অলঙ্করণ: পাপিয়া দেবনাথ
গ্রামের নাম গড়াগাছি। এখন সেটা পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার থেকে খানিক দূরে দক্ষিণ বরাবর। গড়াগাছি থেকে পূবমুখে গেলে গঙ্গানদী। কী খেয়ালে যেন গঙ্গানদী এখানে লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে গিয়েছে। তখনও বর্ধমানের কাটোয়া জংশন-এর মধ্যে ম্যাকলিওড কোম্পানির ছোটরেল রমরম করে চলছে। গ্রাম তখনও পাড়াগাঁ-ই আছে— বন-জঙ্গল, পুকুর-মরাই-সবজি বাগানে ভরা। না ছিল এখনকার মতো চকচকে পিচঢালা রাস্তা না নিয়ন আলোর ঝকঝকে রাত। জল ছিল হাওয়া ছিল— মোবাইলের পিঁকপিঁক বা হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টা, ফেসবুক ছিল না। সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত একটানা চলতে থাকা টিভি সিরিয়াল ছিল না। রাত বাড়লে অন্ধকার আরও ঘন হতো। নিশ্চুপ হয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম। টিম টিম করে হারিকেনের আলো জ্বলত। তাই অমাবস্যায় কুচকুচে কালো নিশুতি রাত ছিল। গা-ছমছমে চাঁদের আলো ছিল আর ছিলেন তেঁনারা।
আসলে ভূতেরা একা একা থাকতে পারে না। দু-একজনকে কখনও একটা পুরনো বদ্ধ বাড়ি বা বাংলোতে আটকে থাকতে হয়। তাদের ওপর অভিশাপ থাকে। কিন্তু মোটের ওপর তেঁনারা মানুষের মতো একালসেঁড়ে নয়, আর ভূতেরা কক্ষনও একে অপরের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে না। তার মানে এটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না ভূত সমাজে খারাপ ভূত নেই। খারাপ বদমাইশ লোক মরে তো খারাপ হবেই। কিন্তু পরপারের শৃঙ্খলা তাদের খারাপ কাজ করতে দেয় না। কখনও-সখনও ভুলচুক করলে দা’ঠাকুরের নাক চাপটি খেতে হয়।
দা’ঠাকুর কে সেটা বলার আগে তিনি কোথায় থাকেন সেটা বলা খুব জরুরি।
গ্রামের শেষে ছিল ঘোষডাঙ্গা। সেখানে ছিল ঘোষেদের পেল্লায় বাড়ি। সেই বাড়ির পাশেই বাজ পড়ে, পুড়ে খাক হল গোটা একটা বেল গাছ। পুড়ে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া গাছের কঙ্কাল এখনও দাঁড়িয়ে। জায়গাটার নাম পোড়া বেলগাছতলা। ঘোষেদের বাড়িতে বহুদিন কেউ থাকে না। একসময় তাদের জমিদারি ছিল। এখন তাদের জমাদারেও থাকে না এখানে। কত্তারা সব মারা গিয়েছেন। ইস্কুল-কলেজে পড়া পরের প্রজন্ম অজগ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গিয়েছে।
