শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

সরকারি আধিকারিক হিসাবে দিন সাতেক হল জঙ্গলের কাছাকাছি নদীর ধারের বাংলোতে উঠেছি। হাতে জম্পেশ একটা কেস। মারাত্মক গোলমাল ছাড়া খামোখা কেনই বা এমন জংলি জায়গায় থাকতে আসব..!

মাঘের সন্ধে কাঠের রেলিং ঘেরা ঝুল বারান্দায় কিছুক্ষণ হল বসে আছি। সামনে কুয়াশার চাদর মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। বলে রাখি আমি অতটা শীতকাতুরে নই, কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ, উত্তুরে হাওয়ার দাপটে, শুকনো পাতার খসখস। এসব জায়গায় মন-মেজাজ বেশ ফুরফুরে থাকলেও, মাথার ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছিল সরকারি দায়িত্ব।

ক’দিন আগেই বহমান এই জংলি নদীটির স্রোতে এক যুবকের ফুলে ফেঁপে ওঠা, ফ্যাকাসে মৃতদেহ পাওয়া যায়। লাশ তুলে পরীক্ষার পর বোঝা যায়, রক্তশূন্যতার কারণেই মৃত্যু। সেই ঘটনার তদন্ত সূত্রে পাওয়া তথ্যগুলো নিয়েই একটু ছক কষছিলাম। পরিশ্রম আর একটানা ঝিঁঝি পোকার কনসার্টে চোখে একটু ঢুলুনি লেগেছিল, হঠাৎ গভীর জঙ্গল থেকে মৃদু গর্জন ভেসে আসতেই আমার ইন্দ্রিয় পুরো সজাগ। ঠিক তখনই দেখলাম অন্ধকার কুয়াশা ভেদ করে দুটো উজ্জ্বল সবুজ বিন্দু নদীর পাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। বাইনোকুলার তাক করে বুঝলাম, তীক্ষ্ণ দাঁতযুক্ত বৃহদাকার লোমশ একটা প্রাণী। শূন্যে গুলি ছুঁড়তেই জন্তুটা বিকট চিৎকারে চাপ চাপ অন্ধকারে মিশে গেল। বাকি রাতটা আরও কিছু ঘটার অপেক্ষায় মুখিয়ে রইলাম।

কাকভোরে ডোরবেলের অস্থির আওয়াজে দরজা খুলতেই বাংলোর রাঁধুনি কাম কেয়ারটেকার ডংলু’র বউ হীরামণি আমার পায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ল। গতকাল সন্ধেয় ডংলু বাংলোর কাজ সেরে বেরোনোর পর আর ঘরে ফেরেনি, কেউ তাকে দেখেওনি। ছুটলাম ওর বস্তিতে, এলাকা জুড়ে চাপা আতঙ্ক। কমিশনার মৃদুল বাগচীকে ফোনে সবটা জানাতেই উনি আশ্বস্ত করলেন। বস্তির জনে জনে সেই দানবাকার অদ্ভুত জীবটার কথাই ঘুরছিল, কেউ বলল রক্তচোষা, কেউ বলল মানুষ-খেকো, সবশেষে হীরামণি বলল—’ডংলু বলতো উটা লাকি লখিয়া আছে। সাপে কাটা কুকুরটারে, ফকির বাবার কাছে রেখে এয়েছিল, যদি পেরাণে বাঁচে!’
‘ফকির বাবা কে?’ প্রশ্ন করলাম৷

‘কুথা থিক্কে এয়েছিলেন কে জানে? তাবিজ, মন্তরে সব রোগ ঝামিলা মিট্টে যেত, আজ এই বেপদে সে থাকলি আমার মরদ রে…।’
এত সব কিছুর মধ্যে যোগ হল দ্বিতীয় খটকা। জেদ চাপল, জন্তু বা মানুষ যে-ই হোক, তাকে ধরবই। বল্লম, কুকরি চালনায় পটু, শক্ত-সমর্থ এমন তিনজনকে বস্তি থেকে সঙ্গে নিয়ে বাংলোয় ফিরে এলাম।

ভরা মাঘ, শীতের প্রচণ্ড কামড়। চারজনেই প্রস্তুত, যে কোনও মুহূর্তে জঙ্গলে ঢুকব। পরস্পর ঘটনাগুলো ভাবছিলাম, হঠাৎ জঙ্গলের দিকের জানলা দিয়ে গাছ আর কুয়াশা ভেদ করে একটা ক্ষীণ আলোর আভাস পেতেই বায়নোকুলার তাক করলাম, এবার সন্দেহ দৃঢ় হল। একজনকে মিঃ বাগচীর অপেক্ষায় রেখে বাকি দু’জনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টর্চের আলোয় জঙ্গলের অনভ্যস্ত পথে এগোতে থাকলাম, আমাদের সূত্র একটা আলোর উৎস। আমরা যখন লক্ষ্যের বেশ কাছাকাছি তখনই সেই সবুজ জ্বলন্ত চোখ ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনজনেই এলোপাথাড়ি কুকুরি চালালাম। দূরে কোথাও গুলির আওয়াজে পশুটা ছিটকে পালাল। আমি শক্ত হাতে রিভলবার তাক করে ছুটে গেলাম ল্যাম্প জ্বলা ঘরটার দিকে। দেখি কালশিটে পড়া শরীরে দুটো পুরুষমানুষ শুয়ে আছে, অজ্ঞান। গলার শিরে গাঁথা ছুঁচের পাইপ বেয়ে দ্রুত রক্ত জমা হচ্ছে কাচের বোতলে। দেওয়ালে ঝুলছে তাপ্পি মারা ঝোলা, জোব্বা, পুঁতির মালা। বোতল বোতল রক্তের আঁশটে গন্ধে বাতাস ভারী। আরও একটা গুলির আওয়াজ পেতেই দ্রুত সেদিকে ছুটলাম। খেপে যাওয়া লোমশ জন্তুটা দাড়িওয়ালার বুকে চেপে টুঁটি কামড়ে ধরেছে, গলার ঘণ্টাটা ঠংঠং দুলছে, মুখে অস্পষ্ট গোঙানি। অন্ধকার এক কোণ থেকে ডংলু চিৎকার করে উঠল ‘ছেড়ি দে লখিয়া, ছেড়ি দে ওরা গোলি মারবে।’ এর পরের ঘটনায় আমি স্তম্ভিত। দু’দিক থেকে পরের দুটো গুলির শব্দ একটা লাগল ডংলুর কাঁধে, অন্যটা বাগচীর নিশানায় লাগল জন্তুটার পিঠে। ডংলু ডুগরে উঠল ‘লখিয়া রে।’ দাড়িওয়ালা তখন জানলা টপকাচ্ছে, নিমেষে আমার পিস্তলের গুলি ওর ডান হাঁটু ফুঁড়ে দিল…

সারা বস্তি অবাক, তাদের ফকিরবাবার মুখে ক্রূর হিংস্রতা। একটা বড়সড় ব্লাড পাচার চক্র ধরা পড়ল সেইদিন জঙ্গলে। পুরস্কৃত হলাম আমরা, শুধু রইল না ডংলুর আদরের কুকুর ‘লখিয়া’। যাকে হরমোন ইনজেক্ট করে করে কষ্ট দিয়ে দানবাকার বানিয়ে জঙ্গলে চলছিল রক্তচোষা অমানুষদের রাজত্ব৷

* গল্প (Short Story) – দানব (Danab) : মনশ্রী দে (Monosree De), লেখিকা

Skip to content