সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


লাবণ্য মুখার্জি বিধবা। স্কুলে পড়াতেন, এখন অবসর নিয়েছেন। লাবণ্য লড়াইয়ের ইতিহাস দীর্ঘ। এখন লাবণ্য যেখানে থাকে সেটা তাঁর পৈতৃক বাড়ি। লাবণ্যর বিয়ে হয়েছিল মনোহরপুকুর রোডের ধনী পরিবারে। স্বামী প্রবীর চ্যাটার্জি ছিলেন ছবির প্রযোজক। লাবণ্যর বাবা ছিলেন শিক্ষক। তিনি ছবির জগৎটাকে বুঝতেন না, তাই বিয়ে দিতে চাননি। কিন্তু বিয়েটা হয়েছিল লাবণ্যর পিসির জোরাজুরিতে। শ্বশুরবাড়ির সূত্রে লাবণ্যের পিসির সঙ্গে প্রবীরের মা’র পরিচয় ছিল। লাবণ্য সুন্দরী ভাইঝির ছবি দেখিয়েছিলেন প্রবীরের মাকে। ছেলে সংসারে মন নেই, সুন্দরী ঘরণী দিয়ে ছেলেকে বাঁধতে চাইলেন। কিন্তু সন্তান জন্মের পরও প্রবীর বারমুখো। ব্যক্তিত্বময়ী লাবণ্য অনাচার মেনে নিতে অস্বীকার করল।

স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে মাত্র ২৭ বছরের লাবণ্য পাকাপাকিভাবে দু’ বছরের ছেলেকে নিয়ে উঠলো মা-বাবার কাছে বোলপুরে। তারপর ছেলে ঘিরেই স্বপ্ন দেখত লাবণ্য। নিজের স্বপ্নের পাখা গুটিয়ে নিয়েছিল। লাবণ্য ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে বড় হয়েছে। গুরুদেবের গান গুরুদেবের লেখা লাবণ্যর সংগ্রামের মন্ত্র তার প্রতিবাদের ভাষা। বোলপুরের একটি স্কুলে লাবণ্য চাকরি পেল। দুশ্চরিত্র স্বামীর থেকে একটি পয়সাও না নিয়ে স্বামীর পদবী টুকু সযত্নে ছেঁটে ফেলে ছেলেকে মানুষ করল লাবণ্য একা। এর মধ্যে প্রথমে মা চলে গেলো তারপর বাবা। বাবা স্কুল শিক্ষক হলেও ভীষণ সৌখিন মানুষ ছিলেন তাই খুব যত্ন করে একটা সুন্দর বাংলো বানিয়েছিলেন থাকার জন্য। সেই বাংলাতে লাবণ্য এখন একা থাকে আর থাকে সোনা। সোনা লাবণ্যর দিনরাতের লোক।

ছেলে আদিত্য বিশ্বভারতী থেকে কেমিস্ট্রিতে এমএসসি পাস করে বিদেশ থেকে ডক্টরেট করে এসে এখন এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির আর অ্যান্ড ডি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে। আদিত্য কিছুদিন আগেই বিয়ে করেছে ওর অফিসের এক সহকর্মীকে নাম আনন্দী। তবে সকলের মুখে মুখে অ্যানি নামে পরিচিত। আদিত্য অ্যানি বলে ডাকে। বিয়ের পর আনন্দী চাকরি করে না। আদিত্য আর আনন্দী গড়িয়াহাটে তাদের ফ্ল্যাটে থাকে। ছুটিছাটায় সময় পেলে বোলপুরে যায়।
আদিত্য যখন বিদেশে তখন সেই পিসিমার কাছেই পূর্বতন স্বামীর দূর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর পেয়েছিল লাবণ্য। কোনও সম্পর্ক নেই তবু চতুর্থীর দিনে শ্রাদ্ধের কাজ করেছিল লাবণ্য। বিবাহ-বিচ্ছেদের পর থেকেই সাদা শাড়ি পরত। সিদূঁর দিত না, শাঁখা-পলা ব্যবহার করত না। তবু শ্রাদ্ধের কাজ কেন করছে তার কোন উত্তর প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজনদের দেয়নি। শুধু জানিয়েছে তার ইচ্ছে। বিবাহবিচ্ছেদ যেমন তাঁর ইচ্ছে ছিল সেদিন শ্রাদ্ধ করাটাও তার ইচ্ছে। লোকটি দুশ্চরিত্র লম্পট হলেও তাঁর মাথায় সিঁদুর দিয়েছিল একসঙ্গে বিবাহ মন্ত্র বলেছিল। তাই তাঁকে স্বামী হিসেবে কাগজে নয় মন্ত্র পড়ে ত্যাগ করতে চেয়েছিল লাবণ্য। একথা ছেলেকে জানিয়েছিল লাবণ্য। বিদেশ থেকে ফিরে আদিত্য মা’র কাছে জানতে চেয়েছিল কী দরকার ছিল সেসব আচার অনুষ্ঠান।