আসলে ভূতেরা একা একা থাকতে পারে না। দু-একজনকে কখনও একটা পুরনো বদ্ধ বাড়ি বা বাংলোতে আটকে থাকতে হয়। তাদের ওপর অভিশাপ থাকে। কিন্তু মোটের ওপর তেঁনারা মানুষের মতো একালসেঁড়ে নয়, আর ভূতেরা কক্ষনও একে অপরের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে না। তার মানে এটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না ভূত সমাজে খারাপ ভূত নেই। খারাপ বদমাইশ লোক মরে তো খারাপ হবেই। কিন্তু পরপারের শৃঙ্খলা তাদের খারাপ কাজ করতে দেয় না। কখনও-সখনও ভুলচুক করলে দা’ঠাকুরের নাক চাপটি খেতে হয়।
দা’ঠাকুর কে সেটা বলার আগে তিনি কোথায় থাকেন সেটা বলা খুব জরুরি।
গ্রামের শেষে ছিল ঘোষডাঙ্গা। সেখানে ছিল ঘোষেদের পেল্লায় বাড়ি। সেই বাড়ির পাশেই বাজ পড়ে, পুড়ে খাক হল গোটা একটা বেল গাছ। পুড়ে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া গাছের কঙ্কাল এখনও দাঁড়িয়ে। জায়গাটার নাম পোড়া বেলগাছতলা। ঘোষেদের বাড়িতে বহুদিন কেউ থাকে না। একসময় তাদের জমিদারি ছিল। এখন তাদের জমাদারেও থাকে না এখানে। কত্তারা সব মারা গিয়েছেন। ইস্কুল-কলেজে পড়া পরের প্রজন্ম অজগ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গিয়েছে।
নোনাধরা চটাওঠা পাঁজর-বেরোনো বাড়িটার দিকে তাকালে দিনের বেলাতেই গা-ছমছম করে। সরু বাঁকানো ইঁটের ইয়া মোটা-মোটা থাম, দেওয়াল। বাড়ির পাঁচিল ফাটিয়ে বট-অশ্বত্থের ডাল বেরিয়ে পড়েছে। নিচের ঘরগুলোয় বাদুড় চামচিকের আস্তানা। দোতলার কার্নিশের খোপে-খাঁজে ভীমরুল মৌমাছির চাক! সে পোড়োবাড়ির সামনে দিয়ে বাঁশের সাঁকো গিয়েছে। ক্বচিৎ কখনও দিনের বেলাতেই গ্রামের লোকজন ঘুরপথ এড়িয়ে সে রাস্তায় যাতায়াত করে।
দা-ঠাকুর সমেত তেঁনারা থাকেন ঘোষডাঙার এই পোড়োবাড়িতে। আর পোড়া বেলগাছতলায় তাঁদের জমায়েত হয়। দা’ঠাকুর বেম্যদত্যি! সক্কলে তাঁকে মানেগোণে। দা’ঠাকুর ঘোষবাড়ির তেতলার চিলেকোঠার ন্যাড়াছাতে বসেন। তার রূপোর খড়মপরা পা-দুটো এসে ঠেকে ঘোষবাড়ির দোতলার ছাতের আলসেতে। আবার কখনও ইচ্ছে হলে তেতলায় বসে চরণযুগল নামিয়ে দেন। একতলার ভাঙা পাঁচিলের ওপর। ভূতেদের তো চেহারার বালাই নেই। তারা একটা ঘরেই অনেকে ঠাসাঠাসি করে থাকতে পারে। ভূতেদের খিদেতেষ্টা নেই। জ্বরজ্বালি অসুখবিসুখও নেই। ঝগড়াঝাঁটি খুনোখুনির বালাই নেই। ভূতসমাজে ছোটরা বয়োজেষ্ঠ্যদের ভক্তি-শ্রদ্ধা-সম্মান করে। মানুষদের মতো তারা উদ্ধত নয়। কেউ তেমন কিছু বেয়াদপী করলে শাস্তিটা ভয়ানক।
