শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সত্যিই কি গাছে থেকে মাংস হয়? ছবি: সংগৃহীত।

গৌতম বুদ্ধ, গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথের দেশ এই ভারত। এই দেশে ‘শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন’। ভারত কোনওদিন পৃথিবীর অন্য কোন দেশ আক্রমণ করেনি বা হিংসা ছড়ায়নি। অহিংসার মন্ত্রে দীক্ষিত এই দেশ। বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ব্যতীত সমগ্র ভারত আজও পঞ্চশীল নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভাসে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। নিরামিষের পরিবর্তে আমিষ খাবারের দিকে মানুষের ঝোঁক বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন কোন মানুষের খাদ্যতালিকায় যুক্ত হয়েছে ডিম, মাছ ও মাংসের মতো খাদ্যের।
লোভীর বশীভূত মানুষ বর্তমানে নির্বিচারে পশুহত্যা করছে, তা সে গৃহপালিতই হোক বা গবাদিপশুই হোক। বিগত বেশ কিছু বছর থেকেই মানুষের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে কিন্তু বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, পশুপ্রেমী প্রতিষ্ঠান এবং অহিংস ধর্মে বিশ্বাসী মানুষরাও পশুহত্যা বন্ধে চাপ বৃদ্ধি করছে। তারা বরাবর মাংসের পরিবর্তে সয়াবিন, এঁচোড় ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ খাদ্যকে মাংসের বিকল্প খাদ্য হিসেবে খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু মাংসের পরিবর্তে এই ধরনের খাবার ভোজনরসিক মানুষের কাছে নাপছন্দ। এমনই এক পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে তৈরি করে ফেলেছেন গ্রিন মিট বা সবুজ মাংস। অনেক ক্ষেত্রে একে বলা হচ্ছে, ক্লিনমিট। ভারতীয়রা বলছেন, অহিংস মাংস।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫০: স্বপ্নের ‘যাত্রা হলো শুরু’

সব লেখাই বিজ্ঞানের: বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাতি শিবতোষ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন প্রাণিবিদ্যার বাঘ

বিখ্যাত লেখক পল স্যা পপিরোর বেস্টসেলিং বই ‘ক্লিন মিট’-এ ব্যাপারে বিশদ আলোকপাত করেছেন। বিশ্বের ইতিহাস বলছে অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ পশুকেও গৃহপালিত করেছে নিজের প্রয়োজন মেটাতে। কিন্তু সুযোগ বুঝে তাকে হত্যা করতেও সে পিছপা হয়নি। ভারত, আমেরিকা-সহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে এই নতুন ধরনের পরীক্ষাগার লব্ধ মাংসের ওপর নানান আলোচনা করছে। কীভাবে তৈরি হয় এই মাংস? বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোন প্রাণীর একটি মাত্র কোষ থেকেই সেল কালচার বা কোশ কর্ষণ পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে এই মাংস তৈরি করা যায়। তারা গবেষণাগারে যে মাংস তৈরি করেন, তার স্বাদ হত্যা করা প্রাণীর মাংস থেকে কোনও অংশে কম নয়। পরিবর্তে প্রাণী হত্যা ব্যাপক বন্ধ করা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৯: আহা, মরি—কেটেলবেরি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

পরিবেশের দিক থেকে ভাবলে দেখা গিয়েছে, ২০১০ সালের হিসাবে কৃষিজ উৎপাদন থেকে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়, কেবলমাত্র গবাদি পশুর জাবর কাটা থেকেই তার অর্ধেক পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়। তাই ক্লিন মিট বাজারে এলে মোট ৪ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা। অর্থাৎ প্রায় ৪৬ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন বন্ধ হয়ে যাবে। যা বিশ্ব উষ্ণায়নের যে মারাত্মক সমস্যা তা অনেকাংশে বন্ধ করবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মানেকা গান্ধীর পৌরহিত্যে গ্রিন মিট নিয়ে নানান আলোচনা হয় এবং বিভিন্ন স্থানে সচেতনতা শিবির চলছে। একটি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মাত্র এক কেজি মটন উৎপন্ন করতে প্রায় ৮০০০ লিটার জলের প্রয়োজন, অর্থাৎ প্রাণীটি প্রায় ৮ হাজার লিটার জল পান করে। এতে একসঙ্গে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন যেমন কমবে, সেই সঙ্গে ব্যাপক জল অপচয় বন্ধ হবে। জল সংকট ভারতে একটি তীব্র আকার ধারণ করছে। ক্রমাগত মাটির তলায় ভৌম জল নেমে যাচ্ছে, বিভিন্ন নদীর জল ও অন্যান্য জলাশয়ের জলও হ্রাস পাচ্ছে।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৯: হিমসিম খাও কেন এসো বোসো আহা রে! / খাওয়াব এমন খাওয়া এগ কয় যাহারে

বিল গেটস এবং রিচার্ডসনের মত ধনকুবেররা কেবলমাত্র লাভের জন্য নয়, ধরিত্রীকে গভীর অসুখ থেকে মুক্ত করতে ব্যাপক পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছেন। এই মাংস উৎপন্ন করতে ‘ফনালিতিকস’-এর মতো অসংখ্য অলাভজনক সংস্থা সমগ্র পৃথিবীতে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। মাংসের মধ্যে চর্বির পরিমাণকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যা হৃদরোগ এবং ডায়াটিসের মতো নানান সমস্যা দূর করতে সাহায্য করবে বলে চিকিৎসকরা আশ্বস্ত করছেন। মডার্ন মিডো, মোজ মিট, সুপারমিট, মেম্ফিস মিট-সহ একাধিক বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে ইতিমধ্যে এই ধরনের মাংস উৎপাদনে নেমে পড়েছে।

আমরা জানি, ভারত এখন বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে ১০০তম স্থানে রয়েছে। তাই প্রয়োজন ব্যাপক খাদ্যের যোগান। এই মুহূর্তে সমগ্র ভারত ব্যাপকহারে এই ধরনের মাংসের প্রচলন হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মুখে কিছুটা হলেও প্রোটিন জাতীয় খাবার উঠবে। আফ্রিকার ন্যায় ভারতেও অপুষ্টিজনিত সমস্যায় অনেক শিশুমৃত্যু এবং প্রসূতির মৃত্যু ঘটে। পরীক্ষাগারলব্ধ মাংস অনেকাংশে এই সমস্যা দূর করবে বলে আশা করা যায়।

আমাদের দেশে আরেকটি সমস্যা হল, মানুষ কী ধরনের মাংস গ্রহণ করবে তা নিয়ে। গ্রিন মিট জাতীয় খাবার শুরু হলে জাতিহিংসা এবং খাদ্যজনিত কারণে দাঙ্গাঘটিত মানুষ মৃত্যু রোধ হবে বলে আশা করা যায়। সব কিছু বিচার করলে দেখা যায়—কেবল পরিবেশ নয়, মানব স্বার্থও রক্ষিত হবে এই ধরণের অহিংস মাংসে। তাই সময় এসেছে, এ বার মনে ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়ে ক্লিন মিট আসুক ভারতের প্রতিটি প্রান্তে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content