মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা অতি প্রাচীন, বিশ্বাসযোগ্য ও চিরাচরিত পদ্ধতি। নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে তাপ প্রয়োগে, শরীরে নানা ব্যথা-বেদনা ও রোগের উপশম ঘটে। কোনও স্থানে যন্ত্রণা হলে, জল এবং কাপড় গরম করে সেঁক দেওয়ার রেওয়াজ আজকের নয়। রজঃস্রাবের যন্ত্রণায় তলপেটে হটব্যাগ নিয়ে শুয়ে থাকেন অনেক মা-বোনেরাই। কোমর ও পিঠে ব্যথাজনিত কারণে ওই হট ব্যাগই ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে নতুন মোড়কে উন্নত করা হচ্ছে। শরীরের উপরিস্থল অথবা গভীরতম অংশে সিক্ত বা শুষ্ক পদ্ধতিতে তাপ প্রয়োগ করা হয়।
হিট থেরাপির আবার বিভিন্ন ভাগ আছে। যেমন ওয়াক্স বা মোম থেরাপি, লেজার থেরাপি, অতিবেগুনি রশ্মি থেরাপি ইত্যাদি। এ সবের ফলে কোনও স্থানে রক্তপ্রবাহ, কলা-কোষে বিপাক হার এবং বিভিন্ন কলার স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়। তাপ থেরাপির ফলে, কোনও স্থান থেকে শিরা-উপশিরা বর্ধনকারী পদার্থ হিস্টামিন ও প্রস্টাগ্লান্ডিন নির্গত হয়, যা ওখানে ভ্যা সোডায়ালেশনে সাহায্য করে। এর ফলে সেখানে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়, অপ্রত্যক্ষ ভাবে যা সুষুম্নাকাণ্ডকে সক্রিয় করে তোলে। রক্তের সঙ্গে সাথে ওই স্থানগুলিতে অক্সিজেন, হরমোন, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, পুষ্টিদ্রব্য ও প্রোটিন ইত্যাদি বেশি মাত্রায় সরবরাহিত হয়ে থাকে। তাপ কোনও স্থানের যন্ত্রণা নিরাময়ের জন্য সেখানকার যন্ত্রণা নিরাময়কারী গ্রাহকগুলিকে উজ্জীবিত করে থাকে।

এই থেরাপির ফলে সংলগ্ন স্থান থেকে ব্রাডিকাইনিন ও নাইট্রাস অক্সাইড নামক রাসায়নিক পদার্থগুলি নির্গত হয়ে থাকে। এগুলি আঘাতপ্রাপ্ত পেশীকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসে। শরীরে আরামদায়ক তাপ বৃদ্ধির ফলে পেশী কোষ রিল্যাক্স অবস্থায় থাকে এবং তার কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
আরও পড়ুন:

টুথপেস্টের এই ক্ষতিকারক দিকগুলি জানেন কি?

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৪: অন্ধকারের উৎস হতে—শীতকালের প্রতিরাত

এই থেরাপির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, দেহের উষ্ণতা বৃদ্ধি করা। কোন ব্যক্তি যখন ঠান্ডার স্থানে অথবা পার্বত্য অঞ্চলে ঠাণ্ডাজনিত কারণে অচেতন হয়ে পড়ে, তখন তার উষ্ণতা বৃদ্ধি অত্যন্ত কার্যকর হয়। এরজন্য তাঁর পায়ের তলদেশ ঘর্ষণ করা অথবা শুকনো কাপড় গরম করে তাতে দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে স্নায়ু কোষের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, স্নায়ুস্পন্দন দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই নিয়ে এখনো গভীর তত্ত্বানুসন্ধান চলছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই নিয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে এই থেরাপির ফলে, রক্তের সান্দ্রতা এবং রক্তচাপ হ্রাস পায়। ফলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। ইসকেমিয়াজনিত বেদনা হ্রাস ও মাসেল ক্রাম্প দূর করতে এই থেরাপির জুড়ি মেলা ভার।

