সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

যদিও অন্যদিন হারেমের এই কক্ষ এখন আলো আর আলো, হাসি আর গান, আতর ও আবেশের মাখামাখিতে খিলখিল করে হাসে, কিন্তু আজ অন্যরকম। কক্ষমধ্যভাগ প্রায় আলোহীন। কেবলমাত্র সংলগ্ন একটি ছোট কক্ষে দুজন বাঁদী যাওয়ার আগে শেষবারের মতো পেটিকা গোছগাছ করছে। সেখানেই করুণভাবে একটি সেজ জ্বলছে। তারই আলো এসে পড়েছে ছত্তরবাঈয়ের আলিসান কিন্তু আপাতত শূন্য পালঙ্কে। যদিও ছত্তরবাঈ নিজে এখন অন্ধকার গবাক্ষে দাঁড়িয়ে। অন্যদিন এসময় শাহজাদা ঔরঙ্গজেবের গলার স্বরে গমগম করে উঠত এ কক্ষের দেওয়াল। জাফরি দেওয়া ছোট ছোট গবাক্ষের আড়াল থেকে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও উঁকি মারত হারেমের কোন কোন কৌতূহলী ও ঈর্ষাকাতর নারীরা। ছত্তরবাঈ দেখেও দেখত না। দেখুক আর জ্বলুক। শাহজাদার কলিজা যে তারই মুঠিতে। তা না হলে এই হারেমে তো আর কম সুন্দরী নেই। দু’ হাজার নারী রয়েছে এই হারেমে শাহজাদার একটি হুকুমে জান বকস করার জন্য। কিন্তু তারা আর ছত্তরবাঈ কি এক হল? সে হল শাহজাদা ঔরঙ্গজেবের হারেমের প্রধান খাদিম। একদিনও তাকে না দেখে থাকতে পারেন না শাহজাদা। তাকে নিয়ে শে’র বেঁধেছেন তিনি—
বাঁচনে কা বড়া উম্মিদ থি, ইসি লিয়ে তেরে পাস আয়ে,
দেখা যো পলট কে তু, জিতে জি হম মর গ্যায়ে!

যিনি কি না পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ না পড়ে জলগ্রহণ করেন না, যাঁর কড়া হুকুমে অন্দরমহলে সুরা ও সঙ্গীত—দুই-ই নিষিদ্ধ, সেই তিনিই কিনা ছত্তরবাঈয়ের প্রেমে একেবারে শায়ের বনে গেলেন? অথচ, ঘরে তাঁর দুই রূপসী বেগম আছেন—দিলরসবানু ও রহিমুন্নিসা। কই তাঁদের নিয়ে তো কখনও শাহজাদা শে’র লেখেননি? দেওয়ালে দেওয়ালে কিছু কথা ফিসফিস করে ঘোরে ফেরে—ছত্তরবাঈ ঘুম ভেঙে শয্যায় উঠে বসলে শাহজাদার জীবনে ভোর হয়, আবার ঘুমিয়ে পড়লে রাত্রি।

দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ছত্তরের বুক চিরে। সেই কোন কিশোরী বেলায় সে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল এই হারেমে। কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশের মেয়ে ছিল সে। বাবা, মা, সে ও ভাই—এই নিয়ে ছিল তাদের ছোট্ট সুখের সংসার। কি যে হল সেবার। একদল কাঞ্চনী তাদের গ্রামের ধারে এসে তাঁবু ফেলে ছিল ক’দিন। তারা এসেছিল কয়েক মাইল দূরে এক সম্ভ্রান্ত জায়গিরদারের ছেলের নিকাহতে গাওনার আমন্ত্রণ পেয়ে। এখন ফিরছে দিল্লি। তাদের সাজসজ্জা, রূপের চমক-ঠমকে অল্পবয়সী কিশোরীরা উদগ্র কৌতূহল চাপতে না পেরে তাদের তাঁবুর চারপাশে ঘোরাঘুরি করত সেই ক’দিন। তার মধ্যে ছত্তরও ছিল। এইরকম একদিন একজন বয়স্কা কাঞ্চনী তাকে ডেকে মোলায়েম হেসে তার হালচাল জিজ্ঞাসা করেছিল, আর খেতে দিয়েছিল খর্জুর। পাক করা খাবার হলে খেত না সে। কারণ, তা খাওয়ায় নিষেধ আছে। কিন্তু খর্জুর তো ফল, খেলে বাধা নেই। এই ভেবেই খেয়ে নিয়েছিল সে। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। ঘুম ভাঙল যখন, তখন সে কাঞ্চনী দলের হাতে বন্দি। এরপর নৃত্যগীত শিক্ষা, তারও পরে সেই মীনাবাজারে সওদা নিয়ে বসা। সেখানেই ঔরঙ্গজেব তাকে দেখেন এবং চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেন, সে তাঁর মনে কামনার আহুন জ্বেলে দিয়েছে। রুমাল দিয়ে তার সওদা খরিদ করলেন তিনি। স্পষ্ট ইঙ্গিত। মীনাবাজারে এটাই দস্তুর। এর অর্থ একটাই, আজ রাতে শাহজাদার মহলে ছত্তর স্বাগত। সেই যে প্রবেশ করেছিল সে, আজ এতদিন পর্যন্ত আর সে এখান থেকে বেরনোর কথা ভাবেনি। কেউ ভাবেও না। যারা একবার হারেমে এসে ঢোকে, তারা মনে মনে চায়, এখানেই যেন তাদের এন্তেকাল হয়। সে-ও তেমনটাই চেয়েছিল। মনে মনে নিশ্চন্ত ছিল, অন্তত তার স্থান কখন বদলাবে না। কত জন এল গেল, ছত্তরবাঈ থেকেই গেল শাহজাদার দিল-এ-জান হয়ে।
এখন মনে হচ্ছে, সে-সব আসলে কোন মধুর স্বপ্ন ছিল। তার মধ্যে এতটুকুও সত্য ছিল না। আগের জন্মের নাম ছত্তর আর মুখে আনে না, মনেও না। কিন্তু আজ মনে আসছে, কারণ আজ ভোর রাতেই শাহজাদা ঔরঙ্গজেবের প্রধান খাদিন ছত্তর রওনা দেবে ধারু। সেখানে মনসবদার খান-ই-জামান মীর খলিলের হারেমে গিয়ে উঠতে হবে তাঁকে। বিনিময়ে মীরসাহেব পাঠাবেন তাঁর হারেমের অন্যতম খাদিম হীরাবাঈকে। যে হীরাবাঈকে দেখে কিছুদিন আগেই শাহজাদা দিল হারিয়েছেন। এমনটা যে হবে, তা যদি ছত্তর জানত, তাহলে হয়ত সেদিনই বিষ দিয়ে মেরে ফেলত সেই রাক্ষুসীকে। কিন্তু হায়, বহতা নদীর জল একবার চোখের সামনে থেকে, হাতের নাগাল থেকে সরে গেলে, আর কি সে ফিরে আসে?