এ গ্রামে থাকত গোপাল ভটচায্যি। সৎ সাত্ত্বিক সাদাসিদে ব্রাহ্মণ। গ্রামে ব্রাহ্মণ ডেকে নিত্য পুজোপাঠ করানোর লোকজন বেশি ছিল না। সামান্য যে ক’জন স্বচ্ছল যজমান ছিল তাদের বাড়িতে পালাপার্বণ বিয়ে শ্রাদ্ধ আর গ্রামের শিবমন্দিরে পুজো করেই কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাত গোপাল ঠাকুর। এক যজমান ছিল পরাণ উকিল। সেই পরাণ আর গোপাল ছেলেবেলায় একসঙ্গে খেলাধুলো করতো। সেই হিসেবে তারা বন্ধু। কিন্তু ছোটবেলার দুই বন্ধু বড় হয়ে একজন কালোকোট চাপিয়ে সদরের উকিল। বিস্তর রোজগার। আর অন্যজন গায়ে নামাবলি দু-হাতে সিংহাসন সমেত নারায়ণশিলাকে বুকে জড়িয়ে যজমানের বাড়ি বাড়ি পুজো করে বেড়ায়। বাজারে আকাল লাগল। খাওয়াদাওয়ার জুত নেই, যথারীতি গোপালের শরীরে রোগজ্বালা বাসা বাঁধল। ক্রমে শরীর আর দেয় না। প্রণামীর সামান্য ক’টা টাকায় আর চলছে না। বাড়িতে ছেলে পাঁচু বৌ নিয়ে দু’বেলা ছ’ছটা পাত।
দা-ঠাকুর সমেত তেঁনারা থাকেন ঘোষডাঙার এই পোড়োবাড়িতে। আর পোড়া বেলগাছতলায় তাঁদের জমায়েত হয়। দা’ঠাকুর বেম্যদত্যি! সক্কলে তাঁকে মানেগোণে। দা’ঠাকুর ঘোষবাড়ির তেতলার চিলেকোঠার ন্যাড়াছাতে বসেন। তার রূপোর খড়মপরা পা-দুটো এসে ঠেকে ঘোষবাড়ির দোতলার ছাতের আলসেতে। আবার কখনও ইচ্ছে হলে তেতলায় বসে চরণযুগল নামিয়ে দেন। একতলার ভাঙা পাঁচিলের ওপর। ভূতেদের তো চেহারার বালাই নেই। তারা একটা ঘরেই অনেকে ঠাসাঠাসি করে থাকতে পারে। ভূতেদের খিদেতেষ্টা নেই। জ্বরজ্বালি অসুখবিসুখও নেই। ঝগড়াঝাঁটি খুনোখুনির বালাই নেই। ভূতসমাজে ছোটরা বয়োজেষ্ঠ্যদের ভক্তি-শ্রদ্ধা-সম্মান করে। মানুষদের মতো তারা উদ্ধত নয়। কেউ তেমন কিছু বেয়াদপী করলে শাস্তিটা ভয়ানক।
এ গ্রামে থাকত গোপাল ভটচায্যি। সৎ সাত্ত্বিক সাদাসিদে ব্রাহ্মণ। গ্রামে ব্রাহ্মণ ডেকে নিত্য পুজোপাঠ করানোর লোকজন বেশি ছিল না। সামান্য যে ক’জন স্বচ্ছল যজমান ছিল তাদের বাড়িতে পালাপার্বণ বিয়ে শ্রাদ্ধ আর গ্রামের শিবমন্দিরে পুজো করেই কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাত গোপাল ঠাকুর। এক যজমান ছিল পরাণ উকিল। সেই পরাণ আর গোপাল ছেলেবেলায় একসঙ্গে খেলাধুলো করতো। সেই হিসেবে তারা বন্ধু। কিন্তু ছোটবেলার দুই বন্ধু বড় হয়ে একজন কালোকোট চাপিয়ে সদরের উকিল। বিস্তর রোজগার। আর অন্যজন গায়ে নামাবলি দু-হাতে সিংহাসন সমেত নারায়ণশিলাকে বুকে জড়িয়ে যজমানের বাড়ি বাড়ি পুজো করে বেড়ায়। বাজারে আকাল লাগল। খাওয়াদাওয়ার জুত নেই, যথারীতি গোপালের শরীরে রোগজ্বালা বাসা বাঁধল। ক্রমে শরীর আর দেয় না। প্রণামীর সামান্য ক’টা টাকায় আর চলছে না। বাড়িতে ছেলে পাঁচু বৌ নিয়ে দু’বেলা ছ’ছটা পাত।
আরও পড়ুন:
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৪৫: বসুন্ধরা এবং…
হোমিওপ্যাথি: অর্শে কষ্ট পাচ্ছেন? রেহাই পেতে জেনে নিন কী করবেন, কী করবেন না
