শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সুখ হল একটি মানসিক অনুভূতি, যা মূলত ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। মানসিক, জৈবিক, ধার্মিক ও দর্শনভিত্তিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুখের সংজ্ঞা ভিন্ন। তাই সুখ হল একটি আপেক্ষিক অনুভূতি। ধনী ব্যক্তিই সুখী হবে তা নয়, সুখ লাভ করা যায় ছোট কুটির থেকেও। সনাতন ভারতে আনন্দ এবং সুখ লাভের জন্যই মুনি-ঋষিরা সংসার ত্যাগ করে জঙ্গলের ছোট্ট কুটিরে বাস করতেন।

বর্তমানের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন সুখ বিশেষ কোন বস্তুর হাত ধরে আসে না। এর বিভিন্ন কারণ আছে। যেমন, তা হতে পারে খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা, নিজের প্রিয়জনের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করা বা অকারণ উল্লাস ইত্যাদি যা মানুষকে সুখী করে, তার জন্য শরীরের মধ্যে রয়েছে নানান জৈব রাসায়নিক পদার্থ। সেই জৈব রাসায়নিক পদার্থগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল সেরোটোনিন, ডোপামিন, এনডরফিন, অক্সিটোসিন ইত্যাদি। এছাড়াও কেউ কেউ ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনকেও এই গোত্রের মধ্যে ফেলছেন।
‘সুখের হরমোন’ সেরোটোনিন আমাদের মন ভালো রাখতে ও তাকে উজ্জিবিত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও আমাদের খাদ্য হজম করা, সঠিক মাত্রায় নিদ্রা ও মস্তিষ্কের কার্যাবলীকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, তবে অন্যতম আমাদের সারকাডিয়ান ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করতে সেরোটোনিনের জুড়ি নেই। এই হরমোন নিউরোট্রান্সমিটার হিসাবেও কাজ করে, অর্থাৎ দুটি নিউরনের সংযোগস্থলে অবস্থান করে এক নিউরনের স্নায়ুবিক বার্তাকে অন্য নিউরনে পৌঁছতে সাহায্য করে। আনন্দঘন পরিস্থিতিতে সেরোটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং আমাদের মানসিক ও শারীরিক কাজকর্মগুলোকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

হতাশা এবং দুঃখের কারণে এই হরমোনের পরিমাণ শরীর তথা রক্তে কমে যায়। ফলে মনে আনন্দ কমে, শরীরের নানান সমস্যা দেখা যায়। আমাদের শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ সেরোটোনিন উৎপন্ন হয়ে থাকে আমাদের পাকনালী ও অনুচক্রিকা থেকে। তাছাড়াও মস্তিষ্ক কোশ থেকেও এই পদার্থটি নির্গত হয়ে থাকে। আমাদের পাকনালীর মধ্যে অবস্থিত নানান ব্যাকটেরিয়া, যেগুলি আমাদের শরীরে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে থাকে, সেই অণুজীবরা এই নিউরোট্রান্সমিটার উৎপাদনে কিছুটা উদ্দীপকের ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই আমরা আমাদের খাদ্যাভাসের মধ্যে যদি প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার, যথা: দই, ইয়োগার্ট ইত্যাদি গ্রহণ করে থাকি, তাহলে আমাদের এই ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। তার ফলে কেবল সেরাটোনিন নয়, আমাদের অন্যান্য সুখের হরমোন উৎপাদনেও সাহায্য করে।
আরও পড়ুন:

জীবন বিজ্ঞানের মহীরূহ গোবিন্দকিশোর মান্না

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৯: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-ইতিহাস

‘আনন্দ হরমোন’ ডোপামিন আমাদের মোটিভেট করতে, স্নায়বিক কাজকর্মকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ ও বৌধাঙ্ককে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। স্মৃতিশক্তিকে বাড়াতে, ভালোবাসা, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এই ডোপামিন। সুখাদ্যগ্রহণ, আনন্দে থাকা এবং সেক্স ও ভালোবাসার সময় এই ডোপামিনের পরিমাণ শরীরে বৃদ্ধি পায়। এটি নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবেও কাজ করে। ফুড সাপ্লিমেন্ট হিসাবে আমরা যদি টাইরোসিনযুক্ত খাবার গ্রহণ করে থাকি, তাহলে শরীরে ডোপামিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কাজ শেষে প্রশংসা ও পুরস্কার আমাদের শরীরে ডোপামিন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। গ্রিন-টি এবং গুড ব্যাকটেরিয়াযুক্ত খাবার খেলে শরীরে এই ফিল গুড হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় বলে, বিজ্ঞানীরা গবেষণায় জানিয়েছেন।

