হওয়ায় বড়দের বিষয়ক ছোটোদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে না। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় এসব এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সাবলীলতায় কখনও ঘাটতি পড়েনি।

কালিদাসের নাটকের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ বড় মিল চিত্রধর্মিতা। দু’জনের রচনাই চিত্ররূপময়। দুজনেই যেন ‘ছবি লেখেন’। শুধু ‘শকুন্তলা’র ক্ষেত্রে নয়, একথা অবনীন্দ্রনাথের সমস্ত গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আগাগোড়া তিনি চিত্রময়। অবনীন্দ্রনাথ জানতেন, ছবির ভাষা ‘অনেকটা সার্বজনীন ভাষা’।

‘কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল!’ ‘রবিকাকা’-র অনুপ্রেরণায় প্রথম লিখতে বসে অবনীন্দ্রনাথ সেই কালিদাসেরই শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর হাতে ‘শকুন্তলা’র আধুনিকীকরণ ঘটেছিল, বলা যায়। অবনীন্দ্রনাথের আশ্চর্য ক্ষমতায় কালিদাসের প্রভাব ধুয়েমুছে ‘শকুন্তলা’ হয়ে উঠেছে আশ্চর্য মৌলিক। অবনীন্দ্রনাথের সব লেখারই কাহিনি-সার অন্য কোনও সূত্র থেকে গৃহীত হলেও এই মৌলিকতার আলোর কখনও কোথাও ঘাটতি পড়েনি।

ঠাকুর -পরিবার পরিকল্পিত ‘বাল্যগ্রন্থাবলী’ সিরিজের তৃতীয় বই ‘ক্ষীরের পুতুল’। অবনীন্দ্রনাথ কাহিনি নিয়েছিলেন কবিপত্নীর সংগ্রহ থেকে। ‘শিশুদের রবীন্দ্রনাথ’ নামের এক নিবন্ধে অবনীন্দ্রনাথই জানিয়েছেন, ‘তিনি (রবীন্দ্রনাথ) কাকীমাকে দিয়ে অনেক রূপকথা সংগ্রহ করিয়েছিলেন। কাকীমা সেই রূপকথাগুলি একখানি খাতায় লিখে রাখতেন, তাতে অনেক ভালো ভালো রূপকথা ছিল। তাঁর সেই খাতাখানি থেকেই আমার ‘ক্ষীরের পুতুল’ গল্পটি নেওয়া।’ দুঃখের বিষয়, বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে থেকে শুরু করে সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ করেও মৃণালিনী দেবীর সে-খাতার সন্ধান পাইনি। সে খাতা সম্ভবত হারিয়েই গিয়েছে।
লৌকিক আখ্যান কথকতার মেজাজে ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ যথারীতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অবনীন্দ্রনাথ মুখে মুখে ভালো গল্প বলতে পারতেন। তা নানা জনের স্বীকারোক্তিতে রয়েছে। প্রসঙ্গত অবনীন্দ্র-কন্যা উমা দেবীর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ‘বাবার কথা’ বইতে তিনি লিখেছেন, ‘বাবার মুখে গল্প শুনতে কী ভালোই লাগতো আমাদের। কী যে ভাব দিয়ে বলতেন তিনি। দুঃখের সময় কাঁদাতেন, হাসির সময় হাসাতেন। তাঁর বলার ভঙ্গীতে এমনই যাদু ছিল, আমরা শুনতে শুনতে তাঁর সেই গল্পের রাজ্যেই চলে যেতুম।’

‘ক্ষীরের পুতুল’- এ শুধু লৌকিক আখ্যানই সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়নি, ছেলেভুলানো প্রচলিত ছড়াও সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। গদ্যের মাঝে ছড়া -পংক্তি ব্যবহৃত হওয়ায় কাহিনিতে লৌকিক সুর যেন আরও দৃঢ় হয়েছে। বানর ষষ্ঠীঠাকুরনের কাছে দিব্যদৃষ্টি পেয়েছে। সেই দৃষ্টি তাকে পৌঁছে দিয়েছে এক ‘নতুন দেশ, স্বপ্নের রাজ্যে’। অবনীন্দ্রনাথের যেন ‘ছড়ার মন্ত্রে বাংলাদেশের প্রতিমায় প্রাণ দিয়েছেন।’