লাবণ্য বরাবরই স্বাধীনচেতা আত্মনির্ভর। আদিত্য যখন আনন্দীকে বিয়ে করতে চাইল, লাবণ্য বাধা দেয়নি। শুধু কয়েকটা কথা বলেছিল বোঝপড়াটা যেন সারাজীবন থাকে। বিয়ের আচার অনুষ্ঠান সব কলকাতায় করতে কারণ বোলপুরে বৌভাত করলে কলকাতার বন্ধুবান্ধব সহকর্মী আনন্দীর আত্মীয়স্বজনদের অনেক অসুবিধে। তার ওপর বোলপুরে অনেক লোকজন ডাকতে হবে, যাদের আদিত্য-আনন্দী এর আগেও দেখেনি বা ভবিষ্যতেও আর দেখবে না।

সারাদিন রবীন্দ্রনাথের লেখা গানে কবিতা সময় কাটাতে কাটাতে অধুনা ক্লান্ত হয়ে পড়া লাবণ্যর একাকী জীবনে একমাত্র রোমাঞ্চ ছিল চিরঞ্জীবের চিঠি। ছেলে যতদিন ছোট ছিল বা মা-বাবা বেঁচেছিলেন ততদিন চিঠি খোলেনি। লাবণ্যর স্কুলের বান্ধবী রানু মণ্ডলের জেঠতুতো দাদা চিরঞ্জীব। বয়সে বছর চারেকের বড় চিরঞ্জীব। চিরঞ্জীব যখন প্রথম লাবণ্যকে প্রেম নিবেদন করেছিল তখন সে ক্লাস নাইনে। রাণুর অজান্তে লাবণ্যর খাতার মধ্যে ১৯ বছরের চিরঞ্জীব মণ্ডল চিঠি দিয়েছিল ১৫ বছরের লাবণ্য মুখার্জিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক লাবণ্য এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি।

আগে প্রায়শই রাণুদের বাড়িতে যেত কিন্তু ওই চিঠির পর লাবণ্য রাণুদের বাড়ি আর যেত না। রাণুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু কী যেন একটা ভয় একটা সঙ্কোচ লাবণ্যকে গুটিয়ে রেখেছিল। রাণুর থেকে খাতা-বই নিলে রাণুর সামনেই সেটা খুলে দেখতো। এর মধ্যে ছ’মাস কেটে গিয়েছে। রাণুদের বাড়িতে খুব ধুমধাম করে লক্ষ্মীপুজো হোত। সেখানে না গিয়ে উপায় নেই। আর সেখানে গিয়ে আরতির সময় পায়ের কাছে একটা কাগজের গোল পাকানো পেল লাবণ্য। একটা কথা ‘তোমাকে দুঃখ দিয়ে থাকলে ক্ষমা কোরো।’
আরও পড়ুন:

হ্যালো বাবু! পর্ব-৩: সুষমা দেবীর ঘরের দুটো জানালার উপরের পাল্লা খোলা ছিল

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৮: সত্যব্রতর ছানবিন

ওই একটা লাইন কিশোরী লাবণ্যের সব ওলটপালট করে দিল। কোথা থেকে যে সাহসী হয়ে উঠলো লাবণ্য প্রথমেই রাণুকে সব বলল, আর রাণুর মাধ্যমের আদানপ্রদান হতে লাগল রাশি রাশি প্রেমপত্র আঠা দিয়ে জোড়া খাম তার ওপর হৃদয়-বেঁধা তির আঁকা। তবে ওরা দুজনেই দুঃসাহসী হতে পারেনি। সঙ্কোচ ভয় লজ্জা মিলেমিশে বনেজঙ্গলে নদীর ধারে বা সিনেমা হলে একা একা দেখা করা প্রেম হয়ে ওঠেনি। রাণুকে সঙ্গে নিয়ে এক-দুবার দেখা। বোলপুর কলেজে পড়ার সময় দু’বার চিরঞ্জীব কলেজে এসেছিল। একবার কলেজ সোশ্যালে লাবণ্যর আবৃত্তি শুনতে আর একবার কলেজের মেয়েরা ‘তাসের দেশ’ করেছিল লাবণ্য সেজেছিল ‘পত্রলেখা’ রাণু সেজেছিল ‘রুইতন’। গ্রাজুয়েশনের পর বিশ্বভারতীতে এমএ পড়তে গেল লাবণ্য-রানুর নম্বর ভাল ছিল না তাই সুযোগ পেল না।

চিরঞ্জীব বিশ্বভারতী থেকে বিএসসি পাশ করেছিল। তারপর নানা চাকরির পরীক্ষায় চেষ্টা করছিল, হঠাৎ রাণুর জেঠু মারা গেলেন। চিরঞ্জীবরা দুভাই। রাজীব আর চিরঞ্জীব। রাজীব প্রায় বছর পাঁচেকের বড়। রাণুর জেঠুর ছোটখাটো ওষুধের দোকান ছিল। রাজীবই দেখত সে দোকান। এবার চিরঞ্জীবের বশে ঠ্যাকা আর চলেনা। মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভরা দোকানে আসত। তাদের ধরেকরে একটা চাকরি জুটে গেল, নাওয়া খাওয়া ভুলে ব্যাগ নিয়ে এখানে সেখানে ছুটতে লাগল চিরঞ্জীব। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। লাবণ্যর দ্বায়িত্ব নিতে গেলে একটা ভদ্রস্থ রোজগার চাই- আর তাই চাকরিতে উন্নতি করতে হবে। নাহলে নিজের বাড়ীতেই বা বিয়ের কথা বলবে কোন মুখে?
কিন্তু বিয়েটা হয়নি। অসবর্ণ বিয়ে মানা হবেনা এটা লাবণ্য-চিরঞ্জীব দুজনেই জানত। তাছাড়া লাবণ্য যখন বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে তখন চিরঞ্জীব সারা বাংলার একোণে-ওকোণে ছুটছে। ছোট কোম্পানি তাদের অতো জোন এরিয়ার ভাগ বাঁটোয়ারা নেই। লাবণ্যর বিয়ে হয়ে যাবার পর চিরঞ্জীব চাকরি নিয়ে গুজরাট চলে গেল। রাণুর যখন বিয়ে হল লাবণ্য তখন তার দুশ্চরিত্র স্বামীর লাম্পট্যে জেরবার। ছেলেটা একেবারেই ছোট। রানুর বিয়ে হল পাটনায়। ছেলেই বড়। রেলকর্মী।

পরে একভাই একবোন। রাণু বড়বৌ। অনেক দ্বায়িত্ব। বিয়ের পরপরই রাণু ক্রমশ শ্বশুর-শাশুড়ির শরীর খারাপ তার চিকিৎসা, দেওর-ননদের বিয়ে-থা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা একটার পর একটা সাংসারিক দ্বায়িত্বে জড়িয়ে পড়তে থাকে। সেসব সামলে অনেকদিন পর বাপের বাড়ি এসে লাবণ্যর ডিভোর্সের কথা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। দোনোমনায় আর যোগযোগ করেনি। তারপর যা হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের সুতোর পাক আলগা হতে হতে একসময় সুতোটাই ছিঁড়ে যায়। লাবণ্যও নিজের দূর্ভাগ্যকে জীবনের চলার পথে বাধা হিসেবে মেনে নিল। এরপর সময়ের স্রোতে লাবণ্য আর রাণু অনেকটা দূরে যতদিন আদিত্যকে মানুষ করেছে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছে ততদিন নিজেকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার সময় পায়নি লাবণ্য।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?