একটুও শরীরচর্চার সময় পান না? জেনে নিন রাতে হাঁটার একাধিক উপকারিতা
ইংলিশ টিংলিশ: I talk কিন্তু he talks কেন হয়? সঙ্গে আরও জেনে নাও be এবং have verb-এর সঠিক প্রয়োগ
দিনে দিনে সামান্য চাল-ডাল-নুন-তেলের জোগাড় করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। উপায়হীন গোপাল পরাণকে বলে বসলো, পুজো করে আর সংসার চলছে না বলে-কয়ে চেনা-জানা কোথাও একটা বাঁধা-মাইনের চাকরি করিয়ে দিতে। মাইনেকড়ি কম হলেও ক্ষতি নেই। পরাণ বন্ধুকে বুঝিয়ে বলে আজীবন পুজোই করেছে। এ বয়েসে নতুন করে চাকরি সে করতে পারবে না। পরাণ হাজার টাকা ধার দিল। বলল পরে শোধ করে দিতে। যার রোজগার নেই, সে টাকা শুধবে কী করে? ফলে ঋণের বোঝা বাড়তে লাগল। ধার পাঁচ হাজার টাকা পৌঁছতেই পরাণ একটা কিছু বাঁধা রাখতে বলল। গয়নাগাটি জমি-বাড়ির দলিল যেকোনও কিছু। গয়নাগাটি তো কিছুই নেই। থাকার মধ্যে একটু ধানিজমি আর একটা পুকুর। ঋণের দুশ্চিন্তায় গোপালের রাতে ঘুম নেই। চিন্তায় চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠল। পরাণ একটু আধটু কুমিরের কান্না কাঁদল বটে, কিন্তু অসুস্থ গোপাল চোখ বুজতেই তার জমি-পুকুর সব গিলে খেল।
তারপর এর মাঝে অনেকগুলো বছর কাটলো। বাবার নারায়ণ শিলা নিয়ে পাঁচু ঠাকুর মানে শ্রীমান পঞ্চানন ভট্টাচার্য সামান্য কয়েকজন টিকে থাকা যজমানের বাড়িতে পুজোআচ্চা করে। তাদের মধ্যে এক যজমান হল কুচুটে বজ্জাত পরাণ উকিল। কোন গতিকে বিধবা মাকে নিয়ে পাঁচুর দিন কাটে।
পাঁচু পরাণ উকিলের বাড়ি পুজো সেরে পোড়া বেলগাছতলা দিয়ে ঘোষডাঙা হয়ে বেলাবেলি ঘরে ফেরে সেদিন কত্তামার হাঁপের টান ওঠায় সত্যনারানের পুজো সারতে দেরি হল। এখন পাঁচু তিন সেলের টর্চলাইট ব্যবহার করে। কেরোসিনের থেকে সস্তা পড়ে। অবিশ্যি পাঁচুর মতো টর্চের ব্যাটারিতে জোর নেই। টিমটিমে আলো। সামনে পা-ফেলার জমিটুকুতে আলো পড়ে- দূরে আলো ফেলা যায় না।
তারপর এর মাঝে অনেকগুলো বছর কাটলো। বাবার নারায়ণ শিলা নিয়ে পাঁচু ঠাকুর মানে শ্রীমান পঞ্চানন ভট্টাচার্য সামান্য কয়েকজন টিকে থাকা যজমানের বাড়িতে পুজোআচ্চা করে। তাদের মধ্যে এক যজমান হল কুচুটে বজ্জাত পরাণ উকিল। কোন গতিকে বিধবা মাকে নিয়ে পাঁচুর দিন কাটে।
পাঁচু পরাণ উকিলের বাড়ি পুজো সেরে পোড়া বেলগাছতলা দিয়ে ঘোষডাঙা হয়ে বেলাবেলি ঘরে ফেরে সেদিন কত্তামার হাঁপের টান ওঠায় সত্যনারানের পুজো সারতে দেরি হল। এখন পাঁচু তিন সেলের টর্চলাইট ব্যবহার করে। কেরোসিনের থেকে সস্তা পড়ে। অবিশ্যি পাঁচুর মতো টর্চের ব্যাটারিতে জোর নেই। টিমটিমে আলো। সামনে পা-ফেলার জমিটুকুতে আলো পড়ে- দূরে আলো ফেলা যায় না।
