বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

“ও শিবানী, তোর ছেলে যে রোদে পুড়ে গেল। গোড়ায় আর কতবার জল দিবি!”

পাড়ার এক বয়স্ক প্রতিবেশী শিবানীর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে কথাগুলো বলে যায়! সেবার চৈত্র শেষে খুব দাবদাহ শুরু হয়। তবু একরত্তি বট গাছটাকে বাঁচাতে চেষ্টা করে শিবানী।

নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম শিবানীর। স্বামী হরিচরণ রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। কিন্তু নেশা করে হরিচরণ সারা জীবন প্রায় কিছুই জমাতে পারেনি। বর্ধমান জেলার গ্রামে শিবানীর বিয়ের সময় গরুর গাড়ি চলত। দু’ধারে ধানের মাড়াই-এর মাঝে কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে আঠারো বছর বয়সে শ্বশুরের ভিটেতে আসে শিবানী। শাশুড়ি প্রথম দিকে বউকে বেশ যত্ন করত। কিন্তু শিবানীর বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় পর পর দুটি মেয়ে হওয়ায় শাশুড়ির নজর বিষ হয়ে যায়।
শিবানীকে মাঠে চাষের কাজে পাঠায় শাশুড়ি। সেই সময় সারাদিন অকথ্য পরিশ্রম করেও শ্বশুরবাড়ির কারোর মন পায়নি শিবানী। তার দুই দেওরের ঘরে দুটি পুত্র সন্তান। কিন্তু বড় বউ শিবানীর পুত্র সন্তান নেই এই আক্ষেপ করতে করতে শিবানীর শ্বশুর মারা যায়। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর শিবানীর দেওররা নিজেদের জায়গা জমি আলাদা করে নেয়। তার শাশুড়িও ছোট দেওরের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। হরিচরণ ও শিবানী ভাগে একটি ঘর পায়। শিবানীর ইচ্ছে ছিল টাকা ধার করে শহরের দিকে জমি কিনবে। এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু হরিচরণ বদলায় না। অতিরিক্ত নেশার বশে অমানুষের মতো বউ-এর গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না। তাই শিবানী নিরুপায়। বিয়ের পর থেকে শুধু গঞ্জনাই জুটেছে তার কপালে। শিবানীর দুই মেয়ে—রীতা ও গীতা। সংসারে অভাবের জন্য রীতাকে শহরে বাবুদের বাড়িতে থাকা খাওয়ার কাজে পাঠায় শিবানী। নিজেও গ্রামে দুটি অবস্থাপন্ন পরিবারে কাজ নেয়।
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-১: পুরুষোত্তম/১

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৬: ছবিঘর অন্ধকার

হঠাৎ-ই একদিন শিবানীর ঘরের উঠোনের পাশে একরত্তি বট গাছ গজিয়ে ওঠে। তীব্ৰ উষ্ণতায় বট গাছটিতে বার বার জল দিতে দিতে শিবানীর ভেতর এক অপত্য স্নেহ জেগে ওঠে। গাছটিকে মন থেকে ছেলে বলে স্বীকার করে নেয়। এই কথাটা ধীরে ধীরে তার পরিবারের সকলে এবং পাড়া প্রতিবেশীদের কাছেও পৌঁছয়। অনেকে ব্যঙ্গ কৌতুক করতে ছাড়ে না শিবানীকে। তবে শিবানী গ্রাহ্য করে না। বট গাছটিকে যেন সে চোখে হারায়।

প্রায় বারো তেরো বছর কেটে যায়। ঋতুর খেলায় প্রকৃতি ও মানুষজনের জীবন নানা ভাবে অবর্তিত হয়। আজকাল হরিচরণ আর রাজমিস্ত্রীর কাজে যায় না। অন্যের টোটো চালিয়ে মালিককে টাকা দেয় আর নিজের ভাগ বুঝে নেয়। শিবানীর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর দুর্বল হয়। ঘন ঘন শ্বাস পড়ে। এখন গ্রামের বেশীর ভাগ রাস্তাই পাকা। চাষের কাজে ট্রাক্টর আসায় কিছু ভাগ চাষি কর্মহীন হয়ে রুজি রোজগারের সন্ধানে শহরে যায়।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