লোকসাহিত্যের প্রতি বরাবরই রবীন্দ্রনাথের প্রবল আকর্ষণ। তিনি নিজে বহু প্রচলিত ছড়া সংগ্রহ করেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথকে দিয়েও করিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের লোকসাহিত্য -প্রীতি জাগ্রত করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। লোকসাহিত্যের প্রতি অন্তরের প্রীতি ছিল বলেই দুওরানি -সুওরানির চিরায়ত আখ্যান অবনীন্দ্রনাথের হাতে এক নতুনতর ব্যঞ্জনায় দীপ্ত হয়ে উঠেছে‌। গোটা ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর প্রায় প্রতিটি পংক্তিতে রয়েছে চিত্রা-সমাহার। ‘ক্ষীরের পুতুল’ শুধু পড়ার নয়, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চোখ বন্ধ করে দেখারও। পড়তে পড়তে, সে-সব ছবি দেখতে দেখতে ছোটদের মন খুব সহজেই এক স্বপ্নময় জগতে পৌঁছে যায়।

‘শকুন্তলা’ বা ‘ক্ষীরের পুতুল’ -এর মতো ‘ভূতপতরীর দেশ’ও ছোটোদের খুব প্রিয় বই। অবনীন্দ্রনাথের পুরী ভ্রমণের স্মৃতি ছড়িয়ে, জড়িয়ে আছে এ-বইতে। অবনীন্দ্রনাথের অনেক রচনারই বিষয়বস্তু এমনতরো আজগুবি, উদ্ভট আখ্যানের সঙ্গে কল্পনার মিলমিশে তার হয়ে উঠেছে পরম উপভোগ্য ‘ভূতপতরীর দেশ’-এ যাত্রাপথের গা- ছমছমে যে বর্ণনা রয়েছে, তা বড়ই উপভোগ্য! সত্যিই নাকি পুরী থেকে কোনারকের যাত্রাপথে ভূতের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল। কন্যা উমা দেবীর বইতেও আছে এই অবিশ্বাস্য তথ্য। হয়তো আলো-আঁধারিতে চোখের ভুল! সেই ভুলটুকু কাহিনীতে সজীব, সে-কারণেই তা ছোটদের কাছে শুধু নয়, বড়দের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে সন্ধিহান হলেও ভূতের গল্প পড়তে কে না ভালোবাসে!

‘নালক’-এ অবনীন্দ্রনাথের অবলম্বন জাতক- কাহিনি। ‘নালক’ যেন এক কবির দেখা স্বপ্ন-ছবি। শুধু দেখা নয়, সকলকে দেখানোরও। ‘নালক’-এর সারা কাহিনি জুড়ে রয়েছে স্বপ্নকথা। কাহিনিটি অতি পরিচিত। বহুপঠিত, বহুশ্রুত। কপিলাবাস্তুর রাণীর স্বপ্নদর্শন। পুত্রলাভ। পুত্রের নামকরণ করা হয় সিদ্ধার্থ।

মায়াদেবীর চমৎকার স্বপ্ন দর্শনের বোধ ও অনুভূতি পাঠকমনে সহজেই সঞ্চারিত হয়। এক স্বপ্ন ঘোরেই যেন ‘নালক’-কাহিনি পড়া হয়ে যায়। অবনীন্দ্রনাথ বাড়ির ছোটদের ‌কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন,’ স্বপ্ন দেখিস না?’ এই প্রশ্নের পর দিয়েছিলেন সুপরামর্শ, ‘স্বপ্নগুলো লিখে ফেল, দেখবি গল্প আপনি এসে যাবে।’
শুধু শব্দ তুলিতে ছবি নয়, রং-তুলিতে বৌদ্ধজীবন নিয়েও ছবি এঁকেছেন অবনীন্দ্রনাথ‌। তাঁর আঁকা বুদ্ধের গৃহত্যাগ, সন্ন্যাসী বা নির্বাণ -পর্যায়ে ছবিগুলো ‘নালক’ রচনাকালের প্রায় সমসাময়িক। ‘নালক’-এ বিচ্ছিন্ন এই ছবিগুলির মধ্যে একটি যোগসূত্রের সন্ধান করেছেন ‌অবনীন্দ্রনাথ।
টডের রাজস্থান যুগে যুগে কালে কালে বাঙালি কবি -লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছে। নানা সময় নানা জন রচনা করেছেন উপন্যাস -ছোটগল্প -নাটক, এমনকি কাব্য -কবিতাও। টডের রাজস্থান থেকে মূল কাহিনি গ্রহণ করে প্রথম নাটক লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সে-নাটকের নাম ‘কৃষ্ণকুমারী’। টড- কাহিনি অবলম্বনে প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। সে- উপন্যাসের নাম ‘দীপনির্বাণ’।