“বাঈ, আপনার জহরৎ পেটিকা আপনি নিজে গুছিয়ে নিয়েছেন তো এইবেলা একবার দেখে নিন, যদি কিছু বাকি পড়ে থাকে! ভোররাত্রে রওনা হতে হবে। তখন জলদিতে আর সময় পাওয়া যাবে না!”

বাঁদীর কথা শুনে ফিরে তাকাল ছত্তর। খামিরা। হারেম-পূর্ব জীবনে এ ছিল কোন এক ছোট রাজ্যের রাজার মেয়ে। দাক্ষিণাত্য অভিযানে গয়ে এর পিতাকে হত্যা করে ঔরঙ্গজেব একে তুলে এনে মাত্র এক রাতের পরস্‌তার হিসাবে ভোগ করে তারপর ছত্তরের পায়ের কাছে এনে ফেলে বলেছিলেন, “জান, তুমি অনেকদিন থেকে বলছিলে না তোমার একজন খাস বাঁদী লাগবে ? এই নাও আজ হতে এই হল তোমার খাস বাঁদী। এর বাঁচা-মরা সবই তোমার হাতে।” বলেই সেই ভীত দলিত মথিত ছোট মেয়েটিকে বলেছিলেন, “আজ থেকে তোর মালকান হল এই বাঈ। সালাম কর।”

মেয়েটির ভীরু-চকিত নয়ন দেখে মায়া পড়ে গিয়েছিল ছত্তরের, “ভারী মিষ্টি মেয়ে তো তুই। আজ থেকে তোর নাম দিলাম খামিরা। পছন্দ?”

মেয়েটি বুদ্ধিমান। সে বুঝেছিল, স্বয়ং শাহজাদা যাকে খাতির করে চলেন, সেই মালকানের দেওয়া নাম অপছন্দ হলে তারই বিপদ। অতএব সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। সেই থেকে ছায়াসঙ্গী হয়ে আছে সে ছত্তরবাঈয়ের সঙ্গে। শাসজাদা আর কোনওদিন তার দিকে ফিরে তাকাননি। যেমন করে হারেমের নারীরা বহুমূল্য লাচক একবারের বেশি দু’বার ব্যবহার করেন না, তেমনি মালিকের দ্বারা একবার মাত্র ভোগ্যা মেয়েদের হারেমে স্থান হয় ছত্তরের মতো পরস্‌তারদের বাঁদী হিসাবে। তাও তো সে ছত্তরের প্রিয় পাত্রী হিসাবে অল্পদিনের মধ্যেই খাস বাঁদী হয়ে উঠেছিল, আর সকল বাঁদীদের কর্ত্রী—কেতখুদা। তার পরেই রয়েছে—হাসনাদার, বাকিরা কালফা। ছত্তরের মহলে বাঁদীর সংখ্যা কাল অবধিও ছিল পনেরো। তাদের মধ্যে দশ জনকেই ছত্তর বিদায় দিয়েছে। তাদের হাতে অনেক অনেক মুদ্রাভর্তি থলি দিয়ে স্বাধীন হিসাবে হারেমের বাইরের দুনিয়ায় গিয়ে বাঁচার অনুমতি দিয়েছে ছত্তর। বাকি পাঁচজন, তার মধ্যে খামিরাও আছে, তারাও ছত্তরের সঙ্গে কাল ভোররাত্রে রওনা দেবে মীর খলিলের হারেমের উদ্দেশে। ভাগ্য তাদের সেইদিকেই নিয়ে যেতে চায় যে!

ছত্তরের কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে খামিরা আবার জিজ্ঞাসা করল, “বাঈ, আপনার জহরত যথাস্থানে গুছিয়ে রেখেছেন তো ?”