এনডরফিন বেদনানাশক এবং দেহের স্বাভাবিক মরফিন রূপে কাজ করে। যখন পেইনকিলার আবিষ্কৃত হয় নাই, তখন শরীরের ব্যথা, বেদনা ও যন্ত্রণা উপশম করত এই এনডরফিন। এখনও শরীরে ইহা একই কাজ করে যায়, তবে মানুষ তাৎক্ষণিক অনুভূতি গ্রহণ করার জন্যই, অকারণে পেইনকিলার গ্রহণ করে থাকে। এই হরমোন তথা নিউরোসিগনালিং পদার্থটি ব্যথা, বেদনার অনুভূতিকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র যেতে বাধা প্রদান করে থাকে। শরীরচর্চা, ব্যায়াম ও খেলাধুলার পর সাধারণত এনডরফিনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। হতাশা এবং দুঃখজনক পরিস্থিতিতে এই হরমোনের ক্ষরণ হাস পায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৪: কাতরা কাতরা মিলতি হ্যায়…

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৫: রবি ঠাকুরের বড় মেয়ে— যিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন!

অক্সিটোসিন হলো ‘লাভ হরমোন’। চুম্বন, পরে, ভালোবাসা, রোমান্স ও সেক্সের সন্তুষ্টির ফলে এই ধরনের হরমোনের ক্ষরণ রক্তে বৃদ্ধি পায়। মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর জন্ম, মাতৃদুগ্ধ উৎপাদন এবং বাৎসল্য রসের জন্য এই হরমোন খুবই জরুরি। সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস, সহানুভূতি এবং দৃঢ় বন্ধনের জন্য অক্সিটোসিনের প্রয়োজনীয়তা খুবই বেশি। তবে এই প্রকার হরমোন, ছেলেদের থেকে মেয়েদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে অধিক।

বর্তমানে বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে এই প্রকার হরমোন কেবল ভালোবাসার হরমোন নয়, মানসিক চাপ, উদ্বেগ কাটাতে এবং দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও এই হরমোন বিশেষ কার্যকরী। স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত রাখতে অক্সিটোসিন বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৭: শ্যামাসুন্দরী দেবীর লোকান্তর গমন

মেয়েদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনও হ্যাপি হরমোন হিসেবে কাজ করে। ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন যে মেয়েদের মানসিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন তার প্রমান হলো, মেনোপজের পর এই দুই প্রকার হরমোনের পরিমাণ কমে যাওয়া। তার ফলে মেয়েদের হতাশা, মানসিক উদ্বেগ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।

সুখের হরমোনগুলি আমাদেরকে সুখে রাখতে সাহায্য করে ঠিকই কিন্তু তাদের পরিমাণকে স্বাভাবিক রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। তার জন্য আমাদের সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে, নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে, বন্ধুবান্ধব ও ভালোবাসায় মানুষের সাথে সময় অতিবাহিত করতে হবে। জাঙ্ক ফুড, ফাস্টফুড ত্যাগ করে ফাইবারযুক্ত খাবার, পুষ্টিকর খাবার, প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়টিক খাদ্যগ্রহণ করতে হবে। যা পেটের মধ্যে ভালো অনুজীবগুলির সংখ্যা বাড়াবে। মনের আনন্দে জীবন কাটান, ইচ্ছামত ড্রাইভ করুন, নিজেই পার্টনারের সঙ্গে লং ড্রাইভে যান, বাড়িতে সবাইকে আনন্দ দেওয়ার জন্য এবং নিজেও আনন্দে থাকার জন্য রান্না করুন এবং সকলকে তাদের প্রিয় ডিশ পরিবেশন করুন।

গ্রিন-টি পান করলে ডোপামিন এবং সেরোটোনিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সর্বাপেক্ষা জরুরি নির্লোভ, সাধারণ জীবনযাপনকরা ও ভারতীয় সনাতন পদ্ধতিতে নিয়মিত মেডিটেশন বা ধ্যানের অভ্যাস করা। প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটালে এবং পাখপাখালির গান শুনলে শুধু সুখী হরমোন নয়, শরীরের সব ধরনের হরমোনের পরিমাণও স্বাভাবিক থাকে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content