বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

বাবা বাবা, দেখো রাস্তার কুকুরগুলো কেমন করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিড়ালটার উপর৷ রূপসীর বাবা দোতলার জানলা থেকে তাকিয়ে দেখেন, তাই তো, আহা অনেকদিন খেতে না পেয়ে কুকুরগুলো বাচ্চা বিড়ালটাকে জ্যান্ত খেতে চাইছে৷ চারদিকে মহামারী লেগেছে৷ তাই বুঝি ছোট্ট বিড়ালটাকে ওরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওর মাংস খাবে বলে৷

এমন দৃশ্য দেখে বাবা তখুনি মেয়েকে জানলা থেকে সরিয়ে এনে খাটে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ওসব দেখো না মা৷ সারাদেশে করোনা নামক অসুখটা ছড়িয়ে পড়েছে৷ এই অসুখের ভয়ে মানুষ ঘর থেকে বেরোচ্ছে না৷

দোকান-বাজার, রেল, বাস সবই বন্ধ৷ শুধু করোনা নামক এই ভয়ংকর অসুখের ভয়ে৷ যে মানুষগুলো কুকুর-বেড়াল এদের মুখের কাছে খাবার এনে দেয় তারাই এখন ঘরে বন্দি হয়ে আছেন বেশ কিছুদিন ধরে শুধু করোনা নামক অসুখের ভয়ে৷

বাজারে মাছ-মাংসের দোকানও কম বসে৷ হোটেল রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ৷ কুকুরগুলো অনেকদিন কিছু খেতে পায়নি, তাই তারা ক্ষুধার্ত হয়ে পাগলের মতো জ্যাম্ত বিড়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷

সারাদিন রূপসী জানলায় বসে বসে বই পড়ে আর ভাবে বাবা বলেছে, কুকুর-বেড়াল ওরা খেতে না পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবারের খোঁজে৷ ওরা কথা বলতে পারে না৷ আমাদের দরজায় এসে একটু ভাত দাও একথাও বলতে পারে না৷

এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবেতে রূপসী আবার বই পড়তে শুরু করে দিল—
“দাও তবে প্রভু হেন শুভ মতি
প্রাণে দাও নব আশা৷
জগৎ মাঝারে যেন সবাকারে
দিতে পারি ভালোবাসা৷”


পড়তে পড়তে রূপসী আবার ভাবল, চারদিকের মানুষের কী একটা ছোঁয়াচে অসুখ করছে৷ জানি না, সেই জন্যই স্কুল বন্ধ, অফিস বন্ধ৷ রাস্তায় লোকজন নেই৷ এমন দৃশ্য ও কোনওদিন দেখেনি৷

সারাদিন রূপসী জানলার ধারে বসে কতকিছু কল্পনা করে৷ কখনও হাঁ করে রাস্তার কুকুর বিড়াল ভিখারি এদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে৷ আবার কখনও ফাঁকা রাস্তায় ওদের দেখতেই পায় না৷

রূপসীর বাড়ির সামনের বটগাছটার তলায় একটা ছোট্ট ছেলে সারাদিন বসে ভিক্ষা করত৷ অনেকদিন ধরে তাকে দেখতে না পেয়ে রূপসীর মনের ভিতরে ওর জন্যও চিন্তা হচ্ছিল৷ ছেলেটা কোথায় গেল, ওর কী হল, ও খেতে পেল কি না, এইসব৷

বাবা রূপসীকে বলেছেন এই করোনা অসুখের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে সবাইকে৷ রাস্তায় বেরোনো হবে না৷ তাই তো ও রাস্তায় নেমে গিয়ে ভিখারি ছেলেটাকে দেখতে যেতেও পারছে না৷

তাই বাবাকে ও জিজ্ঞাসা করল, আমাদের বাড়ির সামনের ওই ভিখারি ছেলেটা কোথায় গেল বাবা? ওকে দেখছি না তো! বাবা বললেন, তাই তো! ওকে তো ঘোরাঘুরি করতেও দেখিনি কদিন!

এরপর তিন-চারদিন একদিন দুপুরবেলা কে যেন নীচের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে৷ আওয়াজ শুনে বাবা কে, কে বলতে বলতে নীচে নেমে গেলেন৷ ছোট্ট রূপসীও বাবার পিছু পিছু নামতে থাকল৷ বাবা দরজা খুলেই দেখে থালা হাতে সেই ভিখারি ছেলেটার মা দাঁড়িয়ে কাঁদছে৷ বলছে, একটু ভাত দেবে বাবা! ভাত না থাকে যা আছে তাই দাও৷ আমার ছেলেটা জ্বরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে৷ কদিন কিছু খায়নি৷ কোনও দোকান খোলা নেই, হোটেলও খোলা নেই৷ ওর মুখে কী দেব? একটু ভাতই দেবে বাবা?