খামিরার কথার জবাব না দিয়ে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল ছত্তর, “তোর গহনাগুলি তুই নিয়েছিস তো খামিরা ?”
“হ্যাঁ, বাঈ।”

“হ্যাঁ, নিস মনে করে। সেখানে গিয়ে সেজে দাঁড়াবি খান-এ-জামানের সামনে। হয়তো আমার চেয়ে তোকে দেখেই তাঁর দিল মজে যাবে। তখন একেবারে প্রধানা খাদিম হয়ে উঠতে দেরি হবে না তোর !” হাসার ভান করলেন ছত্তর।
খামিরা সজোরে তার বেণী দুলিয়ে বলল, “না বাঈ, আমি আপনার পায়ের নীচে অনুগত বাঁদী হিসেবেই থাকতে চাই। খান-এ-জামানের কোলে নয়।”

ছত্তর তার চিবুকে হাত ছুঁইয়ে তুলে ধরে বললেন, “ওরে হারেমের জেনানাদের নিজেদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলে কিছু আছে না কি? আজ যে শরতাজ, কাল সেই পায়ের জুতা। আমাকে দেখে বুঝিস নে? নাদান নেহ্‌কুফ মেয়ে কোথাকার? যা তুই, আমি যথাসময়ে আমার জহরৎ আর-একবার পরে শাহজাদার মহলে যাব।”
“গুস্তাকি মাফ বাঈ। কিন্তু শুনেছি তিনি কারুর সঙ্গেই আর দেখা করবেন না বলে পাঠিয়েছেন। তাহলে?”
“এতদিন আমার সঙ্গে থাকলি খামির, তবু সেই বেহকুফ রয়ে গেলি। অন্যরা আর আমি কি এক? যে বাঈ-ই আসুক, ছত্তরকে বাধা দেওয়ার সাহস তোদের শাহজাদার হবে না কোনওদিন। যা, সে উনি দেখা করবেন কি করবেন না, সে আমি বুঝে নেবো। তোকে তকলিফ ওঠাতে হবে না। বিশ্রাম নে। ভোর রাত্রে উঠতে হবে!”
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-৫: ধান চোর ইঁদুর

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/৫

 

নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে ঔরঙ্গজেব বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছিলেন। অন্যদিন এই সময়ে হয় ছত্তরবাঈয়ের কক্ষে, নয়তো অন্য কোন সুন্দরীর শয়নকক্ষে তাদের পেলব বাহুলতার বাঁধনে তাঁর রজনী বাঁধা পড়ত। কিন্তু আজ আর কিছুই ভালো লাগছিল না। একবার ভেবেছিলেন, যাই, আজ অনেকদিন পরে বেগম-মহলে যাই। বিশেষ করে দিলরসবানু আসন্নপ্রসবা, তাঁর কাছে যাওয়া হয় নি অনেকদিন। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত মন চাইল না বলে পা-ও সরল না। বারবার তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে সেই মেয়েটির কথা। সেই আহুখানার বাগানে দেখা দুনিয়ার গজব্‌ সুন্দরী হীরাবাঈ! তার গানের গলা যেন বেহস্তের বুলবু‌লকেও হার মানায়, আর তার রূপ—সে যে আল্লাহ কী দিয়ে গড়েছিলেন, তা তিনিই জানেন! মনে হয়েছিল, এই বুঝি সেই হুরী-পরী, যারা বাস করে কোকাফ মুল্লুকে। এতদিন যেমনটি ছিলেন ঔরঙ্গজেব, আর কী তেমন থাকতে পারবেন?

আগ্রার প্রাসাদে বেশ দিন কাটছিল তাঁর। যতই পিতা অশক্ত হয়ে পড়ছেন, ততই তলে তলে তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন এক গোপন যুদ্ধের। সে যুদ্ধের কথা জানেন কেবল দু’জন—শাহজাহানের বিশ্বস্ত দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান এবং তাঁর পার্ষদ আকিল খাঁ শায়ের। না, আরও একজন জানে, তাঁর প্রধান খাদেম ছত্তরবাঈ। সে খুব উল্লসিত বোধ করে এই গোপন যুদ্ধের কথা শুনে। তার স্বপ্ন, একদিন শাহ্‌জাদা তামাম হিন্দুস্থানের বাদশাহ হলে, সে হবে হারেমের অবিসংবাদিত মালেকা। তার কথায় ঔরঙ্গজেবের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। তাঁর জীবনের তিনটি কাঁটা—দারা সুকোহ, শাহ সুজা এবং মুরাদ বক্স—এঁদের দোজখে না পাঠানো পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। চিরকালই তাঁর আত্মনিয়ন্ত্রণ বেশি। এই নিয়ে নিজের মুখে অহংকারও করেন প্রায়শ। কিন্তু, সব অহংকার, সব গর্ব ধূলায় মিশিয়ে দিল ওই মেয়েটি—হীরাবাঈ।

