শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


চিত্রভাস তার ফটোগ্রাফার বন্ধু অর্পণকে নিয়ে ইটন্ডা পৌঁছায় প্রায় সকাল এগারোটায়। গত কয়েকমাস আগে বোলপুর এসে শুনেছিল ইটন্ডা গ্রামে বিষ্ণুপুরের আদলে নির্মিত টেরাকোটা মন্দিরের কথা। কলকাতায় ওদের বাংলা ম্যাগাজিন ‘বাংলার ঐতিহ্য’ দু’ বছর হল বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। চিত্রভাস প্রথম থেকেই এই ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। ওরা ইটন্ডায় এসেছে টেরাকোটার মন্দিরগুলোর ইতিহাস ও ছবির প্রয়োজনে। চিত্রভাস ‘এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি’-তে এমএ করার পর ‘জার্নালিজম’ নিয়ে পড়েছে। লেখালেখির জন্য নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গে বন্ধু অর্পণকেও নেয় ছবি তোলার জন্য।

বোলপুর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ইটন্ডা গ্রামের কালীমন্দিরের কাছে বুড়ো বটতলার চায়ের দোকান, সেখান থেকে চা আর গরম সিঙ্গারা খেয়ে নেয় ওরা। গ্রামের কিছু ছেলে আড্ডা দেয় ওখানে বসে। রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষণ দ্বারা ভগ্নপ্রায় কালীমন্দিরটি কালের গ্রাস থেকে কোনওমতে রক্ষা পেয়েছে এটা বোঝা যায়৷ মন্দিরের আরাধ্যা দেবী হলেন কালী। নিত্যপুজো হয়। অর্পণ মন্দির গাত্রের স্থাপত্যের ছবি তুলতে ব্যস্ত৷ লোকমুখে ওরা শুনেছে এই কালীর প্রতিষ্ঠাতা প্রায় দুশো বছর আগের দুর্ধর্ষ ডাকাতরা৷ তারপর এখানে আসে নীলকর সাহেবরা।

বোলপুর থেকে ইটন্ডায় আসতে চিত্রভাস ও অর্পণ গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছিল, তাই সুবিধা হয়েছে। কালী মন্দির দেখে ওরা যায় পঞ্চরত্ন শিব মন্দির দেখতে। সেখানে আছে দুটো শিব মন্দির৷ অর্পণ ছবি তুলতে তুলতে বলে, ‘সত্যিই সুন্দর।’

চিত্রভাস বলে, ‘দুটি শিব মন্দির দুটি ভিন্ন শৈলীতে তৈরি। একটি পঞ্চরত্ন ও অন্যটি রেখ দেউল শৈলী।’

অর্পণ জানে চিত্রভাসের মন্দির স্থাপত্য বিষয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা আছে। ওরা পঞ্চরত্ন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ফলকটি দেখে, তাতে লেখা ১২৩৫ বঙ্গাব্দে রসানন্দ সাধুখাঁ মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর উত্তরসূরিরা এই গ্রামেই বাস করে।

শীতের শেষ, ঝলমলে প্রকৃতিতে বসন্তের আভাস৷ উদাসী শীতের ঝরা পাতার বুকে বসন্তের পদচিহ্ন পড়লেই শুরু হয় ফুলেদের উৎসব। সেজে ওঠে বনাঞ্চল। অর্পণ আপন মনে গ্রামের প্রকৃতির ছবি তুলছে এদিক-ওদিক। হঠাৎই পঞ্চরত্ন শিব মন্দিরের ভেতর চিত্রভাস এক তরুণীকে দেখতে পায়। গর্ভগৃহের ভেতরে ঢোকে সে৷ তরুণীর হাতে আকন্দের মালা। নিবিষ্ট মনে ভক্তি ভরে শিবলিঙ্গে পরিয়ে দেয়। তারপর হাতজোড় করে বসে। সামনে কাঁসার থালায় পুজোর কিছু ফুল রাখা। ধূপ ও পঞ্চপ্রদীপ জ্বলছে। তরুণীর গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, চোখ দুটি আয়ত পদ্মের মতো। শান্ত সমাহিতভাবে বসে আছে৷ গর্ভগৃহের ভেতর একটিই জানলা, সামান্য আলো ঢুকছে। চিত্রভাসকে তরুণী এক পলক দেখে আবার শিবলিঙ্গের দিকে তাকায়। মুহূর্তের মধ্যে চিত্রভাসের মনে হয় এই তরুণী মানবী নয়, দেবী৷ তরুণীর উপস্থিতির জন্য ঘরটি দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে!

চিত্রভাস তরুণীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, আপনার বাড়ি নিশ্চয়ই এই গ্রামে। আপনি কি রোজই এখানে পুজো দেন?

কিন্তু তরুণী যেন পাথর প্রতিমা। কিছুই বলে না। চিত্রভাস বলে চলে, ভারী সুন্দর গ্রাম আপনাদের, তেমনই সুন্দর মন্দির। এই মন্দির ও গ্রাম নিয়েই লিখব ফিরে গিয়ে।’

কিন্তু তরুণী তখনও নিথর৷ কোনও উত্তর নেই। এবার চিত্রভাস অপমানিত বোধ করে। একবার তরুণীকে দেখে। দু এক মিনিট পর রাগত গলায় বলে, ‘কোন ভদ্রতা শেখেননি মনে হয়! কেউ কথা বললে উত্তর দেন না।’

হঠাৎই একটি পুরুষ কণ্ঠস্বর কানে আসে, ‘ও কী করে উত্তর দেবে আপনার কথার?’

চিত্রভাস পেছন ফিরে এক ক্ষীণকায় বৃদ্ধকে দেখে। বয়স সত্তর বাহাত্তর হবে, পরনে একটি সামান্য ধুতি ও ফতুয়া।

‘কেন?’ চিত্রভাস অবাক হয়।

‘ওর রূপটাই আছে, জন্ম থেকে মূক ও বধির। ও আমার মেয়ে মৃন্ময়ী। আমি এই মন্দিরের পুরোহিত। বংশপরম্পরায় এই কাজ করে আসছে সকলে।’

খুব সহজ সরল ভাবে কথা বলেন বৃদ্ধ। চিত্রভাসের মনটা মুহূর্তে নরম হয়ে যায়। একটা কষ্ট দানা বাঁধে বুকে। না জেনে অনেক কিছু বলে ফেলেছে। মৃন্ময়ী তখনও একমনে বসে। চিত্রভাস মুগ্ধ হয়ে মৃন্ময়ীকে দেখে, শেষ হয় না দেখা!

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

* গল্প (Short Story) – মৃন্ময়ী (Mrinmoyee) : ড. জনা বন্দ্যোপাধ্যায় (Jana Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহিলা মহাবিদ্যালয়

Skip to content