প্রথমে মা আর তারপর বাবা চলে গেল। আদিত্য তার নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করল। লাবণ্য নিশ্চিন্ত হল, ওরা আজকের বুদ্ধিমান ছেলেমেয়ে ওদের আবেগ কম ওরা অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল।

চতুর্থীর কাজ সারার পর লাবণ্যর মনটা অনেক হাল্কা লাগল। লাবণ্য ছেলের সংসার গুছিয়ে দিয়েছে মা-বাবার সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। স্বামীর প্রতি পূর্ণ কর্তব্য করেছে। এবার নিজের জন্যে বাঁচবে। বাবা মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল মা! তোর পিসির কথায় খোঁজখবর না নিয়ে বড়লোক বাড়ীতে তোর বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা বোধহয় ঠিক হয়নি। তোর জীবনটা যে ছারখার হয়ে গেল। তোর মা বলেছিল তুই রাণুর জেঠার ছেলেকে …কিন্তু আমি সেদিন মেনে নিতে পারিনি। সেদিন মস্তবড় ভুল করেছিলাম।

এ সব বলার পর অসুস্থতার কারণেই লাবণ্যের বাবা আর কথা বলেননি । তার ঠিক দু’দিন পর তিনি চলে গিয়েছিলেন। এরপর লাবণ্য স্কুলে পড়াতে পড়াতে একটু একটু করে আয়নায় তাকে বদলাতে দেখল। একরাশ ঘন চুল পাতলা হল- কুচকুচে কালো রঙে রুপোলী ছোঁয়া মুখের টানটান চামড়ায় ভাঁজ এল। কিন্তু এখনো তার চোখ একই রকম আকর্ষণীয়- চিরঞ্জীব বলত—
“তোমার চেহারায় লাবণ্য আর চোখে সম্মোহন ডেডলি কম্বিনেশন!!”

কী আশ্চর্য প্রবীরের কোনদিন মনে হয়নি। মনে হয়নি কোনও দূর্বল মূহুর্তের শারীরিক যান্ত্রিকতায়। সে দু-চোখ ভরে নায়িকাদের রূপ দেখত, তাদের কামনা করত। তাই মনে হয়নি।

কিন্তু আজ এতদিন এতবছর পরে চিরঞ্জীব ফিরে এল কেন? আচমকা!
তার চিঠিগুলো চিরঞ্জীব কী করেছে লাবণ্য জানে না। বিয়ে-থা হবার পর এসব তো নষ্ট করে ফেলারই কথা। সবাই তো লাবণ্যর মতো ঝাড়া হাত-পা নয়। তবু তাকে দরজায় ছিটকিনি তুলে আলমারির লকারে গয়নার বাক্সের নিচে রাখা কাশ্মীরি কাঠের বাক্সটা বের করতে হল। রাতদিনের কাজের মেয়ে সোনা এমনি খুবই বাধ্য কিন্তু খুব চালাকচতুর সজাগ।

মোট ২২টা চিঠি। জীবনের এতদিনের এতঝড়ের পর চিরঞ্জীবের নির্ভেজাল ভালবাসায় মোড়া চিঠিগুলো কমবয়েসের সৎ আবেগ ভরা চিঠিগুলো মনটা যেন ভরিয়ে দিচ্ছিল লাবণ্যর।

