সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

উচ্চ তীব্রতা ও উচ্চ প্রাবল্যের কোনও শব্দ যদি মানুষের সহনশীল ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং তা মানবদেহে, প্রাণীজগতে এবং পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে থাকে, তাহলে এই অবাঞ্ছিত, সুরবর্জিত ও কর্কশ শব্দ থেকে হওয়া দূষণকে বলে শব্দদূষণ। বিজ্ঞানী গ্রাহাম বেলের নাম অনুসারে শব্দ পরিমাপের একক হল ডেসিবেল।

পৃথিবীতে নানান কারণে শব্দদূষণ হতে পারে, যেমন-যানবাহনের শব্দ, কলকারখানার শব্দ, বাজিফোটানো বা কোন বিস্ফোরণজনিত শব্দ ইত্যাদি। নানান যানবাহন যেমন ট্রাক, মোটর গাড়ি, রেল এবং প্লেনের শব্দ, শব্দদূষণ ঘটাতে পারে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যানবাহনজনিত দূষণের মাত্রা ৭০ ডেসিবেল বেঁধে রেখেছে। অর্থাৎ এই সীমারেখা পেরিয়ে গেলে হর্ন বাজানো উচিত নয়। ভারতে শিল্পক্ষেত্র বা কলকারখানাযুক্ত স্থানে ৮ ঘণ্টায় গড়ে ৯০ ডেসিবেল শব্দকে সর্বোচ্চ বলে ঠিক করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বাজি ফোটানো বা কোনও আকস্মিক বিস্ফোরণ তা প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যজনিত কারণে হতে পারে—এগুলি থেকেও হতে পারে শব্দ দূষণ।
শব্দদূষণ প্রভাব বিস্তার করে সমগ্র মানবশরীর ও মনে, এছাড়াও প্রাণীজগৎ এবং সমগ্র পরিবেশের উপরও এর প্রভাব স্পষ্ট। আমাদের শ্রুতিযন্ত্র কান। সুমধুর কোনও শব্দ আমাদের কানের মধ্য দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে। অর্থাৎ এটি আমাদের দেহ এবং মনে আনন্দ-প্রদান করে। কিন্তু কর্কশ কোনও শব্দ যদি আমরা দীর্ঘদিন ধরে শ্রবণ করে থাকি, তাহলে আমাদের অন্তকর্ণের মধ্যে অবস্থিত ‘অর্গান অফ কটি’কে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলস্বরূপ আমাদের শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। একে ‘নয়েস ইনডিউসড হিয়ারিং লস’ বলে।

এটি দু’ ভাবে মানবশরীরের ক্ষতি করতে পারে, যেমন: উচ্চ প্রাবল্যের শব্দ এককালীন হঠাৎ শুনলে আমাদের অন্তঃকর্ণের মধ্যে ককলিয়া নামক শ্রবণযন্ত্রটি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একে ‘একাউষ্টিক ট্রমা’ বলে। সাধারণত এক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা ১৫০ ডেসিবেল বা তার উর্ধ্বে হতে পারে। মূলত শব্দের প্রাবল্য ৮৫ ডেসিবেল বা তার ঊর্ধ্ব হলে, তা যদি আমরা অনবরত শুনতে থাকি তাহলে আমাদের শ্রবণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
আরও পড়ুন:

পরিবেশ চিন্তায় রামায়ণ ও মহাভারত

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

হৃদযন্ত্রের ওপরও এই ধরনের শব্দের প্রভাব বড়ই ক্ষতিকর। যেমন, এক. শব্দের মাত্রা যদি ৯০ ডেসিবেল বা এর ঊর্ধ্বে উঠে, তাহলে আমাদের রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। দুই. আমরা যদি অনবরত 60 ডেসিবেল বা তার ঊর্ধ্বে কোনও শব্দ শুনে থাকি, তাহলে ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন’ নামক বিশেষ হৃদরোগ হতে পারে। এছাড়াও উচ্চ প্রাবল্যের শব্দে আমাদের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ু এবং দশম করোটিয় স্নায়ু অর্থাৎ ভেগাসস্নায়ুর উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। ফলে হৃদস্পন্দনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। শরীর ছাড়াও মানব মনের ওপর শব্দের বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। আমাদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে শব্দদূষণ। এর ফলে সিজোফ্রেনিয়া অর্থাৎ মানসিক বিকার লক্ষ্য করা যেতে পারে।