শাহজাহান তাঁকে আগ্রায় বেশিদিন বসিয়ে রাখতে কেন চান না, তা ভালো করেই বোঝেন ঔরঙ্গজেব। তাঁকে সুদূর দাক্ষিণাত্যে পাঠিয়ে দারার ভাগ্যকে সুরক্ষিত এবং সুনিশ্চিত করতে চান। এর বদলা যথাসময়েই নেবেন তিনি। আপাতত, পিতার আদেশমতো এবারেও ফিরছিলেন ঔরঙ্গাবাদ। পথে বুরহানপুরে থেমেছিলেন কিছুকালের জন্য। তাপ্তী নদীর তীরে মনোরম এক মহল। সেখানেই দুই বেগম, অসংখ্য বাঁদী, বান্দা, খোজা, লোক-লস্কর, সেই সঙ্গেই আকিল খাঁ ও অবশ্যই প্রধান খাদিম ছত্তর। তাপ্তির দুই পারেই মোগল শাসন বহুকাল হল কায়েম রয়েছে। বুরহানপুরের মহলের প্রায় মুখোমুখি তাপ্তীর অপর পারে জাহানাবাদ। সেখানেই রয়েছে ফুলের বিস্তৃত বাগিচা, আমবাগান, পালিত হরিণ ও ময়ূরের ঝাঁকের মাঝে আশ্চর্য সুন্দর আহুখানা। হারেমের মেয়েরা অনেকদিন ধরেই আবদার করছিল, শাহজাদা তাদের এই বুরহানপুরেই আটকে রাখলেন। কত আর তাপ্তীর তীরে বেড়িয়ে আর জলকেলি করে আনন্দ পাওয়া যায়। এবারে উদ্যানবিহারে নিয়ে যেতেই হবে। তিনি হেসে উড়িয়েই দিয়েছিলেন, এখান থেকে অনেক আগেই তাঁর বেরিয়ে পড়ার কথা। প্রায় আট মাস এর মধ্যেই কেটে গিয়েছে। নেহাত দিলরসবানু অসুস্থ। এই অবস্থায় বেশি চলাফেরা করাও বারণ। যে কোনও সময়ে প্রসববেদনা উঠতে পারে। যদিও সঙ্গে আয়া আছে, তবুও হঠকারিতায় সায় নেই তাঁর। মেয়েদের কথা উড়িয়ে দিয়েই ভেবেছিলেন পার পেয়ে যাবেন, কিন্তু যেদিন ছত্তরবাঈ এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নিজের উন্মুক্ত স্তনের উপর থেকে শাহজাদার ক্ষুধার্ত ওষ্ঠ সরিয়ে দিয়ে বলল, “আর এই কক্ষের মধ্যে কাটাতে ভালো লাগছে না শাহজাদা। এই মহলে তেমন কোন বাগিচা নেই। শুনেছি, জাহানাবাদে মহামহিম বাদশাহ শাহজাহান এক আশ্চর্য সুন্দর বাগিচাঘর বানিয়েছেন? সেখানে কি যেতে পারি না? তিতলির জীবন যদি গুটির মধ্যেই কেটে যায়, তবে আর তার আশ্চর্য রূপ রেখে লাভ কি?”

শুনে ঔরঙ্গজেব হেসেছিলেন। বলেছিলেন, “যো হুকুম জান!”
সেই কথা শুনে আর একজনও অন্তরালে হেসেছিলেন। তিনি হলেন ভাগ্য। ছত্তর জানে না, তা বায়নাক্কাই তার জীবনে দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। যদি জানত, তাহলে কি সে…?

দিলরস ছাড়া বাকিরা সকলেই চলল উদ্যানবিহারে। অন্য বেগম রহিমুন্নিসার মুখে হাসি ধরে না। দিলরসের কব্জা থেকে ক’দিন শাহজাদার উপর তিনিই ছড়ি ঘোরাবেন। যদিও ছত্তরের মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় ছিল না, তবে সেও যে মনে মনে হেসেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। হারেমের বাকি নারীরাও উল্লসিত। কাছেই ধারুতে থাকেন ঔরঙ্গজেবের আম্মিজান মুমতাজ বেগমের বোন মালিকাবানু। সেখানকার মনসবদার খান-ই-জামান মীর খলিলের বেগম তিনি। তাঁকেও দাওয়াত দেওয়া হল। তিনিও এলেন হারেমের নির্বাচিত সুন্দরীদের নিয়ে। ঔরঙ্গজেব সংযত পুরুষ—এ’কথাই মাথায় ছিল তাঁর। ফলে একজনের হারেমের নারীরা অন্য পুরুষের সম্মুখে না বেরুলেও, এবারে তার ব্যতিক্রম হল। আর তাতেই হল বিপত্তি।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]

