অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী
অফিস থেকে ফিরে চা আর দুটি মুড়ি গালে ফেলে নাড়াচাড়া করতে করতে মাঝ গঙ্গায় কলার খোলের মতো অতীতে ভাসছিল নিঃসঙ্গ শরদিন্দু। সেই দিনটা—
সাদা পা-জামা আর কালচে লাল পাঞ্জাবি পরিহিত শরদিন্দু খাটে আধশোয়া হয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে টিভির রিমোট হাতে নিয়েছিল। সংসারের রিমোট অনেকদিনই হাতছাড়া। স্ত্রী অরু এবং মেয়ে অন্বেষার উপর ওর কোনও কন্ট্রোল নেই। ওরা নিজেদের মতো চলে।
চলছে ২৪ ঘণ্টা চ্যানেল। রিমোট কাজ করছে না। অসহায় হয়ে চেয়ে আছে শরদিন্দু । ইস্, যদি কোনও একটা স্পোর্ট চ্যানেলে ঠেকিয়ে রেখে রিমোটটা অকেজো হয়ে যেত! ও নিউজ চ্যানেল আর সোপ অপেরাসমৃদ্ধ চ্যানেলগুলি অ্যাভয়েড করে। দু’টো চ্যানেলই বক্তব্য ফেনায়িত করে।
শরদিন্দু মনে করতে পারল গত রাতে ও লাস্ট স্টার স্পোর্টসেই ছিল।
রিমোটে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে দেখল। নাহ্।
আজ সারাদিন হয়তো মা-মেয়ে ২৪ ঘণ্টা দেখেছে। এমনিতে নিউজ চ্যানেল দেখার পার্টি ওরা নয়। কিন্তু ইদানীং বলিউডি এক সেলিব্রিটির হাঁড়ির খবর বেশ রসালো করে পরিবেশিত হচ্ছে প্রতি নিউজ চ্যানেলে। নির্ঘাত সে জন্যেই…
কাউকে কিছুই বলল না শরদিন্দু । জানে বললে ওরা পাত্তা তো দেবেই না। চাই কি অপমানজনক মানসিক নির্যাতনের অভিযোগও আনতে পারে।
‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট ২০০৫’ চালু হয়ে গেছে । মহিলা ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে— ‘দৈহিক অত্যাচার, যৌন অত্যাচারে শাস্তি তো আছেই, এমনকী মৌখিক ও মানসিক নির্যাতনের, যেমন অপমানজনক কথাবার্তা গালিগালাজ ইত্যাদি অভিযোগও যদি স্ত্রী বা লিভ-টুগেদারের সঙ্গিনী আনে তবে তাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
নিস্তেজ শরদিন্দু রিমোট বেডসাইড টেবিলে রেখে টিভির দিকে দেখতে থাকল৷
সিঙ্গুরে জমি হারিয়ে কৃষক আত্মঘাতী… নন্দীগ্রামে মহিলা শিশুদের উপর পুলিশের নির্বিচার সন্ত্রাস… ১৪ মার্চ গণহত্যা দিবস… কালাদিবসের ডাক বিরোধীদের…সর্বদলীয় বৈঠকের প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান বিরোধী নেতার…। তাঁর বক্তব্য, আগে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ হোক সিঙ্গুরে নন্দীগ্রামে….
‘সন্ত্রাস!’ কয় প্রকার?