রাক্ষসের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ঢুকে গেলেন বেতারকেন্দ্রে

কদিন ধরে শিবানী লক্ষ্য করে তার বট গাছটির প্রায় গায়ে আর একটি বট গাছ জন্ম নিয়েছে। সারাটা দিন কাজের পর ক্লান্ত শরীরে বটের নীচে বসে ছেলের বিয়ের স্বপ্ন দেখে শিবানী। বড় বটের গায়ে গজিয়ে ওঠা ছোট বটটিকেই পাত্রী হিসাবে দেখে সে। বাবুদের বাড়ি থেকে ধার দেনা করে আয়োজন করে বিয়ের। হরিচরণ বাধা দিতে গেলে শিবানী বলে, “ছেলে বলে যখন মানি, তাকে বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও তো আছে।”

বৈশাখ মাসের অষ্টমী তিথি বিয়ের দিন হিসাবে নির্ধারিত করে ধুতি, টোপর, কনের শাড়ি, ফুলের মালা ইত্যাদি কেনার লিস্ট বানিয়ে পুরোহিতকে ওইদিন সন্ধ্যা লগ্নে আসতে বলে দেয় শিবানী।

বৈশাখ মাসের অষ্টমী তিথিতে পাশের গ্রাম মন্তেশ্বরে প্রতি বছর চামুণ্ডা পুজো হয়। পুরোনো পুজো। মন্দির থেকে দেবীকে নিয়ে গ্রামের মানুষজন গ্রাম পরিক্রমা করে। শিবানী মা চামুণ্ডার ভক্ত। অতীতে খড়ি নদীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ড অংশ নিয়ে মন্তেশ্বর গড়ে উঠেছিল। এই নদীকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যর সূত্র ধরে জনপদ গড়ে ওঠে, যেখানে মাইচ পাড়ায় চামুণ্ডা মন্দিরে ভোগ চড়ানো হয়। এককালে এখানে বর্ধমানের মহারাজদের রাজপণ্ডিতদের নির্দেশে রাজপুরোহিত ভোগ ও আরতির ব্যবস্থা করতেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২০: অক্টোবর মাসের ষোলো, কী হল! কী হল?

শিবানী মনে করে মা চামুন্ডার কৃপায় তার উঠোনে বট গাছের জন্ম। বৈশাখী অষ্টমী তিথিতে মা চামুণ্ডাকে বরণ করা হয়, সেদিন গোটা গ্রাম ঘুরে তিনি পুজো নেন। ভক্তদের উপচানো ভিড়ে শিবানীও গিয়ে দাঁড়ায়। আজ যে তার ছেলের বিয়ে। তাই মায়ের আশীর্বাদ দরকার। ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে বটতলায় বসে বারো মাস নিজের মনের কথা, কত সুখ দুঃখের পাঁচালী বলে শিবানী। নীরবে ভাব বিনিময় হয়। অপত্য স্বাদ পায় শিবানী। কেউ না বুঝলেও নিজের অনুভূতি বুঝতে পারে শিবানী। তীব্ৰ রোদে গাছটিকে দেখে কতদিন মায়ায় কেঁদে ফেলে সে। বটের কাণ্ডের গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখে গরমে প্রচন্ড দহনে কতটা কষ্ট হয়েছে। শিবানী ভাবে তার মৃত্যুর পরেও এই গাছ অনেক বছর পৃথিবীর মাটি আঁকড়ে থাকবে। এভাবেই যেন তার উত্তরাধিকার বহন করবে!

শিবানী ছেলের বিয়ের কথা বলে পাড়া ঘরের কয়েকজনকে নেমতন্ন করে এসেছে। লুচি, আলুরদম, চাটনি, রসগোল্লা খাওয়াবে সকলকে। এভাবেই পুত্র সন্তানের অপূর্ণ বাসনায় এক গ্রাম্য বধূর আর্তি ও মা চামুণ্ডার লীলা মিলে মিশে গড়ে ওঠে ভক্তি ও বিশ্বাসের কাহিনি।
 

সমাপ্ত

* গল্প (Short Story) – আর্তি (Arti) : ড. জনা বন্দ্যোপাধ্যায় (Jana Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহিলা মহাবিদ্যালয়।

Skip to content