ইংলিশ টিংলিশ: চলুন আজ পুজো নিয়ে মজার ছলে কিছু শব্দ শিখে নিই

বাগিচায় ছত্তর প্রমুখের হাসি-মজা-হুল্লোড়ে ক্লান্ত হয়ে কোরানখানা সঙ্গে নিয়ে একটু নির্জনে পড়বেন এই আশায় ঔরঙ্গজেব গিয়েছিলেন আমবাগানে। জ্যৈষ্ঠ মাস শেষ হতে চলল। বাগানখানা সুপরিপক্ব আমের আঘ্রানে আমোদিত হয়ে আছে। বাগানের ছায়ায় বসে সবে কোরানখানা পড়বেন বলে বিছিয়ে বসেছেন, আকিল খাঁ-ও নেই যে, তাঁকে বলবেন পাঠ করে শোনাতে; এমন সময় কানে এল, রমণীকন্ঠে মিছরির চেয়েও মিষ্টি গানের সুর। কে গাইছে? ক্রুদ্ধ হলেন ঔরঙ্গজীব। তিনি গান পছন্দ করেন না। গান গাওয়া, শোনা শাস্ত্রমতে হারাম। তাঁর কড়া হুকুম আছে, তাঁর মহলে যেন কেউ গান না গায়। ছত্তরের গানের গলা মিষ্টি হলেও সে-ও অক্ষরে অক্ষরে এই হুকুম মেনে চলে। তবে? কোন বেহকুফ গান গাইছে? কোরানখানা আসনের উপর রেখে তিনি নিঃশব্দে গিয়ে দেখলেন, একজন বেহস্ত থেকে নেমে আসা হুরী আপনমনে গান গাইছে। তাঁর সামনেই ফলভারে সন্নত রসালবৃক্ষের শাখা, বিস্ময়ে, উত্তেজনায়, মুগ্ধতায় তিনি মুখ দিয়ে শব্দ করে ফেলেছিলেন। তাতেই সেই হুরী তাঁর দিকে ফিরে তাঁকে দেখেই চোখের তারায় বিদ্যুৎ বর্ষণ করল। অধরে সুনিপুণ হাসি। ঔরঙ্গজেবের পোশাক দেখলেই বোঝা যায়, তিনি কে? কিন্তু সেই হুরীটি যেন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল তাঁকে। এগিয়ে এসে শাহজাদার হাতে ধরা রসালের শাখায় ঝোলা একখানি পক্ব ফল ছিঁড়ে হালকা আদরে দাঁত বসাল তার গায়ে। আমের রসে তার অধর সিক্ত হল। পরিধেয় মেখলাতে, কাঁচুলিতে গড়িয়ে নামল উজ্জ্বল হরিদ্রাভ রসের ধারা। ঔরঙ্গজেবের মন চাইছিল, ছুটে গিয়ে সেই রস লেহন করেন, অধরের গা থেকে শুষে নেন সমস্ত সুধা। কিন্তু, তিনি বেকুবের মতো বসে রইলেন মূর্ছিতপ্রায় হয়ে। মেয়েটি চলে গেল হাসতে হাসতে। হাসি তো নয়, যেন মিছরির ছুরি। একেবারে হৃদয় কেটে বসে যায় গভীরে।

পরিচয় জানা গেল অচিরেই। অনেকক্ষণ শাহজাদা ফিরছেন না দেখে ছত্তর নিজেই গিয়েছলেন তাঁর খোঁজে। তারপর বাকি কথাও জানতে দেরি হল না। বর্ণনা শুনে মালিকাবানু বললেন, “আরে, এ হল তোমার খালা আব্বুর হারেমের মেয়ে—হীরাবাঈ। তোমার নিষেধ জানে না বলে গুস্তাকি করে ফেলেছে। মাফ চাইছি আমি।”

ঔরঙ্গজেব মনে মনে বললেন, “ভাগ্যিস, গুস্তাকি করে ফেলেছে। তা না হলে তো জানাই যেত না, মানুষের মধ্যেও হুরী-পরীরা জন্ম নেয়!” মুখে বললেন, “গুস্তাকি যখন করেছে, শাস্তি তখন পেতেই হবে তাকে। আমি তাকে আমার হারেমে চিরদিনের জন্য বন্দি করে রাখব।”

সর্বনাশ। একেই খান-এ-জামান রগচটা লোক; এমনিতেই হারেমের নারীদের মালিকাবানু নিয়ে এসেছেন বলে ভিতরে ভিতরে অসন্তুষ্ট, তার উপর যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে মালিকাবানুর গর্দান নিতে বিলকুল কসুর করবে না।

“তুমি পারবে খালাজান, উনি যাতে হীরাবাঈকে আমার জিম্মায় দিয়ে দেন, তার ব্যবস্থা করতে?”

“হায় আল্লাহ”, মালিকাবানু কপাল চাপড়ান, “এমন অনৈতিক কথা কেমন করেই বা বলি আমি?”

“তবে থাক। আমি দাক্ষিণাত্যে পৌঁছে মুর্শিদকুলি খাঁকে পাঠাব। সে-ই পারবে। যদি সোজা কথায় না হয়, তাহলে তুমি কাফনের ব্যবস্থা করে রেখো খালা, আমায় দোষ দিও না !”

“ইয়া আল্লাহ। আমি না হয় মরব, কিন্তু এমন কথা শুনলে সেই মানুষটি যে আগেই হীরাকে কতল করবেন!”

“তাতে নিজের নির্মম মউতকে নিজের হাতেই ডেকে আনবেন খালা-আব্বু! মোদ্দা কথা, হীরাকে আমার চাই-ই!”