শরদিন্দুর হাসি পেল।
একটা বিজ্ঞাপনের বিরতি৷ অবাঞ্ছিত রোম থেকে রেহাই পেতে ভীট…
ধুত্ত্যারিকা! সারাদিন অফিসের ঝক্কি… হেড অফিস… বস… ফিনান্স ফাইল… টিম ম্যানেজমেন্ট মিটিং… এ সবের পর বাড়ি ফিরে একটু রিলাক্স দরকার৷
রঙিন জলের নেশা নেই। বউ-মেয়ের সঙ্গে চা সহযোগে খানিক গল্প আড্ডা, খুনসুটি, ডিনার টেবিলে কোথাও বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা ছকা, হালকা মতানৈক্য—এই তো চেয়েছিল শরদিন্দু।
অ্যাসট্রে উপচে যাচ্ছে পোড়া সিগারেটে।
মাওবাদী হামলার ছক ফাঁস… আদিকন্দ দলুই… প্রকাশ্য রাস্তায় জ্যান্ত পুড়ছে… পুলিশ বলল, ভাবছি বোধহয় কুকুর পুড়ছে… আগে হলে এ সব সংবাদে সমাজসেবী শরদিন্দুর শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু বিদ্রোহ করত, প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ত ও। গণ আন্দোলনের হুমকি দিত। মিছিল বের করত । মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিতে কিছু জীবন চলে গেলে শরদিন্দু এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে ওকে সামলাতে বীথিকার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু এখন যে শরদিন্দু তার মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ নেই৷
এবার এইডসের সুপরামর্শ নিয়ে বুলাদি হাজির। উফ্! আর ভালো লাগছে না।
বিয়ের আগে সমাজসেবায় বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করত শরদিন্দু। ক্লাব থেকে অর্গানাইজ করত ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প, পোলিও টিকা, আই ক্যাম্প, হেপাটাইটিস বি ইনজেকশন… আরও কত কত কর্মসূচি। এত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও ওর খেয়াল থাকত ষোলোআনা যে, বাড়িতে মা ওর পথ চেয়ে বসে থাকবে। খাবে না। ছোটবেলায় পিতৃহারা শরর জন্যে বীথুর চিন্তার শেষ নেই।
আজ অতীত বড় নিষ্পেষণ করছে ওকে। মা অর্ডারি সেলাই করে, টিউশন করে, এলাইসির এজেন্সি করে ওকে মানুষ করেছে। এতদিন সুদিন ছিল মা-ছেলের সংসারে।
সেদিনই সৌভাগ্যে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে গিয়েছিল যেদিন রণবীরকাকু ফোন করে বলেছিলেন, ‘বাবা শরদিন্দু, ওই বস্তি উচ্ছেদ অভিযান রোধ কমিটি থেকে রিকোয়েস্ট করেছে তুমি যদি আগামী রবিবার ক্লাবের কিছু ছেলে নিয়ে ওদের সঙ্গে থাক তো…’
খালপাড় বস্তি উচ্ছেদ অভিযান। শ’য়ে শ’য়ে পুলিশ। বস্তির মহিলা পুরুষ কিশোর নির্বিশেষে হাতে লাঠি দা বঁটি নিয়ে তৈরি। বিরোধী পক্ষের কয়েকজন প্রথম সারির নেতাও আছেন। প্রায় তাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শরদিন্দু।
একজন এসি পদমর্যাদার পুলিশ কিছু বোঝাতে যাচ্ছিল বস্তির কয়েকজনকে। হঠাৎই কথা কাটাকাটি, প্রায় হাতাহাতি। এ তরফ থেকে ইটবৃষ্টি ও তরফের লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসা। নিমেষে এলাকা রণক্ষেত্র। হঠাৎই একটা আধলা ইট দড়াম করে শরদিন্দুর মাথায়… ব্যস্… গলগলিয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরদিন্দু। কয়েকজন ধরাধরি করে নিয়ে গেল বস্তিরই একটা ঘরে। একটু ধাতস্থ হতে ওখানেই অরুণিমাকে দেখল শরদিন্দু। নিপুণ হাতে ফার্স্ট এড করে দিয়েছিল।
অরু আর ওর মা এখানে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বহু ঠেক ঘুরে শেষমেশ এখন এই বস্তিতে। স্বামী তিন বছর হল মারা গেছে ক্যানসারে। বস্তি যদি সত্যি উচ্ছেদ করা হয় তবে ঘাড়ের উপর এই বিবাহযোগ্যা কন্যা নিয়ে কোথায় যাবে? কী করবে?
দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই অরুর মায়ের দু’চোখে।
সমাজসেবক শরদিন্দু অরুকে বিয়ে করে ঘরের বউ করে নিয়ে এসেছিল। মায়ের অমত ছিল। কিন্তু বুঝিয়েছিল এই বলে যে, ‘মা, এক্সামপেল ইজ বেটার দ্যান প্রিসেপ্ট। উপদেশ দেওয়ার থেকে করে দেখানো অনেক ভালো। বিধবা বিবাহ সমর্থনে বিদ্যাসাগর নিজের ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন এক বিধবার সঙ্গে।
‘সে তো সেকালের কথা। তুই একালের দিকে চেয়ে দ্যাখ। একালের মতো হ’। মাতৃভাষায় শিক্ষাদান ব্যবস্থা চালু করে ক’জন নেতা মন্ত্রীর ছেলেমেয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়ছে? ‘ বীথিকা বলেছিল।
শরদিন্দু বলল, ‘ওসব কথা থাক মা। তুমি যদি আমাকে এই শরদিন্দু না বানাতে তাহলে আজ এই অভিজাত এলাকায় এই পেল্লাই ফ্ল্যাটে আমাদেরও কি থাকা হত? আমরা হয়তো আজও তাহলে বালিগেঞ্জর বস্তিতেই…
বীথিকা আর কথা বাড়ায়নি। জানত তার আপত্তিতে শরদিন্দু কিছুতেই কিছু করবে না। কিন্তু মা হয়ে সে-ই বা কেন গোঁ ধরে বসে ছেলের ইচ্ছেতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
হাসিমুখেই অরুকে মেনে নিয়েছিল বীথিকা। বছর ঘুরতেই অন্বেষা। তার ছ’মাসের মধ্যেই অরুর স্বমূর্তি ধারণ।
***
পাওয়ার কাট্।
স্পষ্ট শুনতে পেল শরদিন্দু পাশের ঘরের মা-মেয়ের হাহা হিহি। মোবাইলে কথা হচ্ছে। নেট-চ্যাটিং করে বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছে অনেক। অন্বেষার সাহায্যে ওয়েবসাইট, ইয়াহু ডট কম-এ মেল আইডি খুলেছে। অরু মেয়ের জন্য গর্বিত। মেয়ে বুঝিয়েছে ‘এর নাম মডার্ন টেকনোলজি’। বস্তিতে থাকতে এসব স্বপ্নেও ভাবেনি। স্বপন বা রমেশের সঙ্গে ফুচকা খাওয়া বা বড়জোর টকি হাউজে লুকিয়ে একটা শো মারা। পুরোনো সঙ্গীসাথীদের ফোন করে জেনেছে এখন ওখানেও সবাই জানে এসব।
অরুর মায়ের গালভরা মিষ্টি কথা আর অরুর মনোরম ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিল শরদিন্দু। এমনকী সংসারাভিজ্ঞ বীথিকাকেও বোকা বানিয়ে ছেড়েছে ওরা।
শরদিন্দু এখন সপ্তাহে দু’দিন গিয়ে বৃদ্ধাবাসে মাকে দেখে আসে। শেষে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছিল শরদিন্দু বিবেচনা করল মায়ের পক্ষে কারাবাসের চেয়ে বৃদ্ধাবাস শ্রেয়। মোটা টাকার বিনিময়ে এক দারুণ বৃদ্ধাবাসে রেখে এসেছে মাকে। মনে মনে বলে, ‘আমাকে ক্ষমা কোরো মা।’ মোটা টাকার অঙ্কটা অরু জানে না। ও জানে সামান্য টাকা ব্যয় করা হয় বীথিকার জন্যে।