আর ঠিক তখনই মাসখানেক খারাপ হয়ে থাকা ল্যান্ডলাইনের টেলিফোন ঝনঝন করে বেজে উঠল।
ও প্রান্তে মহিলা কণ্ঠ।
—কে লাবণ্য?
সরাসরি নাম ধরে জানতে চাইছে গলাটা অচেনা নয়, তবে বহুদিন না শোনা লাবণ্য দ্রুত একবার স্মৃতি হাতড়াবার চেষ্টা করে। নাঃ! বুঝতে পারছেন না।
—আমায় চিনতে পারছিস না লাবণ্য?
আচমকা ভুস করে স্মৃতির অতল থেকে ভেসে ওঠে কেউ।
—ওমা রাণু! তুই এত বছর বাদে। তোর মনে আছে আমাকে? কোথা থেকে ফোন করছিস? কেমন আছিস তুই?
জমে থাকা প্রশ্নের বাঁধ মানে না। কিন্তু কি অদ্ভুত রানু শেষ প্রশ্নটারই প্রথম উত্তর দিল।
—ভালোই ছিলাম লাবণ্য। তবে আজ সকালেই একটা খবর পেয়ে আর ভালো থাকতে পারলাম না
রানু যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে। লাবণ্য অবাক হয়ে যায়।
—রাণু কাঁদছিস কেন কি হয়েছে? আমার সব খুলে বল।
—তোকে বলবো বলেই তো ফোন করেছি লাবণ্য। ভাবছি এতদিন কেন একবারও ফোন করলাম না। তোর খবর আমি সব শুনেছি কিন্তু কি যেন একটা সংকোচে তোর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। আর এমনই দুর্ভাগ্য দেয় এত বছর বাদে প্রথম তোকে যখন ফোন করছি সেটা একটা ভয়ঙ্কর খারাপ খবর নিয়ে।
—খারাপ খবর? মানে?
দলা পাকানো কান্নায় জড়িয়ে যাওয়া কথায় রাণু কোনওক্রমে বলেছিল, তার চির-দা আর নেই! লাবণ্য পাথরের মতো কানে ফোনের রিসিভার ধরে বলেছিল—
—কোথায় থাকতো ও? ফ্যামিলিতে আর কে কে আছেন?
—চির-দা বিয়ে করেনি। বহুবছর ছত্রিশগড়, এমপি এসব জায়গায় চাকরি করেছে। রিটায়ার করে কলকাতার একটা মেসে থাকতো। তুই তো জানিস ও ভীষণ অভিমানী। রাজীবদা বৌদির কাছে গিয়ে থাকার ছেলে ও নয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২২: এদিক ওদিক বেড়ায় তবু ভুলের পাড়া বেড়ায় না

রাণু অনেক কথা বলছিল লাবণ্যর কানে সেসব ঢোকেনি। তার শুধু মনে হচ্ছে হঠাৎ করে চিরঞ্জীব তার মনের মধ্যে এসে বসল কি করে? তবে কি চিরঞ্জিত চাইছিল যাতে তার সঙ্গে একবার দেখা হয়। তাহলে এত বছর বাদে হঠাৎ করে এসে চিঠিগুলো খুলবে কেন?

সেই এক বাক্স চিঠি ঘাঁটতে ঘাঁটতে দু-তিন দিন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। হঠাৎ লাবণ্যর মনে হল। স্বয়ং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ মৃত আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতেন। কখনও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বা কখনও শান্তিনিকেতনে। অবনীন্দ্রনাথ থেকে নন্দলাল বসু অনেকে তার সাক্ষী। তিনি নিজেই বলেছেন— “মানুষ মরে গেলেই যে একেবারে হারিয়ে যায়, জীবিত প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেকথা আমি বিশ্বাস করি না”। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পরে বহুবার তাঁকে প্ল্যানচেট করে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রাতে লাবণ্যের ঘরেই শুতো কাজের মেয়ে সোনা। তাকে শুতে মানা করে দিল লাবণ্য জানিয়ে দিল এখন রাতে তার ঘুম আসে না অনেক রাত অব্দি গল্পের বই পড়ে নয়তো টিভি দেখতে ইচ্ছে করে সোনা ঘুমোয় সেসব করা হয়ে ওঠে না। সোনা যেন পাশের ঘরে শুয়ে পড়ে। যদি কখনো রাতে কোন দরকার হয় লাবণ্য সোনাকে ডেকে নেবে। পরের পর্ব আগামীকাল
* এক বাক্স চিঠি (a-box-of-letters) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content