বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: পাপিয়া দেবনাথ।

কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একটা খড়মের শব্দ পোড়ো ঘোষবাড়ি থেকে ঘোষডাঙা পার হয়ে পোড়া বেলগাছতলায় দাঁড়ানো পাঁচু-পাঁচির দিকে এগিয়ে আসছে। চারদিকে ঘন অন্ধকার। কারা সব যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। ওরা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে চাপা খোঁনা গলায় কারা যেন বলাবলি করছে—
—দাঁঠাকুর আঁসছে দাঁঠাকুর আঁসছে রেঁ!!
পাঁচু-পাঁচির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে—
—শুনছিস চাম্পু!
—হুঁ
—ভয় পাস নে। তেঁনারা কথা বলছে—
—কার আসার কথা বলছে।
—বোধহয় ভূতেদের রাজা। পেন্নাম কর চাম্পু পেন্নাম কর। দেখতে না পেলে কী হয়েছে? হাতজোড় করলেই হবে।
পাঁচু আর পাঁচুর দু’জনেই হাতজোড় করে মাথা নামিয়ে অদৃশ্য কাউকে প্রণাম জানাল। আর খড়মের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা হাওয়া ঘোষডাঙ্গার দিক থেকে এগিয়ে এসে হঠাৎ তাদের সামনে যেন থমকে গেল। তারপর সেই রাশভারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল আবার। এবার একেবারে সামনে থেকে।
—মরতে যাচ্ছিলে কেন?
পাঁচু এদিক ওদিক ঘুরে কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে ওঠে—
—রাজামশাই, আঁজ্ঞে আপনাকে সব বলবো। কিন্তু সামনে কেউ না থাকলে কথা বলব কী করে? তবে তার আগে আপনাকে আমাদের পরিচয়টা দিই।
—কোন প্রয়োজন নেই। আমরা সব জানতে পারি। তুমি পঞ্চানন আর ও হল চম্পা। তবে আমি রাজা নই। মনুষ্যেরা তাদের কল্পনায় এসব গপ্পো বানায় বটে তবে আমাদের সমাজে কোন রাজা প্রজা মন্ত্রী-সান্ত্রী নেই। আমি বয়োজ্যেষ্ঠ ব্রহ্মদৈত্যদের অগ্রজ। তাই এ সমাজে আমায় সবাই মানে গোণে।
পাঁচু ভাবছিল বলবে তাঁকে তারা কী বলে ডাকবে? কিন্তু পাঁচুর মনে ভাবনা উদয় হতে না হতেই উত্তর এলো
—দাঠাকুর বলো।
পাঁচুর মনে হল এইভাবে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কথা বলবে কী করে? আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দু’ জনের সামনে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে আকার নিতে লাগলো। প্রথমে মাটি থেকে একটু উপরে এক জোড়া রূপোর খড়ম লুঙ্গির মতো করে পরা সাদা সিল্কের ধুতি। খালি গা ধবধবে সাদা উপবীত। গায়ে সাদা সিল্কের উড়ুনি, বুক অবধি সাদা দাড়ি কাঁধ-ছাপানো ঢেউ খেলানো সাদা চুল। চোখে একটা কালো রোদচশমা। বয়স্ক ব্রাহ্মণ এর মতই চেহারা।
পাঁচু ও পাঁচি অবাক হয়ে দা’ঠাকুরকে তাকিয়ে দেখে। তাঁকে আবার প্রণাম করে। দা’ঠাকুর দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেন। পাঁচু একটু মাথা চুলকে বলে—
— দা’ঠাকুর!
দা’ঠাকুর সর্বজ্ঞ। স্মিত হেসে বলেন
—মনের মধ্যে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে পঞ্চানন?
—আঁজ্ঞে। কয়েকটা।
পাঁচি হাত চেপে ধরে পাঁচুকে বলে—
— কিগো ঠাকুর? কী এত প্রশ্ন তোমার?
আরও পড়ুন:

কিম্ভূতকাণ্ড, পর্ব-৩: হঠাৎ মেয়েলি খোঁনা গলায় কে যেন খিলখিল করে হেসে বলল—ভঁয় পেঁলে নাঁকি ঠাঁকুর!