কোনও মহিলার সুমিষ্ট কথায়, বা মিষ্টি ব্যবহারে এখন শরদিন্দুর সর্বাঙ্গে এলার্জি দেখা দেয়। তেড়ে মারতে যেতে ইচ্ছে হয়। অফিসের পিএ ঐশী হদ্দ ন্যাকা। মুখে মিষ্টি কথা লেগেই আছে। বুকের অর্ধাংশ উন্মুক্ত। শরদিন্দু খুব সতর্ক হয়ে থাকে।
রসরাজদা শুনে বলেছিল, ঝাঁপা না ব্যাটা।
আর নয়, একটা ভুল…
হ্যাঁ, মাত্র একটা ভুলই অনেক সৌধ ভেঙে দিতে পারে। পারে একটা মানুষকে মুষড়ে দিতে, দুমড়ে দিতে, শরদিন্দু সেটা জানে।
সাদা পা-জামা আর কালচে লাল পাঞ্জাবি পরিহিত শরদিন্দু খাটে আধশোয়া হয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে টিভির রিমোট হাতে নিয়েছিল। সংসারের রিমোট অনেকদিনই হাতছাড়া। স্ত্রী অরু এবং মেয়ে অন্বেষার উপর ওর কোনও কন্ট্রোল নেই। ওরা নিজেদের মতো চলে।
চলছে ২৪ ঘণ্টা চ্যানেল। রিমোট কাজ করছে না। অসহায় হয়ে চেয়ে আছে শরদিন্দু । ইস্, যদি কোনও একটা স্পোর্ট চ্যানেলে ঠেকিয়ে রেখে রিমোটটা অকেজো হয়ে যেত! ও নিউজ চ্যানেল আর সোপ অপেরাসমৃদ্ধ চ্যানেলগুলি অ্যাভয়েড করে। দু’টো চ্যানেলই বক্তব্য ফেনায়িত করে।
শরদিন্দু মনে করতে পারল গত রাতে ও লাস্ট স্টার স্পোর্টসেই ছিল।
রিমোটে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে দেখল। নাহ্।
আজ সারাদিন হয়তো মা-মেয়ে ২৪ ঘণ্টা দেখেছে। এমনিতে নিউজ চ্যানেল দেখার পার্টি ওরা নয়। কিন্তু ইদানীং বলিউডি এক সেলিব্রিটির হাঁড়ির খবর বেশ রসালো করে পরিবেশিত হচ্ছে প্রতি নিউজ চ্যানেলে। নির্ঘাত সে জন্যেই…
কাউকে কিছুই বলল না শরদিন্দু । জানে বললে ওরা পাত্তা তো দেবেই না। চাই কি অপমানজনক মানসিক নির্যাতনের অভিযোগও আনতে পারে।
‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট ২০০৫’ চালু হয়ে গেছে । মহিলা ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে— ‘দৈহিক অত্যাচার, যৌন অত্যাচারে শাস্তি তো আছেই, এমনকী মৌখিক ও মানসিক নির্যাতনের, যেমন অপমানজনক কথাবার্তা গালিগালাজ ইত্যাদি অভিযোগও যদি স্ত্রী বা লিভ-টুগেদারের সঙ্গিনী আনে তবে তাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
নিস্তেজ শরদিন্দু রিমোট বেডসাইড টেবিলে রেখে টিভির দিকে দেখতে থাকল৷
সিঙ্গুরে জমি হারিয়ে কৃষক আত্মঘাতী… নন্দীগ্রামে মহিলা শিশুদের উপর পুলিশের নির্বিচার সন্ত্রাস… ১৪ মার্চ গণহত্যা দিবস… কালাদিবসের ডাক বিরোধীদের…সর্বদলীয় বৈঠকের প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান বিরোধী নেতার…। তাঁর বক্তব্য, আগে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ হোক সিঙ্গুরে নন্দীগ্রামে….
‘সন্ত্রাস!’ কয় প্রকার?