অবনীন্দ্রনাথ টডের রাজস্থানে বর্ণিত আখ্যানের সামান্যও বিকৃত করেননি। শুধুমাত্র গল্পের প্রয়োজনে গ্রহণ- বর্জন করেছেন মাত্র। নীরস ইতিহাস বর্ণনার গুণে হয়ে উঠেছে প্রায়- রূপকথা। পদ্মিনী -কাহিনি বাংলা সাহিত্যে বহুচর্চিত। এ- কাহিনিটিকে সর্বজন উপভোগ্য করে উপস্থাপন সহজ কাজ নয়, সেই শক্ত কাজটি সহজেই অনায়াস দক্ষতায় করেছেন অবনীন্দ্রনাথ। প্রকাশভঙ্গি তাঁর বড়ো সহায়ক হয়ে উঠেছে। রূপকথার আমেজ ছড়ানো রয়েছে সমগ্ৰ গল্পে বাপ্পাদিত্যের আখ্যানটি কিশোর-তরুণ পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে। গল্পের রোমান্স মনে মনে সঞ্চারিত হওয়ায় পাঠক পুলকিত হয়। আবার বিচলিত হওয়ার মতো ঘটনাও কম নেই, যা বেদনায় কাতর করে। শিলাদিত্য, গোহ, হাম্বির, রানাকুম্ভ—এমন কত না চরিত্রের ভিড়। ঘটনার ঘনঘটায়, নাটকীয়তায় ‘রাজকাহিনি’ খুবই আকর্ষণীয়। শিশু সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, তা অবশ্য রাজকাহিনি নয়। একই কথা বলতে হয় ‘আলোর ফুলকি’ প্রসঙ্গেও।