শীতকালে শ্বাসকষ্ট বাড়ে? হার্ট ও কিডনির যত্ন নেবেন কীভাবে? চনমনে থাকতে জেনে নিন ডাক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৬: সংসার সুখের হয় ‘চাঁপাডাঙার বৌ’-র গুণে

দাদা ঠাকুর আবার স্মিত হাসেন।
—আহা বাধা দিওনা চম্পা! বল পঞ্চানন তোমার কী কী জানবার আছে।
—কিছু মনে করবেন না যা ঠাকুর আপনার কি সদ্য ছানি কাটানো হয়েছে মানে চোখের চশমাটা তো ছানি কাটালে পরতে দেয়।
হা হা করে হাসতে থাকেন দা’ঠাকুর। চতুর্দিক যেন কেঁপে ওঠে। হাসতে হাসতে বলেন একজন তাঁকে আদর করে পরতে দিয়েছে। মানে দা’ঠাকুর নিজেই চেয়ে নিয়েছেন। আসলে ছানি কাটাতে চোখ নষ্ট তো অনেকের হয়। কিন্তু জীবন নষ্ট তো হয় না। অপারেশনের ভুলে চোখ থেকে গোটা মুখে সেপটিক হয়ে এক মাস্টারমশাই মানব জন্ম থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মানবকীর্তির এ এক বিরল ঘটনা। মাস্টারমশাই চোখে চশমাটি লাগানোর আগে তো বুঝতে পারেননি চোখও যাবে জীবনও যাবে। দাঠাকুর জানতে চান পরের প্রশ্ন কী কী?
—আঁজ্ঞে ভূতেরা কী কী খায়।
—কিছুই খায় না। আমাদের শরীর নাই-রোগ-ব্যাধি নাই ক্ষুধানুভব তৃষ্ণা কিছুই নাই।
—কিন্তু দা’ঠাকুর সত্যনারায়ণ পুজো সেরে ফেরার পথে এই পোড়া বেলগাছতলাতেই একজন আমার কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে কলা চেয়েছিল।
পাঁচি এ ঘটনা জানে না তাই সে বেশ অবাক হল।
—খাবার জন্য নয়, সে অযথা ফক্কুড়ি করেছিল এবং তার শাস্তিও পেয়েছে।
—আগে শুনেছি শাকচুন্নি ইলিশ মাছ চেয়ে খায়।
—দেখ পঞ্চানন, আমাদের মানে ভূতেদের নিয়ে মানুষের কৌতূহল অলীক কল্পনার কোন শেষ নেই। অবশ্য ওসবে আমাদের কোনও উৎসাহ নেই। মানবজাতি সম্বন্ধে আমাদের কোনো আগ্রহও নেই। তোমার বোধকরি আরো একটি প্রশ্ন আছে।
আরও পড়ুন:

ষাট পেরিয়েঃ সুস্থ বার্ধক্যের চাবিকাঠি সঠিক পুষ্টি/১

হেলদি ডায়েট: কিডনির সমস্যা? নজর দিন রোজকার খাদ্যাভ্যাসে, পাতে কী কী থাকবে, আর কোনগুলি এড়াবেন? দেখুন ভিডিয়ো

৭৮ বছর বয়সে নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভীষ্ম পিতামহ/৩