তারপর অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। র্শিদকুলি খাঁ-র দৌত্য কাজে আসেনি। অনেক টানাপোড়েনের শেষে মালিকাবানুকে দিয়ে খানজামান এত্তেলা দিয়েছেন, যদি ঔরঙ্গজেব তাঁর হারেমের প্রধান খাদিম ছত্তরবাঈকে তাঁর হারেমে পাঠাতে রাজি থাকেন, তাহলে তিনিও হীরাবাঈকে পাঠিয়ে দেবেন সত্ত্বর। শাহজাদার পক্ষে নিজের হারেমের প্রধান খাদিমকে একজন মনসবদারের হারেমে পাঠানোর অর্থ অপমানিত হওয়া। খানজামান ভেবেছিলেন, এই প্রস্তাব স্বভাবতই নাকচ করে দেবেন ঔরঙ্গজেব। দারার কানে এই খবর পৌঁছাতে দেরি হয় নি। বিষাক্ত ব্যঙ্গের হাসি হেসে দারা তাঁর সভায় মন্তব্য করেছেন, “কমওয়ক্ত বেহকুফ, নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করে, অথচ খালা-আব্বুর হারেমেও হানা দিতে কসুর করে না!” এই কথা শুনে অন্য সময় হলে তেলে-বেগুন জ্বলে উঠতেন ঔরঙ্গজেব। কিন্তু এবারে যে গায়েও মাখলেন না। দারাকে এর প্রতিফল পরে ভুগতে হবে। আপাত্ত হীরাবাঈকে তো লাভ করি! মনে মনে বললেন যেন ঔরঙ্গজেব। প্রস্তাব নাকচ করা তো দূর, কার্যক্ষেত্রে ফল হল অন্যরকম। তিনি এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। ছত্তরবাঈ যাবে খানজামানের হারেমে, বিনিময়ে হীরাবাঈ আসবে তাঁর হারেমে। তাঁর আপত্তি নেই। ছত্তরের কাছেও এত্তেলা গেল। প্রস্তুত হও। তোমার এখানকার পাট উঠল। এবার অন্যের হারেম আলো করে থাকো। কালই সেই দিন। কাল সূর্যোদয়ের আগেই ছত্তর তার নির্বাচিত বাঁদি ও লোকলস্কর নিয়ে খানজামানের হারেমের উদ্দেশে রওনা হবে। আর তার বিনিময়ে…! প্রতীক্ষার রজনী যে কেন এত দীর্ঘ লাগে?
আরও পড়ুন:

বাইরে দূরেঃ অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি

দিদিমার হাতের লোভনীয় গোকুল পিঠে খুব মনে পড়ে? এ বার নিজেই বানিয়ে ফেলুন, রইল রেসিপি

 

ছত্তর জানে প্রতীক্ষার কাল অবস্থাভেদে হ্রস্ব-দীর্ঘ হয়। এই যেমন এখন হয়তো শাহজাদা তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষে বিনিদ্র রাত যাপন করছেন আর ভাবছেন, কবে হীরা তাঁর দু’বাহুর সীমানায় এসে ধরা দেবে। তাঁর কাছে এই কাল অবশ্যই দীর্ঘ এবং দুঃসহ। আর ছত্তরের নিজের কাছে? সে মনে মনে কাতর প্রার্থনা জানাচ্ছে, ‘যেয়ো না রজনী আজি লয়ে তারাদলে…’; কিন্তু সে জানে, তার জীবনে আজকের রাতের মতো এতো হ্রস্ব রাত আর কোনওদিনও আসবে না।

খামিরা, গস্তানিবাঈ, তকব্বরি—সকলেই নিজেদের নির্দিষ্ট কক্ষে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। এরপর এক সপ্তাহ কেবল পথেই যাবে। কোথায় কখন থামবে তারা, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। পথের কষ্টে নিদ্রার দফারফা হবেই হবে। আর ছত্তরের নিজের কাছে? হয়তো আজ থেকেই তার জীবন নিদ্রাহীন হয়ে পড়ল। ঔরঙ্গজেবের আদেশে তাঁর হারেমে সুরাপান নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেকেই খোজাদের দিয়ে সুরা আনিয়ে খান। শাহজাদাকে লুকিয়েই খান। ছত্তর নিজে কখনও সুরাপান করেননি, তবে যারা খায়, তারা বলেছে, তাতে না কি দুঃখ ভোলা যায়। হারেমে সকলেই কি আর সুখী? আগের জীবনের খোলস যে ছাড়তে পারে পুরোপুরি, সেই কেবল সুখী হতে পারে। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল ছত্তর। খানজামান খুব সুরাসক্ত বলে শুনেছে সে। তার কাছে গিয়ে তাকেও হয়তো ওই সুরা নামক বিষ পান করেই বাকি জীবনের দুঃখ ভুলতে হবে। মরতে পারলে ভালো হত। কিন্তু মরতে পারবে না সে। জীবনের তৃষ্ণা যে এখনও অগাধ, অসম্পূর্ণ!

একবার শেষবারের মতো নিজের কক্ষের সমস্ত আলো জ্বালাল ছত্তর নিজের হাতে। এই সেই শয্যা, যেখানে কত উদ্দাম রাত, রঙিন দুপুর কেটেছে। এই সেই ভিনিসিয় আয়না, যাতে নিরাবরণ নিজেকে মসলিনের নিবিবন্ধনী দিয়ে শৃঙ্গারের পরে মুগ্ধ চোখে দেখেছে সে। সহসা হয়তো সেই মুহূর্তে শাহজাদা এসে জড়িয়ে ধরেছেন তাকে। শিথিল নিবিবন্ধনী খসে পড়েছে তৎক্ষণাৎ। অধর রঞ্জিত করার জন্য মণিমাণিক্যখচিত তাম্বুলের পাত্র, যার থেকে আলগোছে কখনও তাম্বুল নিয়ে তার মুখে তুলে দিতেন শাহজাদা ! এই সেই দেওয়াল, যেখানে তাকে ঠেসে ধরে একদিন…। সেই আদরের দাগ এখনও দেওয়ালে লেগে আছে। কাউকে বলেনি ছত্তর, মাঝেমাঝে যখন শাহ্‌জাদা কর্মসূত্রে প্রবাসী হতে বাধ্য হতেন, তখন প্রোষিতভর্তৃকার মতো ছত্তর সেই দাগের উপর শরীর এলিয়ে উপলব্ধি করতেন সোহাগের আঁচ। আজকের পরে এ-সবই স্মৃতি হয়ে যাবে। হীরা এসে হয়তো নতুন করে সাজাতে চাইবে এই মহল। কিংবা তার জন্য হয়তো আলাদা কোনও মহল গড়ে দেবেন শাহজাদা। ছত্তরের মহলে ঠাঁই হবে যত বাঁদী, খোজা প্রমুখের। অলস দুপুরে পায়রারা নির্জন ঘরে ঢুকে আপনমনে বলে চলবে, অতীতের সেই সব প্রেমের গল্প।

