বিজ্ঞানী নিরজনাথ দাশগুপ্ত।
জীবনবিজ্ঞানের সঙ্গে ভৌতবিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে যে ক’জন ভারতীয় বিজ্ঞানী প্রচেষ্টা করেছিলেন, নীরজনাথ দাশগুপ্ত তাঁদেরই অন্যতম। তাই ভারতীয় জৈবপদার্থবিজ্ঞানের ভগীরথ তিনিই। ভৌতবিজ্ঞানের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও তার জটিল কার্যাবলীকে কীভাবে মানবশরীরের রহস্য উন্মোচনে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে তিনি সারাটা জীবন ভেবেছেন ও সর্বতোভাবে তার প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। সদ্য আবিষ্কৃত ইলেকট্রনমাইক্রোস্কোপের জটিল কার্যাবলীকে সঠিকভাবে অনুধ্যােন করার জন্য তিনি ছুটে যান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে তার কার্যাবলী বুঝে এসে তিনি শুধুমাত্র ভারত নয়, সমগ্র এশিয়ার মধ্যে প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, কলকাতায় সংস্থাপন করার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
তুখোড় বুদ্ধিসম্পন্ন এই বিজ্ঞানী ১৯০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা গঙ্গাচরণ দাশগুপ্ত একজন নামকরা পদার্থবিদ ছিলেন, পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের প্রধান হয়েছিলেন। সুতরাং এক শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালে, কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। ভর্তি হন বাংলার শিক্ষার পীঠস্থান প্রেসিডেন্সি কলেজে, সেখান থেকে ১৯২৯ সালে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি পাশ করেন এবং ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৩১ সালে এমএসসি পাশ করেন, স্থান হয় প্রথম বিভাগের প্রথম।
আরও পড়ুন:
ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে থার্মোথেরাপি
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৪: বরাকপারের কথা
অত্যন্ত কৃতী ছাত্র হিসাবে তিনি পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করতে যান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৩৮ সালে তিনি সেখান থেকে ডক্টরেট হন। তেজস্ক্রিয় মৌল কিভাবে মানব শরীরে রোগ নির্ণয় করে এবং তা নিরাময়ে সাহায্য করে, এই নিয়ে তিনি তাঁর মৌলিক গবেষণা করেছিলেন। লিউকোমিয়া বা ব্লাড ক্যানসারের ক্ষেত্রে মানুষের শরীরে অবস্থিত শ্বেতরক্ত কণিকার আয়ুষ্কাল কত, তা নির্ধারণে ব্রতী হয়েছিলেন। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোমের গঠন পর্যালোচনা করা, কালাজ্বরের পরজীবীর বহির্গঠন ও মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রীর বাহ্যিকগঠন নিয়ে তিনি বিস্তর গবেষণা করেছেন। মানব শরীরের রোগ সৃষ্টিকারী কিছু কিছু ভাইরাসের জেনেটিক গঠন নির্ণয় করা, হিমোগ্লোবিন অনুর গঠন পর্যালোচনা করা এবং বিভিন্ন ওষুধের অনুর সাথে দেহজ প্রোটিনের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ওপর তিনি নানান পরীক্ষা করেছেন।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২৫: মা-বাবার বয়স বাড়ছে, এই সময় পড়ে গেলে বড় বিপদ ঘটতে পারে, সুরক্ষার প্রয়োজনে মানতে হবে কিছু নিয়ম/১
ভারত তথা কলকাতায় ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আনতে প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন মেঘনাথ সাহা ও তাঁর প্রিয় ছাত্র নিরজনাথ। ১৯৪৫ সালে যন্ত্রটির খুটিনাটি বিষয় বোঝার জন্য নীরজনাথ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, সেখানে অধ্যাপক মার্টনের কাছে তিনি ট্রেনিং নেন। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পরের বছরই, তিনি সমগ্র এশিয়ার মধ্যে প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ কলকাতায় নিয়ে আসেন ও তা দিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি গভীরভাবে গবেষণাকার্য শুরু করেন। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে করা নানা গবেষণা ইংল্যান্ডের রয়েল সোসাইটি প্রসিডিংস-এ প্রকাশিত হয়।
সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবপদার্থবিদ্যা পড়ানো শুরু করেন, তার জন্য সমস্ত পাঠ্যক্রম তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি তৈরি করেন ‘ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’। তিনি সেই সোসাইটির ফাউন্ডার প্রেসিডেন্টও ছিলেন। ভারতে প্রতিষ্ঠিত ‘ফিজিক্যাল সোসাইটি’র জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। ‘আলট্রা মাইক্রোস্কোপি’ নামক জার্নালের সম্পাদকীয় মন্ডলীর তিনি অন্যতম ছিলেন। তিনি ‘ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি ইন লাইফ সায়েন্স’ নামে একটি বইয়ের পরিমার্জনা করেন। ‘ইন্ডিয়ান ন্যা শনাল সায়েন্স অ্যাক্যাডেমি’র সেবা করেছেন সারা জীবন। ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ সোসাইটিস অফ ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি’ এবং ‘আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি’ এবং ‘ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্স’-এর এক্সিকিউটিভ কমিটি সদস্য ছিলেন।
সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবপদার্থবিদ্যা পড়ানো শুরু করেন, তার জন্য সমস্ত পাঠ্যক্রম তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি তৈরি করেন ‘ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’। তিনি সেই সোসাইটির ফাউন্ডার প্রেসিডেন্টও ছিলেন। ভারতে প্রতিষ্ঠিত ‘ফিজিক্যাল সোসাইটি’র জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। ‘আলট্রা মাইক্রোস্কোপি’ নামক জার্নালের সম্পাদকীয় মন্ডলীর তিনি অন্যতম ছিলেন। তিনি ‘ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি ইন লাইফ সায়েন্স’ নামে একটি বইয়ের পরিমার্জনা করেন। ‘ইন্ডিয়ান ন্যা শনাল সায়েন্স অ্যাক্যাডেমি’র সেবা করেছেন সারা জীবন। ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ সোসাইটিস অফ ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি’ এবং ‘আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি’ এবং ‘ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্স’-এর এক্সিকিউটিভ কমিটি সদস্য ছিলেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: স্বপ্নে আমার মনে হল
বহুধা কাজকর্মের সঙ্গে যেমন তিনি যুক্ত ছিলেন, তেমনি নানান সম্মান তাঁর জীবনে এসেছে। কিন্তু স্বারস্বত সাধনায়ব্রতী এই মহান বিজ্ঞানীকে অহংবোধ কখনও স্পর্শ করেনি। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স’ এর তরফ থেকে তাঁকে মহেন্দ্রলাল সরকার রিসার্চ গোল্ড মেডেল প্রদান করে, সাল ১৯৫০। ১৯৬৫ সালে পান ‘ক্যাপ্টেন এনএন দত্ত স্মৃতি পুরস্কার’, এটি প্রদান করে ‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’। চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল তাঁকে ডক্টর সুবোধ মিত্র স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত করেন।
১৯৯১ সালে, আইএনএসএ তাঁকে জিএন রামাচন্দ্রন ৬০তম জন্মজয়ন্তীতে স্মারক পদক প্রদান করে। সম্পূর্ণরূপে নিরোগ এই মানুষটি ৯০ বছর বয়সে, স্বল্পরোগ ভোগের পর, ১৯৯৯ সালে দেহরক্ষা করেন। স্নেহপ্রবণ, ছাত্রদরদী এই মাস্টারমশাইকে সকল ছাত্ররা যেমন মনে রাখবে, বিজ্ঞানের নতুন এক শাখার প্রবর্তক ও বিজ্ঞানসেবকরূপে সমগ্র ভারত তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে।
১৯৯১ সালে, আইএনএসএ তাঁকে জিএন রামাচন্দ্রন ৬০তম জন্মজয়ন্তীতে স্মারক পদক প্রদান করে। সম্পূর্ণরূপে নিরোগ এই মানুষটি ৯০ বছর বয়সে, স্বল্পরোগ ভোগের পর, ১৯৯৯ সালে দেহরক্ষা করেন। স্নেহপ্রবণ, ছাত্রদরদী এই মাস্টারমশাইকে সকল ছাত্ররা যেমন মনে রাখবে, বিজ্ঞানের নতুন এক শাখার প্রবর্তক ও বিজ্ঞানসেবকরূপে সমগ্র ভারত তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।