—আঁজ্ঞে এটাই শেষ। শরীর যদি নেই তবে আপনাকে দেখছি কী করে?
—অবয়ব ধারণ করেছি তাই, আমি ইচ্ছা করছি তাই তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ। তোমাদের আশেপাশে আরও অনেকে রয়েছে। তাদের তোমরা দেখতে পাচ্ছ না। তোমরা মানব জন্মে রয়েছো তাই এটা ঠিক বুঝতে পারবে না। ভূতজন্মে তুমি যা করার ইচ্ছা করবে সেটাই করতে পারবে। ইচ্ছা করলে যে কোন অবয়ব ধারণ করতে পারবে। ইচ্ছা করলেই অদৃশ্য হতে পারবে। এক লহমায় কয়েক যোজন পথ অতিক্রম করতে পারবে বিনা বাধায় হাওয়ার বেগে ইটের দেওয়াল চলন্ত ট্রেন ভেদ করে যেতে পারবে। দেখো এখনি আমাদের বিচারসভা শুরু হবে। তার আগে আমি যে প্রশ্ন করেছিলাম তার উত্তর জানতে চাই, তোমরা মরতে এসেছিলে কেন?
পাঁচির দিকে একবার তাকিয়ে পাঁচু বলে ওঠে।
—আঁজ্ঞে!! বেস্পতিবার অমাবস্যার রাতে বেলগাছে গলায় দড়ি দিয়ে মরে আমি বেম্যদত্যি হতে চেয়েছিলুম। শেষ মুহূর্তে পাঁচি এসে জুটল। বলল বাজপড়া গাছ দু’জনে একসঙ্গে ঝুললে যদি ডাল ভেঙ্গে পড়ে, তার চেয়ে গোলার ধেড়ে ইঁদুর গোয়ালের সাপ মারার মারাত্মক বিষ আছে সেটা মুখে দিলে এক মুহূর্তে…
আরও পড়ুন:

লিয়োনেল মেসি…রূপকথা নয়, এক কঠোর কঠিন বাস্তব

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৪: কবির দরজা সাধারণজনের জন্য সারাক্ষণই খোলা থাকত

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৪: বাংলার শুঁটকি মাছের চাহিদা সর্বত্র, এখনকার বিশেষভাবে প্রস্তুত শুঁটকি অনেক বেশি নিরাপদ ও পুষ্টিগুণে ভরা

পাঁচু দা’ঠাকুরকে তার মানবজন্মের কষ্ট ও যন্ত্রণার সব কথা জানালো। পাঁচিকে বিয়ে করার ইচ্ছে কানাই কোবরেজের অপমান পাঁচিকে আটকে রেখে চালের আড়ৎদার নটবরের সঙ্গে পাঁচির বিয়ে দেবার চেষ্টা। কিছু বাদ দিল না। দা’ঠাকুর জানালেন এসবই তার জানা। কিন্তু এসব বলার পর আর ওদের মনে এসবের কোনও দুঃখ থাকবে না। তাদের মৃত্যু যোগ নেই। তাই তারা জীবিত আছে। কিন্তু দা’ঠাকুরের আশীর্বাদে তাদের আত্মা ভূতজন্মের পরিপূর্ণ সুযোগ-সুবিধে উপলব্ধি ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু তাদের মানবজন্মের মায়া এখনও কাটেনি মৃত্যুর পরেও অনেকেরই এমন হয়। এই যেমন স্কন্দকাটা ন্যারোগেজ লাইনে মাথা কেটে দূর্ঘটনায় মৃত্যু। কারখানায় কাজ করত, টাইম আপিসের বড়বাবু ছিলেন ইন্সিওরেন্সের দালাল। জোর করে ধমকধামক দিয়ে মোটা টাকার ইনসিওর করিয়ে দিয়েছিলেন। স্কন্দ মরতে সংসারের ক্ষতির বদলে লাভই হল। বাড়ি দোতলা হল। ছেলেদের বিয়ে-থা হল। ভাইয়েরা খরচাপাতি করে বোনের বিয়ে দিল। তবু স্কন্দ’র সংসারের মায়া এখনও কাটেনি। আর একটা মায়া হল তার ফেলে আসা মুণ্ডুটা। ঠাকুর তাকে মন্ত্র পড়ে একটা মুণ্ডু বানিয়ে দিয়েছিল। মাঝেমধ্যে মণ্ডুটা গলার ওপর পরে। মাঝে মধ্যে আবার ভার-ভার ঠেকে তখন মুণ্ডু রেখে কাটাগলায় ঘুরে বেড়ায়।
—আঁজ্ঞে!! তার মানে আমরা না-মরে ভূত হব?
—কতকটা সেই রকম।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৭: পিতৃসত্য রক্ষা, নাকি পিতার অনুনয়ে রাজ্যভার গ্রহণ?