আরও পড়ুন:
বাইরে দূরে: অযোধ্যা— প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১
খাই খাই: রোজ রোজ এক রকম খাবারে অরুচি? খুদের জন্য রইল ভিন্ন স্বাদের এই রেসিপি
বাস্তুবিজ্ঞান, পর্ব-১৪: আধুনিক কম্পাসে খুব সহজেই জমির দিক, অঞ্চল ও কোণ নির্ণয় করা যায়
দশভুজা: তিনিই সারস্বত সাধনার প্রতিরূপা সত্যিকারের দশভুজা
ছোটবেলায় যাদের কাকা-কাকি বলত, এখন পাঁচু তাঁদেরই কত্তাবাবু-কত্তামা বলে ডাকে। পাঁচু সরল, পাঁচু বোকা। সকলেই পাঁচুকে ঠকায়। দশ বছর আগে পাঁচুর বাবাকে যে টাকা দক্ষিণা দিত পরাণ উকিল, আজও পাঁচুকে সে টাকাই দেয়। এত ধুরন্ধর, মুখে বলে
— তোমায় ইচ্ছে থাকলেও বেশি দক্ষিণা দিতে পারব না পাঁচু ঠাকুর। তাহলে যে তোমার বাবাকে ছোট করা হবে। বাবাকে ছোট করে তুমিও কি শান্তি পাবে? পাবে না।
মা- শুনে বলে—
—লোকে বলে গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি। পরাণ ঠাকুরপো’র তো দেকচি রোমে রোমে বুদ্ধি।
তো পরাণ উকিলের বাড়ি থেকে সন্ধেবেলা ‘রামনাম’ জপ করতে করতে যেই পোড়া বেলগাছতলা টপকেছে হঠাৎ গাছের শুকনো দাঁত বের করা কালচে ডাল থেকে হাওয়ায় ভেসে নেমে এল একানড়ে। ভাটার মতো সবজে চোখ, একটা ধোঁয়াটে শরীর ক্রমাগত যেন নড়ছে। ভয়ে চোখ বুজে ফেললেও ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু নজরে এসেছে তাতে পাঁচুর একানড়েকে চিনতে কোনও ভুল হয়নি। ছোট্টবেলা থেকে মা’র কাছে গল্প শুনছে—একটা চোখ, একটাই পা কিংবা ন্যাজ যাই বলো। হাতও একটাই। সেই ধোঁয়া-ধোঁয়া একখানা হাত বাড়িয়ে খোঁনা গলায় বলে উঠল—
—এঁই পাঁচুঠাঁকুর কঁলা দেঁ নাঁ খাঁই!!
পাঁচু চোখ বুজে কাঁপতে কাঁপতে রামনাম জপতে লাগল। একনড়ে নড়তে নড়তে এগিয়ে আসছিল। একটা যেন তরকারি-চোঁয়া গন্ধ। হঠাৎ ঘোষবাড়ির দিক থেকে কি যেন ধাঁ করে ছুটে এল আর ‘চটাৎ’ করে একটা শব্দ।
—বাঁবাগো! গেঁছি গোঁ।
বলেই একানড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাড়ির বাকি রাস্তা পাঁচু প্রায় চোখবুজে দৌড় লাগাল। বাড়িতে এসে জ্ঞান হারাল পাঁচুঠাকুর। পাঁচুর মা অনেকক্ষণ জলঝাপটা দেবার পর পাঁচুর জ্ঞান ফিরল।
পাঁচু বুঝতেও পারেনি স্বয়ং দা’ঠাকুর পাঁচুকে ভয় দেখানোর জন্যে শাস্তি দিয়েছেন। তার কঠিন হাড়ের হাতে একটি বিরাশি সিক্কার নাকচাপটি। ‘ক্ষমতা আছে বলেই ভয় দেখাবে? এসব বজ্জাতি ভূতসমাজে চলে না।’ শুধু তাই নয়, ভয়ে পালাতে গিয়ে পাঁচু ঠাকুরের ফেলে যাওয়া টর্চলাইট ফেরত করার হুকুম দিলেন। পুরোনো ব্যাটারির জোর বাড়িয়ে নতুনের মতো করে দিতে হল একানড়েকে।