শরীর ও মন যেহেতু একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, তাই আরও নানান সমস্যা যেমন অনিদ্রা, মধুমেহ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। শব্দদূষণ থেকে প্রাণীদের হতে পারে বধিরতা, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বৃদ্ধি হ্রাস ইত্যাদি। কোনও কোনও প্রাণী যেমন বাদুড় এবং নিশাচর প্রাণীরা নানান ধরনের উচ্চপ্রাবল্য যুক্ত শব্দ তৈরি করে যার মাধ্যমে এরা শিকার ধরে এবং বিভিন্ন জায়গায় চলাচল করে। কিন্তু শব্দদূষণ এই ধরনের শব্দকে মাস্কি করে যা তাদের জীবনযাত্রাকে এবং তাদের বাঁচার ক্ষমতাকেও হ্রাস করতে পারে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৮: প্যায়ার করনে ওয়ালে প্যায়ার করতে হ্যায় শান সে— আশার কণ্ঠ ও আরডি-র সুর, অনবদ্য

পরিযায়ী মন: নীলনদের দেশে পিরামিড মানে অপার বিস্ময়

মাফলার একটি বিশেষ ধরনের পোশাক যা আমাদের মাথার উপর জড়ানো থাকে ও কান দুটিকে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করে। এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতিবিদ, উদ্ভিদবিদ এবং অন্যান্য বিভিন্ন গবেষকরা গ্রিন মাফলার নামক এক বিশেষ ধারণার জন্ম দিয়েছেন। গ্রিন মাফলার শব্দদূষণ এর তীব্রতা এবং মাত্রাকে হ্রাস করে। দেখা গিয়েছে, চার থেকে ছয় সারিতে যদি পরপর গাছ লাগানো হয়ে থাকে, যা কোনও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল বা কোলাহলপূর্ণ অঞ্চলে কোন বসতি, কোন শহর বা গ্রামকে ঘিরে রাখে। তাহলে বাইরের শব্দ ওই অঞ্চলটিকে কম আসে। এটিই গ্রিন মাফলার নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭২: প্রজননক্ষম মাছের চাষে মুনাফা ভালো, তবে কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

বর্তমানে ভারত সরকার এই গ্রিন মাফলার প্রকল্পটিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে গ্রিন মাফলার পাথরের দেওয়ালের মতো বাঁধার পাহাড় সৃষ্টি করে এবং কোন অঞ্চলে শব্দদূষণ রোধ করে। এখানে চিরহরিৎ বৃক্ষ বা চিরহরিৎ গুল্মের গাছ লাগানো হয়ে থাকে এবং তা এমনভাবে লাগানো হয় যা নিশ্ছিদ্র এবং ঘন সন্নিবিষ্ট। ফলে গাছগুলি নীলকণ্ঠের মতো শব্দদূষণ শোষণ করে নেয়। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার-এর মতে, এই ধরনের মাফলার প্রায় ১০ ডেসিবেল শব্দের প্রাবল্য বা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শব্দদূষণ হ্রাস করতে সক্ষম।

ভারতে অতি পরিচিত দুটি গাছ হল অশোক এবং নিম গাছ। সাধারণত এই গ্রিন মাফলারে এদের ব্যবহার করা হয়। এই প্রকল্পে কেবলমাত্র শব্দদূষণ প্রতিরোধ নয়, ভারতের প্রান্তে প্রান্তে প্রচুর গাছ লাগাতে সক্ষম হব। ফলে সবুজ হবে এই প্রকৃতি, ভূমিক্ষয় রোধ হবে, বায়ুদূষণ ও অন্যান্য নানান দূষণের হাত থেকে আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে আমরা রক্ষা করতে পারব।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content