বিজ্ঞানী ভ্যা ন্ট হপের নিয়ম অনুসারে, শরীরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে, কলা-কোষের বিপাক হার বৃদ্ধি পায়। তার ফলে কোষ ভালোভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে শরীরে খাদ্যের চাহিদা বাড়ে। এছাড়া আমরা জানি, একটি অপটিমাম উষ্ণতায় যে কোনও উৎসেচক সব থেকে ভালো কার্য দেখায়। ফলে অপ্রত্যক্ষভাবে শরীরে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও শরীর সুস্থ অবস্থায় থাকে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থের উপর তাপের প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন, স্বেদগ্রন্থির কার্যকারিতা থার্মোথেরাপির ফলে বাড়ে ও ঘামের নিঃসরণও বাড়ে। ফলে শরীর থেকে অনেক রেচন পদার্থ ও ময়লা নির্গত হয়ে যায়, শরীর ঠান্ডা হয়। নিয়ন্ত্রিত তাপ প্রয়োগ করলে টেন্ডন, লিগামেন্ট ও জয়েন্ট ক্যাপসুলের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে, শরীরের বিভিন্ন সন্ধিস্থলের স্টিফনেস কমে, যন্ত্রণা দূর হয়। কোনও সন্ধিস্থল যদি ৫ থেকে ১০ মিনিট, ৪০-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় রাখা হয়, তবে সর্বাপেক্ষা ভালো ফল পাওয়া যায়।

তবে মনে রাখা প্রয়োজন, থার্মোথেরাপি কোন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা বিজ্ঞানের শাখা নয়। তাই এই নিয়ে বিতর্কও কম নেই। শরীরে কোনও ক্ষতস্থান থাকলে, সেখান থেকে রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। কখনও কখনও শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালনের ফলে, সেখানকার ছোট ছোট শিরা-উপশিরা ফেটে গিয়ে রক্ত ক্ষরিত হয়। একে ইংরেজিতে ‘ইন্টার্নাল হেমারেজ’ বলে। ফলে সেই অঙ্গ নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং শরীরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যেটি তাহল, যাদের শরীরে ক্যানসার কোষ আছে, তাদের তাপ থেরাপি গ্রহণ করা মোটেই সমীচীন নয়। কারণ ওই কোষগুলির মধ্যে অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালনের ফলে সেখানে খাবার, অক্সিজেন, হরমোন ইত্যাদি বেশি বেশি করে পৌঁছায়। ফলে আরও দ্রুত কোষ বিভাজন হয় ও ক্যানসার দ্রুত শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে পরে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৭: হিন্দু-মুসলিম মিশ্র দেবতা সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’

তাপ থেরাপির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হল তাপ বিকিরণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চোখের মতো অত্যন্ত সংবেদী অঙ্গে প্রয়োগ করা উচিত নয়। তার ফলে রেটিনা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ও সেই মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারায়। গর্ভবতী মহিলাদের শরীরে এই থেরাপি প্রয়োগ নিষিদ্ধ। কারণ তার ফলে, তার গর্ভে অবস্থিত ভ্রূণের মৃত্যুও হতে পারে। হৃদরোগীর ক্ষেত্রে এই থেরাপি প্রয়োগ করা উচিত নয়। এছাড়াও বিভিন্ন রোগীর ত্বকের সংবেদনশীলতা বেশি হওয়ার জন্য সামান্য তাপের হেরফেরে তার ত্বকে ফোসকা পড়তে পারে এবং তার শরীরে প্রোটিন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ভ্যা সোডায়ালেশনের ফলে কিছু ক্ষেত্রে রোগীর মস্তিষ্কে কম রক্ত যায়, তাই এই থেরাপি চলাকালীন সে জ্ঞান হারাতে পারে।

তাই সামান্য সর্তকতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি, যেমন এই থেরাপি সময় সমস্ত অলংকার এবং ধাতব বস্তু পরিধান করা উচিত নয়। যে জায়গাটিতে তাপ প্রয়োগ করা হবে, সেই জায়গাটি ভালো করে আবৃত করার প্রয়োজন। রোগীর ক্যানসারের মতো বিশেষ রোগ আছে কিনা, সে গর্ভবতী কিনা, তার শরীরে কোন স্থানে ক্ষত আছে কিনা ইত্যাদি ব্যাপারে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে তবেই এই থেরাপি প্রয়োগ করা যেতে পারে। যাদের ফেন্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদেরকে নরম বিছানার মধ্যে এই থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। এইরকম বেশ কিছু বিশেষ অবস্থা ব্যতীত, থার্মোথেরাপি আমাদের দেহের সার্বিক উপকারীই করে থাকে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content