ভিখারিনি মা-কে দেখেই রূপসী চিনে ফেলল৷ বলল, বাবা, সেই ছেলেটা যার কথা বলছিলাম তোমাকে৷ ওর মা এটা৷ আমি ওকে রোজই স্কুলে যাওয়ার সময় দেখি৷ তুমি দাঁড়াও, আমি ওর জন্য ভাত আনছি মা-র কাছ থেকে৷

বলেই রূপসী ওপরে দৌড়ে এসে রান্নাঘরে ঢুকে একটা থালা হাতে মা-র কাছে গিয়ে বলল, মা, একটু ভাত দাও, গাছতলার ওই ছেলেটার মা এসেছে, ভাত চাইছে৷ ওর খুব জ্বর৷ তিনদিন কিছু খেতে পায়নি৷ তুমি তাড়াতাড়ি ভাত দাও এই থালাতে৷

সব শুনে মা হাঁড়ি থেকে ভাত তরকারি যা ছিল সব থালাতে দিল৷ দৌড়ে রূপসী থালা-ভরা ভাত নিয়ে নীচে নামতে পারছিল না৷ তখন মা-ই থালাটা হাতে নিয়ে নীচে নেমে অসুস্থ ছেলেটার মায়ের থালাতে ঢেলে দিলেন৷ ভিখারিনি মা ভাত নিয়ে ছেলের কাছে গিয়ে বসল৷ তারপর ছেলের মুখে গুঁজে দিতে লাগল৷

কিন্তু জ্বরে কাতর ছেলেটা কিছুই খেতে পারছিল না৷ তাই দেখে ছেলেটির মা কাঁদতে কাঁদতে বুকে চেপে ধরে বলতে লাগল, আমার ছেলের কী হল? আমার ছেলেরও কি সেই করোনা জ্বর হল?

সেই মুহূর্তে সেখানে আর কেউই ছিল না৷ রূপসীর বাবা মনে মনে কী একটা ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ছেলেটাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাও, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷

সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিলেন রূপসীর বাবা৷ আমাদের এখানে ফুটপাতে একটি বাচ্চা ছেলে জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ ওকে শীঘ্রই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷ মনে হয় ছেলেটি করোনা রোগেই আক্রান্ত হয়েছে৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুটপাতের মা ও তার ছেলেটিকে অ্যাম্বুলেন্স এসে তুলে নিয়ে গেল সোজা হাসপাতালে৷ তারপর লোকজন এসে ওই গাছতলাটায় ওষুধ দিয়ে স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করতে লাগল, যাতে রোগটা অন্য কারও শরীরে ছড়িয়ে না পড়ে৷

বেশ কিছুদিন পরে রূপসীরা সকলেই জানতে পারল অসুস্থ ছেলেটি এবং তার মা দুজনেই করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল৷ কিন্তু ওরা এখন আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছে৷

খবরটা পেয়ে রূপসীর মনটা একটু ভালো হল৷ কিন্তু ওরা হাসপাতাল থেকে ফিরে কোথায় আসবে বাবা? ওই গাছতলাতেই? বাবা বললেন, না, ওদেরকে একটা নির্জন বাড়িতে কিছুদিন রাখা হবে৷ একেবারে রোগমুক্ত হলে তবেই ওদের ছেড়ে দেবে৷

রূপসীর খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল৷ কিন্তু ওরা যে অত কঠিন অসুখ থেকে সেরে উঠেছে সেকথা শুনেই ওর শান্তি৷ বাবাকে একটা কথাই বলল রূপসী৷ ওদের সাথে আর কোনওদিন দেখা হবে না বাবা?

বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, না, ওরা আর রাস্তায় থাকবে না৷ ওদের জন্য অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
তখনকার মতো রূপসী বাবার কথা মেনে নিল৷ তারপর থেকে রূপসী আবার জানলাতেই বসে থাকত৷ ফাঁকা রাস্তা৷ লোকজন, বাস, রিকশা কিছুই চলছে না৷

শুধু কুকুরগুলো খিদেয় ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে৷ এতদিনে ও সবই বুঝে ফেলেছে কেন স্কুল বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ, কেনই বা রাস্তায় কেউ বেরোচ্ছে না৷ শুধু সেই ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ করোনার ভয়ে৷ একমনে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আবার কুকুর বেড়ালের একসঙ্গে আওয়াজ ওর কানে এল৷ রূপসী আচমকা তাকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা বেড়ালকে কামড়িয়ে মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে একটা কুকুর৷ আর অন্য কুকুরগুলো ওর পিছু পিছু দৌড়োচ্ছে৷ খিদের জ্বালায় জীবজন্তুরও কী কঠিন অবস্থা৷ পথে মানুষ পশু সকলের কী চরম সংকটময় অবস্থা৷ আর এই সংকটকালে ছোট্ট রূপসীও ঘরে বসে বসে একজন অভিজ্ঞ মানুষ তৈরি হয়ে গেল৷

আজ থেকে সত্তর বছর পরে এই দশক নিজের চোখে দেখা এই নির্মম সব অভিজ্ঞতাগুলো তারই নাতিনাতনিদের কাছে গল্প আকারে ধরা হবে৷

* গল্প (Short Story) রূপসীর চোখে (Ruposir Chokhe) : পৃথা বল (Pritha Bal), সাহিত্যিক

Skip to content