— তোমায় ইচ্ছে থাকলেও বেশি দক্ষিণা দিতে পারব না পাঁচু ঠাকুর। তাহলে যে তোমার বাবাকে ছোট করা হবে। বাবাকে ছোট করে তুমিও কি শান্তি পাবে? পাবে না।
মা- শুনে বলে—
—লোকে বলে গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি। পরাণ ঠাকুরপো’র তো দেকচি রোমে রোমে বুদ্ধি।
তো পরাণ উকিলের বাড়ি থেকে সন্ধেবেলা ‘রামনাম’ জপ করতে করতে যেই পোড়া বেলগাছতলা টপকেছে হঠাৎ গাছের শুকনো দাঁত বের করা কালচে ডাল থেকে হাওয়ায় ভেসে নেমে এল একানড়ে। ভাটার মতো সবজে চোখ, একটা ধোঁয়াটে শরীর ক্রমাগত যেন নড়ছে। ভয়ে চোখ বুজে ফেললেও ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু নজরে এসেছে তাতে পাঁচুর একানড়েকে চিনতে কোনও ভুল হয়নি। ছোট্টবেলা থেকে মা’র কাছে গল্প শুনছে—একটা চোখ, একটাই পা কিংবা ন্যাজ যাই বলো। হাতও একটাই। সেই ধোঁয়া-ধোঁয়া একখানা হাত বাড়িয়ে খোঁনা গলায় বলে উঠল—
—এঁই পাঁচুঠাঁকুর কঁলা দেঁ নাঁ খাঁই!!
পাঁচু চোখ বুজে কাঁপতে কাঁপতে রামনাম জপতে লাগল। একনড়ে নড়তে নড়তে এগিয়ে আসছিল। একটা যেন তরকারি-চোঁয়া গন্ধ। হঠাৎ ঘোষবাড়ির দিক থেকে কি যেন ধাঁ করে ছুটে এল আর ‘চটাৎ’ করে একটা শব্দ।
—বাঁবাগো! গেঁছি গোঁ।
বলেই একানড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাড়ির বাকি রাস্তা পাঁচু প্রায় চোখবুজে দৌড় লাগাল। বাড়িতে এসে জ্ঞান হারাল পাঁচুঠাকুর। পাঁচুর মা অনেকক্ষণ জলঝাপটা দেবার পর পাঁচুর জ্ঞান ফিরল।
পাঁচু বুঝতেও পারেনি স্বয়ং দা’ঠাকুর পাঁচুকে ভয় দেখানোর জন্যে শাস্তি দিয়েছেন। তার কঠিন হাড়ের হাতে একটি বিরাশি সিক্কার নাকচাপটি। ‘ক্ষমতা আছে বলেই ভয় দেখাবে? এসব বজ্জাতি ভূতসমাজে চলে না।’ শুধু তাই নয়, ভয়ে পালাতে গিয়ে পাঁচু ঠাকুরের ফেলে যাওয়া টর্চলাইট ফেরত করার হুকুম দিলেন। পুরোনো ব্যাটারির জোর বাড়িয়ে নতুনের মতো করে দিতে হল একানড়েকে।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৫: বনবাসের সঙ্গী সীতা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২৮: অনুপুষ্টিতে ভরপুর পুঁটিমাছ ছোটদের দৃষ্টিশক্তির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
পর্দার আড়ালে, পর্ব-২০: মাধবী ও অনিল ফ্লোরে সংলাপ ঠিক করার সময় হঠাৎ কানে এল বিকট এক শব্দ, সবাই চমকে উঠলেন
পাঁচু সিধেতে চাল-ডাল-আলু-কলা সামান্য ফলমূল যা এনেছিল মা-বেটা তাই খেল। শোবার সময় মাদুরের পাশে টর্চলাইটটা পেয়ে চমকে উঠলো। টর্চলাইট জ্বালাতেই গোটা ঘর আলোয় যেন ঝলসে উঠলো। এটা কী করে হল? মা এসে বলল—
—বাবা কিসের এতো আলো রে?