আয়নার সামনে বসে জহরত-পেটিকা খুলে একে একে নিজেকে সাজাল সে। আয়না কি আজও ঈর্ষায় ভেঙে চুরমার হয়ে পড়তে চাইছে? উঠে দাঁড়াল ছত্তর। অলবিদা না জানিয়ে চলে যেতে পারবে না সে। শাহজাদা সে গুস্তাকি কি মাফ করতে পারবেন? একদিন হয়তো পারতেন, তখন ছত্তর ছিল তাঁর চোখের মণি, আজ পারবেন না। নিশ্চিত জানে সে।

আরও পড়ুন:

আমার দুর্গা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৬: শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া অর্থ বন্যাপীড়িত মানুষের কল্যাণে

 

ঔরঙ্গজেব একটূ কেঁপে উঠলেন।

ছত্তর এসে দাঁড়িয়েছে তার কক্ষের প্রবেশপথে। কুর্নিশ করে সে বলল, “গুস্তাকি মাফ চাইছে এ বাঁদী। শেষবারের মতো আপনার কাছে অলবিদা জানাতে এলাম শাহজাদা। আমি কি একবার ভিতরে আসতে পারি?”

“কী প্রয়োজন আর ছত্তর। তুমি এখন খানজামানের সম্পত্তি, তাঁকেই তোষামোদ করার কথা ভাব!”

“শাহজাদা, লোকে বলে আপনি এত ধার্মিক। কিন্তু এই কি আপনার ধর্মবোধ? যতক্ষণ না খানজামান আমাকে পাচ্ছেন, ততক্ষণ আমি আপনারই। আর সম্পত্তি বলছেন? এটাই তো আমাদের দুর্ভাগ্য যে, পুরুষেরা চিরকাল আমাদের সম্পত্তি ভেবে গেল। আমরা যে মানুষ, সে-কথা একবারও ভেবে দেখল না! আমাদেরও যে হৃদয় বলে একটি সত্তা আছে, আর তাতে যে দাগ একবার সোনার আখরে লেখা হয়ে যায়, শত কলঙ্কেও সে-দাগ যে মলিন হয় না, এই সত্যটিকেই পুরুষেরা স্বীকার করল না! কিন্তু সত্যি জানবেন, আছে, আমাদেরও হৃদয় আছে, ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে। কিন্তু আপনারা তা স্বীকার করেন না, এটাই দুঃখের!”

ঔরঙ্গজেব বিরক্ত হলেন, “ছত্তর, তুমি যাও। আমি এখন অন্যের ছবি হৃদয়ে নিয়ে প্রতীক্ষায় বসে। আমাকে বিরক্ত করো না। তুমি এখন অসংযত চিত্ত, বিকারগ্রস্ত। তোমার অধিকার হৃত হওয়ায় তুমি কী বলছ, কাকে বলছ, তা তুমি নিজেও জানো না !”

হাসল ছত্তর। যদিও সে হাসি রোদ-ঝলমল সকালের নয়, বর্ষণক্লান্ত মেদুর দুপুরের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, তুমি আর কেঁদো নাকো এই ভিজে মেঘের দুপুরে! বলল সে, “যদি কোন কসুর হয়ে থাকে এই পরস্‌তার মাফি চাইছে শাহজাদা। যেদিন এই হারেমে প্রবেশ করেছিলাম আপনার রুমাল পেয়ে, সেদিন কাঞ্চনীরা আমায় বলেছিল, যদি এই রাতকে অনেক রাত করে তুলতে পারিস, তবে জানবি, যেমন ঈশ্বরের চরণে, আল্লাহতালার কাছে কেউ কেউ নিজেকে পর্‌সতার হিসাবে উৎসর্গ করে, তুইও তেমনি পর্‌সতার হয়ে যাবি, শাহজাদার পরস্‌তার। ইহলোকে এর চেয়ে বড় দান আর কিছু নেই। সেই থেকে আমি মনে মনে আপনার পর্‌সতার হয়ে গেলাম। কিন্তু আপনিই বলুন শাহ্‌জাদা, একবার যে নিজেকে এক ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করেছে, তাকে কি আর-একবার আর এক ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয় ? যায় উৎসর্গ করা?”

ঔরঙ্গজেব স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। ছত্তরের ভিতরে কান্নার যে জলপ্রপাতটা গর্জন করে আছড়ে পড়ছিল অভিমানের ভূমিতে, তার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি। কোনওক্রমে বললেন, “আমি জানি, তোমার কষ্ট হচ্ছে ছত্তর! কিন্তু আমি অপারগ!”

ছত্তরবাঈ বলল, “আমি যে আপনার কাছে উৎসর্গীকৃত একজন পরস্‌তার মাত্র। এবার আমাকে রাখুন বা ফেলুন, তা একান্তভাবেই আপনার ইচ্ছা। আপনি আমাকে অন্যের হারেমে পাঠিয়ে আমাকে যত না দুঃখ দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেলাম, আমাকে অনেকদিন পরে “জান” বলে সম্বোধন না করে, ছত্তর বলে ডাকলেন বলে। মানুষ যখন তার ভালোবাসার ডাক হারায়, তখন বুঝতে হবে সে সত্যিই পরিত্যক্ত হয়েছে। আমিও বুঝলাম।”

ঔরঙ্গজেব বললেন, “ছত্তর, এ-কথা সত্য যে আমি এখন হীরা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছি না। তবে, তুমি যদি চাও, আমি মুর্শিদ খাঁকে বলে, খানজামানের শর কেটে তোমাকে আমার হারেমে চিরকালের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। বল, তুমি কী চাও?”