অবনীন্দ্রনাথের উদ্ভটরসের সাহিত্য- সৃষ্টির প্রয়াস শুরু হয় ‘ভূতপতরীর দেশ’-এ, তা পূর্ণতা পায় ‘খাতাঞ্চির খাতা’য় খাতা। ‘খাতাঞ্চির খাতা’ ছাপা হয়েছিল ‘সন্দেশ’-এ। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এ লেখার ছবি এঁকেছিলেন স্বয়ং সুকুমার রায়। না, রচনাটি মৌলিক নয়, পিটার প্যানের একটি আখ্যান যে লেখার প্রেরণা, তা গোপন থাকেনি। মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কিশোর সঞ্চয়ন’-এ ‘খাতাঞ্চির খাতা’কে ‘শিশু উপন্যাস’ বলেছেন। নির্ভেজাল উপন্যাস বলতে যা বোঝায়, তা নয় খাতাঞ্চির খাতা’। অবনীন্দ্রনাথের কোনও লেখায় সে অর্থে আঙ্গিক সিদ্ধ উপন্যাস নয়। মোট পাঁচটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই দীর্ঘ আখ্যানটি ‘উপন্যাস’ হোক বা হোক, হয়ে উঠেছে খুবই উপভোগ্য।
ভিন দেশি কাহিনীতে বাঙালিয়ানা জাগাতে‌ অবনীন্দ্রনাথের জুড়ি ছিল না স্থাননাম, চরিত্রনাম বদলে যেতো সবই। যেমন বদলেছে ‘খাতাঞ্চির খাতা’য় বা ‘বুড়ো আংলা’য় । বুড় আংলাও বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে রচিত। সুইডিশ-আখ্যান অবনীন্দ্রনাথের আশ্চর্য দক্ষতায় হয়ে উঠেছে ‘সম্পূর্ণ বাংলাদেশের বই।’ রিদয় আমাদেরই ঘরের ছেলে। তার মধ্যে ছোটরা নিজের ছবি দেখতে পায়, বড়রা খুঁজে পান হারানো শৈশব। হৃদয়সঞ্চিত শৈশবস্মৃতি বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। রিদয়ের দুরন্তপনায়, দুষ্টুমিতে ছোটোরা দেখতে পায় নিজেরই প্রতিচ্ছবি। সেই কারণেই ‘বুড়ো আংলা’ ছোটদের সহজেই স্পর্শ করে। বড়রা আপ্লুত হন নস্টালজিয়ায়। এ নস্টালজিয়া মন কেমন করা বিষাদময় নয়, আগাগোড়া কৌতুকে ভরপুর। রিদয় নামের ছেলেটি, যে পাখির বাসায় ইঁদুর, গরুর গোয়ালে বোলতা, ইঁদুরের গর্তে জল, বোলতার বাসায় ছুঁচো বাজি, কাকের ছানা ধরে তাকে তার দিয়ে নথ পরিয়ে দেওয়া, ঘুমন্ত গুরুমশাই টিকিটে বিছুটি লাগিয়ে আসা, বাবার চাদরে চোরকাঁটা বিঁধিয়ে রাখা, মায়ের ভাঁড়ারঘরের আমসির হাঁড়িতে আরশোলা ভরে দেওয়া — দিনভর এমনই নানা উৎপাতে মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ সবাইকে জ্বালাতন করে মারতো, তার পরিণতি ছোটদের হাসায় অনাবিল আনন্দে, নির্মল কৌতুকে মন ভরে ওঠে। ‘আলোর ফুলকি’ ছোটদের লেখা নয়, বরং ‘হানাবাড়ির কারখানা’ ছোটদের কাছে বোধ্য ও উপভোগ্য। দুটি বইয়েরই অবলম্বন বিদেশি কাহিনি। ‘হানাবাড়ির কারখানা’-র উৎস লুকিয়ে রয়েছে রিচার্ড হ্যারিস বারহ্যামের আখ্যানে। না, অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ নয়, ছায়াবলম্বী রচনা।
অবনীন্দ্রনাথ ‘হানাবাড়ির কারখানা’য় বারহ্যামের রহস্যময় ভৌতিক জগতের সঙ্গে মিশেছেন ফ্যান্টাসি প্রলেপ। প্রকাশভঙ্গিটিও ভারি আকর্ষণীয়। অবনীন্দ্রনাথের গদ্যে ফল্গুনদীর মতো একটা ছন্দ রয়ে যায়। ‘হানাবাড়ির কারখানা’য় ছন্দ একেবারে প্রত্যক্ষ, স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ছন্দ -ঝংকার। সেই কারণেই দৌহিত্র শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘গদ্যের ছাঁচে লেখা হলেও বাক্যের শেষে প্রায়ই একটা মিল আছে। দাদামশায় বলতেন, এগুলো পড়তে হলে শুধু গল্পের মতো একটানা পড়ে গেলে হবে না। এগুলো আসলে কবিতা — ছন্দ রেখে ঠিক সুরে এগুলো পড়লে তবেই রস পাওয়া যাবে।’ বারহ্যামের গল্পগুলিও এমনতরো ছন্দময়। ছন্দে ছন্দে ভৌতিক পরিবেশ এক ভিন্নতর মাত্রা পেয়েছে। বীভৎস রস জাগানো নয়, অবনীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল ছোটোদের আনন্দ দান। স্নিগ্ধ, সরস ভাষায় সেই আনন্দদান যে বাস্তব-রূপ পেয়েছে, তা বলাই বাহুল্য!