—টর্চলাইট।
—বাবা, তোর টর্চলাইট তো তেলের কুপির থেকেও কম আলো ছিল। এমন হ্যাচাকের মতো আলো? ব্যাটারি নতুন বুঝি?
—নানা, আগের ব্যাটারি, একজন সারিয়ে দিল।
মাকে এই মিথ্যেটুকু না বললে অনর্থ হয়ে যেত। কিন্তু পাঁচু এটা বুঝেছে তেঁনাদের অসীম ক্ষমতা। আর তেঁনারা পাঁচুকে অপছন্দ করে না।
কিন্তু কানাই কোবরেজ যে পাঁচুকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। কানাই কোবরেজ হল কানাইলাল চক্কোত্তি। বেঁটেখাটো। ছোটছোট হাত। মাথাজোড়া টাক। তাতে বাঁ দিকে কানের পাশে সিঁথি কেটে গুটিকয়েক চুলকে আঁচড়ে চকচকে টাকের ওপর তাঁতির ঘরে রংকরা সুতো শুকোতে দেবার মতো ফেলে রেখে টাকমাথা ঢাকার বৃথা চেষ্টা। কিন্তু তার ভয়ানক মেজাজ। না মানে না, হ্যাঁ মানে হ্যাঁ। আসলে কানাই কোবরেজের একমাত্র মেয়ে চম্পা আর গোপাল ঠাকুরের ছেলে পঞ্চানন দু’জনে খুব বন্ধু। পঞ্চানন মানে আমাদের পাঁচু সহজ সরল সাদাসিধে বলে সকলে তার পেছনে লাগত। মজা করত। পাঁচুকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করত। চম্পা পাঁচুকে সব সময় আগলে রাখত। মজার কথা হল চম্পার বাড়ির নাম আবার পাঁচি। এ ভাবে একসঙ্গে বড় হতে হতে পাঁচি —পাঁচুর সঙ্গেই নিজের সারাজীবন কাটাবার কথা ভাবল।—চলবে
—বাবা কিসের এতো আলো রে?
—টর্চলাইট।
—বাবা, তোর টর্চলাইট তো তেলের কুপির থেকেও কম আলো ছিল। এমন হ্যাচাকের মতো আলো? ব্যাটারি নতুন বুঝি?
—নানা, আগের ব্যাটারি, একজন সারিয়ে দিল।
মাকে এই মিথ্যেটুকু না বললে অনর্থ হয়ে যেত। কিন্তু পাঁচু এটা বুঝেছে তেঁনাদের অসীম ক্ষমতা। আর তেঁনারা পাঁচুকে অপছন্দ করে না।
কিন্তু কানাই কোবরেজ যে পাঁচুকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। কানাই কোবরেজ হল কানাইলাল চক্কোত্তি। বেঁটেখাটো। ছোটছোট হাত। মাথাজোড়া টাক। তাতে বাঁ দিকে কানের পাশে সিঁথি কেটে গুটিকয়েক চুলকে আঁচড়ে চকচকে টাকের ওপর তাঁতির ঘরে রংকরা সুতো শুকোতে দেবার মতো ফেলে রেখে টাকমাথা ঢাকার বৃথা চেষ্টা। কিন্তু তার ভয়ানক মেজাজ। না মানে না, হ্যাঁ মানে হ্যাঁ। আসলে কানাই কোবরেজের একমাত্র মেয়ে চম্পা আর গোপাল ঠাকুরের ছেলে পঞ্চানন দু’জনে খুব বন্ধু। পঞ্চানন মানে আমাদের পাঁচু সহজ সরল সাদাসিধে বলে সকলে তার পেছনে লাগত। মজা করত। পাঁচুকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করত। চম্পা পাঁচুকে সব সময় আগলে রাখত। মজার কথা হল চম্পার বাড়ির নাম আবার পাঁচি। এ ভাবে একসঙ্গে বড় হতে হতে পাঁচি —পাঁচুর সঙ্গেই নিজের সারাজীবন কাটাবার কথা ভাবল।—চলবে
* কিম্ভূতকাণ্ড (Kimbhoot kanda – Horror Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।