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৬: ভৃগুবংশে জন্ম নিলেন পরশুরাম— চরুবদলের ভুলে ক্ষত্রতেজ পেলেন তিনি

খাই খাইঃ জিলিপি খেতে ভালোবাসেন? তাহলে আর দেরি কেন? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন গরম গরম আনারসের জিলিপি

পাঁচি এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি এবার জিজ্ঞেস করল।
—দা’ঠাকুর আমাদের দেহ দুটো কী হবে?
—আমার জিম্মায় সযত্নে থাকবে কোন চিন্তা করো না। কেউ খুঁজে পাবে না। তোমরা চাইলে আবার সে দেহ ধারণ করে মানবজন্মে ফিরে যাবে।
পাঁচুর মনে আবার প্রশ্ন খচখচ করে, কিন্তু প্রশ্ন করার আগেই উত্তর আসে।
—চিন্তা করো না পঞ্চানন। তোমাদের দেহ যেমন আছে তেমনি অক্ষয় থাকবে। এবার আমাদের সভা শুরু হবে। তোমরা চুপ করে দেখ কথা বলো না কেমন। তোমদের আত্মাকে আমি তোমাদের দেহ থেকে মুক্ত করে দিলাম। তোমরাও এখন হাওয়ার মধ্যে ভাসতে পারবে। অদৃশ্য বা অবয়বে থাকতে পারবে।
আচমকা যেন একটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে গেল দুজনের শরীরে। ঘাবড়ে পাঁচু চেঁচিয়ে ওঠে
—ও চাম্পু!! চাম্পু রে!!!
চম্পা ওরফে পাঁচি ফিসফিস করে বলে
—বলো- চেঁচাচ্ছো কেন? দাঠাকুর বললেন না, কথা বলা মানা।
এবার পাঁচু চাপাস্বরে জানতে চায়
—শুনতে পাচ্ছিস!
—পাচ্ছি!
—দেখতে পাচ্ছিস!
—হ্যাঁ আমি বেলগাছের ওপরে হাওয়ায় ভাসছি!
—আমিও ভাসছি রে চাম্পু! আমায় দেখতে পাচ্ছিস !
—পাচ্ছি কিন্তু তোমায় নয় একটা কমলা রঙের ধোঁওয়া মতো! তুমি একটু নিচে।
—তুই সবজে! ওই তো বেলগাছের মগডালে, আসছি আমি।
আরও পড়ুন:

দশভুজাঃ যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১

ইংলিশ টিংলিশ: জানেন কি ‘night owl’ বা ‘early bird’ কাকে বলে? কিংবা তিনতলাকে কেন ‘second floor’ বলে?

পাহাড়ের উপর ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা— চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক অজানা অধ্যায়

এরমধ্যে সমবেত ভূতেদের না কি সুরে গুঞ্জন শোনা যায়। চাপাস্বরে পাঁচু বলে, ‘চাম্পু এবার মিটিং শুরু হবে, হাতটা শক্ত করে ধর—এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে গেলে ভূতেদের ভিড়ে আর খুঁজে পাবো না। ’
—কেন? মনে মনে ভাববে চাম্পুর কাছে যাব ব্যাস।
—ঠিক কথা। আয় বেলগাছের মগডালে একটু ঠেকনা দিয়ে বসি।
পোড়া বেলগাছতলায় স্কন্ধকাটা ভূত। একটা আলোর সিংহাসন গোছের কিছু রাখল। তাতে বসলেন দা’ঠাকুর। শুরু হল সভা।
দাঠাকুর স্কন্ধকাটা ভূতের কাছে জানতে চাইলেন সেদিনের সভার অ্যাজেন্ডা আই মিন আলোচ্য বিষয়াদি কী কী!! বলা হয়নি স্কন্ধকাটা দা’ঠাকুরের মন্ত্রপূত মাথাটা সেদিন গলার ওপর ফিট করে এসেছিল। সে জানাল মূল অভিযোগ পিশাচের আবার নিশির অভিযোগও এসে যাচ্ছে। অভিযোগ মামদোর বিরুদ্ধে!!—চলবে
* কিম্ভূতকাণ্ড (Kimbhoot kanda – Horror Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content