অবনীন্দ্রনাথ কিছু গল্পও লিখেছিলেন। খানকয়েক মৌলিক গল্প থাকলেও অধিকাংশেরই কাহিনি গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন বিদেশি গল্প থেকে। আরব্যরজনীর গল্প, ঈশপের গল্প— ভালো-লাগা আখ্যান হোক না দেশি বা বিদেশি অবনীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন পরম আন্তরিকতায়। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তা সযত্নে পৌঁছে দিয়েছেন এদেশের ছেলেমেয়েদের হাতে। এমনকি ফরাসি কাহিনি থেকে একটি গল্পের উৎস গ্রহণ করেছিলেন। গল্পের শেষে অবনীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন কৌতুকমিশ্রিত স্বীকৃতি, ‘ফরাসি হইতে চুরি’।

এর বাইরেও আছে অবনীন্দ্রনাথের লেখা পুঁথি ও যাত্রাপালা। পুরোনো সাহিত্যের হারানো ঘরানা অবনীন্দ্রনাথের হাতে নতুনতর মাত্রা পেয়েছে। এসবই লিখেছেন ছোটদের কথা ভেবে। তাই বানানো গাম্ভীর্য নেই, সরলতায় ভরপুর। অবনীন্দ্রনাথের ছোটদের সাহিত্যসম্ভার খুব কম নয়। আরও আছে কিছু নাটক ও ছড়া-কবিতা। লোকায়ত ছড়া শুধু সংগ্রহ করেননি, নিজেও বিশুদ্ধ ছড়া রচনা করেছেন। তাঁর লেখা ছড়াও মজাদার, হাস্যরসময়। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ ও ‘ঘরোয়া’ স্বহস্তে লিখিত নয়, মুখে মুখে বলেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। লিখে নিয়েছিলেন রানি চন্দ ভারি উপভোগ্য, মাধুর্যময় এই স্মৃতিকথা দুটি তো বটেই, অবনীন্দ্রনাথের ‘আপনকথা’ও খুব ছোটরা না হলেও কিশোর -পাঠক পড়তে পারে অনায়াসে।
অবনীন্দ্রনাথ যে জানতেন ছোটোদের মনের খবর, তা বারবার নানা রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছোটদের তিনি কখনওই শোনাননি দুঃখকথা। তাঁকে আচ্ছন্ন করেনি বিষাদময়তা। অবনীন্দ্রনাথ শুনিয়েছেন আনন্দের বার্তা। হাসিতে খুশিতে ছোটদের মুখ সারাক্ষণই ঝলমলে উজ্জ্বল থাকুক, চেয়েছেন তিনি।

এত বছর পেরিয়েও অবনীন্দ্রনাথ প্রতিনিয়ত আমাদের মুগ্ধ করেন। আজও তিনি অনুকরণীয়, তিনি অনন্য। আশ্চর্য ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন হারানো শৈশব। মনের বয়স কখনও বাঁচতে দেননি। শুনিয়েছেন কত না স্বপ্নের খবর, কত না কল্পনার রঙে রঙিন রূপকথা, যা সহজেই পৌঁছে দেয় স্বপ্নলোকে, রূপকথার অপরূপ জগতে। ছোটদের মনোজগৎ তাঁর করার তো ছিলই, হাতে ছিল এক অনুপম গদ্যভাষা। অনেকের ভিড়ে অবনীন্দ্রনাথ স্বাতন্ত্র্যে, নিজস্বতায় উজ্জ্বল। একেবারে অন্যরকম, কারও সঙ্গেই মেলানো যায় না তাঁকে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, শিশুসাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট তিনি। উপেন্দ্রকিশোর, যোগীন্দ্রনাথ, দক্ষিণারঞ্জন বা সুকুমার — সকলেই ছোটদের বড় লেখক। শিশুসাহিত্যে তাদের বিপুল অবদান তা সত্বেও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁরা কেউই তুলনীয় নয়। অবনীন্দ্রনাথের অসাধারণ গদ্যভাষা আর মনোরম উপস্থাপনায় আজও বিস্মিত হই। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার ঘিরে আমাদের এই বিস্ময়ে কখনও ধুলো জমবে না, ফিকে হয়ে যাবে না। অবনীন্দ্রনাথ চিরদিনের, চিরকালের।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

লেখক অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content