ছত্তর বলল, “আমার জন্য মালিকাবানু বেগম বিধবা হোন সে আমি চাই না শাহজাদা। তাছাড়া আপনি খানজামানকে হত্যা করে আমাকে হয়তো আপনার ওই নিষ্প্রাণ হারেমের চার দেওয়ালে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু আমার কাছে যা শ্রেষ্ঠ হারেম — আপনার ওই কলিজা। তাঁর ভিতর তো আর ঠাঁই পাব না? এই ছত্তরবাঈ উপেক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, দয়া নিয়ে নয়। আপনার দয়া আপনার কাছেই থাক। সেটুকুও নিয়ে আপনাকে একেবারে ভিখিরি করে দিতে চাই না!”
“তুমি কি আমার কাছে অর্থ, অলংকার ইত্যাদি চাও? আমি তবে দিওয়ান-ই-আলাকে বলে দিচ্ছি, তিনি তোমাকে রত্নসিন্দুক খুলে দেবেন!”

ছত্তর মাথা নাড়লেন, “না শাহজাদা। মীনাবাজার থেকে যেদিন আপনার হারেমে প্রবেশ করেছিলাম, সেদিন কাঞ্চনীদের কিছু রূপোর গহনা ছাড়া আর ছিল একখানা তাগা। আমার পূর্বজন্মের স্মৃতি। আমার মা আমায় পরিয়ে দিয়েছিলেন এই বিশ্বাসে যে, ওটা পরলে যে-কোন বিপদ থেকে আমি মুক্তি পাব। কিন্তু পাই নি। তাগার যে কোন দৈবী ক্ষমতা নেই, আমার চেয়ে তা আর কেই বা ভালো জানে। তবুও আমি তা রেখে দিয়েছি, কারণ, ওটা আমার কাছে কেবল তাগা নয়। আমার মায়ের ভালোবাসা, স্মৃতির চিহ্ন। আজ এই বিদায়ের দিনে কেবল ওইটুকুই আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই, যা একান্তভাবেই আমার নিজের। কারও দয়া বা ভিক্ষার দান নয়! বাকি যা, তা ফিরিয়ে দিয়ে যাব শহজাদা।” বলে ছত্তর নিজের গায়ের অলংকারগুলি একে একে খুলে ফেলতে লাগলেন।

ঔরঙ্গজেব অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “ও সব থাক ছত্তর। ওগুলি যখন তোমায় আমি দিয়েছি, ও তোমার হয়ে গিয়েছে। ও আর ফিরিয়ে দেবে কেন?”

“না শাহজাদা। আপনি যেগুলি দিয়েছিলেন, তাতে ভালোবাসার মিনে করা ছিল, তার গায়ে জড়িয়ে ছিল সোহাগের পালিশ। হঠাৎ করে আজ দেখি, বাইরে এক দেখালেও আসল অলংকারগুলি কে চুরি করে নিয়েছে! ভালোবাসার সে কারুকাজ, আদর-সোহাগের সে পালিশ, কিছুই আর আসল নেই। যদি কখন সেই আসলগুলি খুঁজে পান, আমায় দেবেন, আমি দু’হাত পেতে গ্রহণ করব। আজ এসব ঝুটা গহনা নিয়ে গেলে আপনারই মান যাবে। আস্তাগফেরুল্লাহ। আমার গুণাহ আপনিও মাফ করবেন শাহজাদা। যার কাছে আমাকে দিয়ে আপনি নতুন পর্‌সতার আনছেন, সেই খানজামানও হয়তো প্রস্তুত আছেন, আপনারই মতো ঝুটা ভালোবাসার গহনা দিয়ে আমাকে সাজিয়ে তোলবার জন্য। আমিও সেই গহনায় নিজেকে সাজিয়ে আবার তাঁর হারেমে ঝুটা আলো ছড়াবো। যদিও, নতুন গহনা দিয়ে বাইরের শরীরকে কিছুটা নতুন ভাবে জাহির করা যায়, কিন্তু তা দিয়ে কি মনের শরীরে নতুন সাজ পরানো চলে? এই রইল আপনার দেওয়া ঝুটা গহনা আর জহরত-এর পেটিকা। কাল থেকে এই ছত্তরবাঈ আবার নতুন করে শরীরের দিক দিয়ে নতুন এক দেবতার পর্‌সতার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করবে, কিন্তু তার হৃদয়-সিংহাসনে একজনই প্রভু। একজনই মালিক। সে একজনেরই পর্‌সতার। ছিল, আছে, থাকবে। সালাম শাহজাদা। খুদা হাফেজ!”আস্তে আস্তে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় ছত্তর।

আর শূন্যপ্রায় কক্ষে রিক্ত হস্তে ঝুটা গহনাগুলির সম্মুখে মাথা নত করে বসে থাকেন এক পরাজিত প্রেমিক, ঔরঙ্গজেব।

* গল্প (Short Story) – পর্‌সতার (parsotar) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ

Skip to content