শরদিন্দুর হাসি পেল।
একটা বিজ্ঞাপনের বিরতি৷ অবাঞ্ছিত রোম থেকে রেহাই পেতে ভীট…
ধুত্ত্যারিকা! সারাদিন অফিসের ঝক্কি… হেড অফিস… বস… ফিনান্স ফাইল… টিম ম্যানেজমেন্ট মিটিং… এ সবের পর বাড়ি ফিরে একটু রিলাক্স দরকার৷
রঙিন জলের নেশা নেই। বউ-মেয়ের সঙ্গে চা সহযোগে খানিক গল্প আড্ডা, খুনসুটি, ডিনার টেবিলে কোথাও বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা ছকা, হালকা মতানৈক্য—এই তো চেয়েছিল শরদিন্দু।
অ্যাসট্রে উপচে যাচ্ছে পোড়া সিগারেটে।
মাওবাদী হামলার ছক ফাঁস… আদিকন্দ দলুই… প্রকাশ্য রাস্তায় জ্যান্ত পুড়ছে… পুলিশ বলল, ভাবছি বোধহয় কুকুর পুড়ছে… আগে হলে এ সব সংবাদে সমাজসেবী শরদিন্দুর শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু বিদ্রোহ করত, প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ত ও। গণ আন্দোলনের হুমকি দিত। মিছিল বের করত । মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিতে কিছু জীবন চলে গেলে শরদিন্দু এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে ওকে সামলাতে বীথিকার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু এখন যে শরদিন্দু তার মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ নেই৷
এবার এইডসের সুপরামর্শ নিয়ে বুলাদি হাজির। উফ্! আর ভালো লাগছে না।
বিয়ের আগে সমাজসেবায় বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করত শরদিন্দু। ক্লাব থেকে অর্গানাইজ করত ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প, পোলিও টিকা, আই ক্যাম্প, হেপাটাইটিস বি ইনজেকশন… আরও কত কত কর্মসূচি। এত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও ওর খেয়াল থাকত ষোলোআনা যে, বাড়িতে মা ওর পথ চেয়ে বসে থাকবে। খাবে না। ছোটবেলায় পিতৃহারা শরর জন্যে বীথুর চিন্তার শেষ নেই।
আজ অতীত বড় নিষ্পেষণ করছে ওকে। মা অর্ডারি সেলাই করে, টিউশন করে, এলাইসির এজেন্সি করে ওকে মানুষ করেছে। এতদিন সুদিন ছিল মা-ছেলের সংসারে।
সেদিনই সৌভাগ্যে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে গিয়েছিল যেদিন রণবীরকাকু ফোন করে বলেছিলেন, ‘বাবা শরদিন্দু, ওই বস্তি উচ্ছেদ অভিযান রোধ কমিটি থেকে রিকোয়েস্ট করেছে তুমি যদি আগামী রবিবার ক্লাবের কিছু ছেলে নিয়ে ওদের সঙ্গে থাক তো…’
খালপাড় বস্তি উচ্ছেদ অভিযান। শ’য়ে শ’য়ে পুলিশ। বস্তির মহিলা পুরুষ কিশোর নির্বিশেষে হাতে লাঠি দা বঁটি নিয়ে তৈরি। বিরোধী পক্ষের কয়েকজন প্রথম সারির নেতাও আছেন। প্রায় তাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শরদিন্দু।
একজন এসি পদমর্যাদার পুলিশ কিছু বোঝাতে যাচ্ছিল বস্তির কয়েকজনকে। হঠাৎই কথা কাটাকাটি, প্রায় হাতাহাতি। এ তরফ থেকে ইটবৃষ্টি ও তরফের লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসা। নিমেষে এলাকা রণক্ষেত্র। হঠাৎই একটা আধলা ইট দড়াম করে শরদিন্দুর মাথায়… ব্যস্… গলগলিয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরদিন্দু। কয়েকজন ধরাধরি করে নিয়ে গেল বস্তিরই একটা ঘরে। একটু ধাতস্থ হতে ওখানেই অরুণিমাকে দেখল শরদিন্দু। নিপুণ হাতে ফার্স্ট এড করে দিয়েছিল।
অরু আর ওর মা এখানে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বহু ঠেক ঘুরে শেষমেশ এখন এই বস্তিতে। স্বামী তিন বছর হল মারা গেছে ক্যানসারে। বস্তি যদি সত্যি উচ্ছেদ করা হয় তবে ঘাড়ের উপর এই বিবাহযোগ্যা কন্যা নিয়ে কোথায় যাবে? কী করবে?
দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই অরুর মায়ের দু’চোখে।
সমাজসেবক শরদিন্দু অরুকে বিয়ে করে ঘরের বউ করে নিয়ে এসেছিল। মায়ের অমত ছিল। কিন্তু বুঝিয়েছিল এই বলে যে, ‘মা, এক্সামপেল ইজ বেটার দ্যান প্রিসেপ্ট। উপদেশ দেওয়ার থেকে করে দেখানো অনেক ভালো। বিধবা বিবাহ সমর্থনে বিদ্যাসাগর নিজের ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন এক বিধবার সঙ্গে।
‘সে তো সেকালের কথা। তুই একালের দিকে চেয়ে দ্যাখ। একালের মতো হ’। মাতৃভাষায় শিক্ষাদান ব্যবস্থা চালু করে ক’জন নেতা মন্ত্রীর ছেলেমেয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়ছে? ‘ বীথিকা বলেছিল।
শরদিন্দু বলল, ‘ওসব কথা থাক মা। তুমি যদি আমাকে এই শরদিন্দু না বানাতে তাহলে আজ এই অভিজাত এলাকায় এই পেল্লাই ফ্ল্যাটে আমাদেরও কি থাকা হত? আমরা হয়তো আজও তাহলে বালিগেঞ্জর বস্তিতেই…
বীথিকা আর কথা বাড়ায়নি। জানত তার আপত্তিতে শরদিন্দু কিছুতেই কিছু করবে না। কিন্তু মা হয়ে সে-ই বা কেন গোঁ ধরে বসে ছেলের ইচ্ছেতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
হাসিমুখেই অরুকে মেনে নিয়েছিল বীথিকা। বছর ঘুরতেই অন্বেষা। তার ছ’মাসের মধ্যেই অরুর স্বমূর্তি ধারণ।
পাওয়ার কাট্।
স্পষ্ট শুনতে পেল শরদিন্দু পাশের ঘরের মা-মেয়ের হাহা হিহি। মোবাইলে কথা হচ্ছে। নেট-চ্যাটিং করে বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছে অনেক। অন্বেষার সাহায্যে ওয়েবসাইট, ইয়াহু ডট কম-এ মেল আইডি খুলেছে। অরু মেয়ের জন্য গর্বিত। মেয়ে বুঝিয়েছে ‘এর নাম মডার্ন টেকনোলজি’। বস্তিতে থাকতে এসব স্বপ্নেও ভাবেনি। স্বপন বা রমেশের সঙ্গে ফুচকা খাওয়া বা বড়জোর টকি হাউজে লুকিয়ে একটা শো মারা। পুরোনো সঙ্গীসাথীদের ফোন করে জেনেছে এখন ওখানেও সবাই জানে এসব।
অরুর মায়ের গালভরা মিষ্টি কথা আর অরুর মনোরম ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিল শরদিন্দু। এমনকী সংসারাভিজ্ঞ বীথিকাকেও বোকা বানিয়ে ছেড়েছে ওরা।
শরদিন্দু এখন সপ্তাহে দু’দিন গিয়ে বৃদ্ধাবাসে মাকে দেখে আসে। শেষে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছিল শরদিন্দু বিবেচনা করল মায়ের পক্ষে কারাবাসের চেয়ে বৃদ্ধাবাস শ্রেয়। মোটা টাকার বিনিময়ে এক দারুণ বৃদ্ধাবাসে রেখে এসেছে মাকে। মনে মনে বলে, ‘আমাকে ক্ষমা কোরো মা।’ মোটা টাকার অঙ্কটা অরু জানে না। ও জানে সামান্য টাকা ব্যয় করা হয় বীথিকার জন্যে।
কোনও মহিলার সুমিষ্ট কথায়, বা মিষ্টি ব্যবহারে এখন শরদিন্দুর সর্বাঙ্গে এলার্জি দেখা দেয়। তেড়ে মারতে যেতে ইচ্ছে হয়। অফিসের পিএ ঐশী হদ্দ ন্যাকা। মুখে মিষ্টি কথা লেগেই আছে। বুকের অর্ধাংশ উন্মুক্ত। শরদিন্দু খুব সতর্ক হয়ে থাকে।
রসরাজদা শুনে বলেছিল, ঝাঁপা না ব্যাটা।
আর নয়, একটা ভুল…
হ্যাঁ, মাত্র একটা ভুলই অনেক সৌধ ভেঙে দিতে পারে। পারে একটা মানুষকে মুষড়ে দিতে, দুমড়ে দিতে, শরদিন্দু সেটা জানে।
* গল্প (Short Story) রিমোট (Remote) : স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় (Swapna Banerjee), লেখিকা
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com