শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

লোগোথেরাপি শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। ‘লোগোস’ এর অর্থ মানে, ‘থেরাপি’ অর্থ চিকিৎসা পদ্ধতি। বৃহত্তর অর্থে জীবনের অর্থ বা বেঁচে থাকার মানে খুঁজতে শেখায় এই থেরাপি। ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’, জীবন যখন অর্থহীন হয়ে পড়ে তখনই লোগোথেরাপি নতুনভাবে বাঁচার মন্ত্র শেখায়।

ভিক্টর ফ্রাঙ্কেল ছিলেন একজন মনোরোগ ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁকে ‘নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এই সময়টা জীবনের চরম দুর্বিসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর এই দুঃসময়ের অভিজ্ঞতা এবং সুসময়ের সুখোপলব্ধি তাঁকে লোগোথেরাপি লিখতে সাহায্য করেছিল। বন্দিদশা থেকে মুক্তির পর আবারও স্নায়ুরোগ এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবেই কাজ শুরু করেন। তার সঙ্গে তিনি মানুষের মধ্যে নব আবিষ্কৃত এই থেরাপি নিয়েও প্রচার এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। মানুষের মধ্যে নেশা, ব্যথা, বেদনা, হতাশা, দুশ্চিন্তা, ট্রমা, পোস্ট ট্রমাটিক অবস্থা, শ্লীলতাহানিজনিত কারণে মানষিক অবসাদ ইত্যাদি কাটানোর ক্ষেত্রে তিনি এই থেরাপি ব্যবহার করতে থাকেন। এই থেরাপিতে প্রত্যেকটা রোগীকে ব্যাখ্যা করা হয় এবং তার জীবনের অনাবিস্কৃত সত্য ও সম্ভাবনাকে দেখানো হয়। এতে জীবন সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠে এরা।
লোগোথেরাপির তিনটি প্রধান ধারণা হল—ইচ্ছার স্বাধীনতা, ইচ্ছার অর্থ এবং জীবনের অর্থ। এই থেরাপিকে অনেকে ফ্রাঙ্কলিয়ান ফিলোজফি বলে থাকেন। এই দর্শন অনুসারে মনে করা হয়, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে একটি নিজস্ব অন্তরমুখী অঞ্চল আছে। প্রত্যেক মানুষের তাই প্রাথমিক ইচ্ছা হল, নিজের অন্তরকে উদ্ভাসিত করা এবং তাদের কাছে জীবনের অর্থ হল পূর্ণতা ও আনন্দ খোঁজার চেষ্টা। ভিক্টর ফ্রাঙ্কলে বললেন জীবনের অর্থ প্রধানত তিন ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমত, নতুন কোন কর্মের মধ্য দিয়ে, যেটাকে সে ভালোবাসে। দ্বিতীয়ত, কাউকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, যাকে সে ভালোবাসে। তৃতীয়ত, অপ্রত্যাশিত কোন অবস্থার মোকাবিলার মানসিকতা তৈরির মধ্য দিয়ে।

ফ্রাঙ্কলে মনে করতেন—দুঃখ, কষ্ট, দূর্ভোগ এগুলি জীবনেরই অংশ, যা জীবনকে নতুন আঙ্গিকে চিনতে শেখায়। সুতরাং ব্যর্থতা জীবনের একটা অংশ হিসাবে তিনি গণ্য করেন। লোগোথেরাপির মূল কথা হল, প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করা। প্রশংসা এবং নিন্দাকে সমানভাবে গ্রহণ করতে পারলে, আমাদের জীবনের স্থিতিস্থাপকতা এবং সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। একা কোনও ব্যক্তিকে যেমন লোগোথেরাপির মাধ্যমে সুস্থ করা যায়, ঠিক তেমন ভাবেই গ্রুপ থেরাপিও প্রচলিত আছে। এতে একই সমস্যা সম্পন্ন বিভিন্ন ব্যক্তি অথবা একই ফ্যামিলির একাধিক সদস্যদের একত্রিত করে এই থেরাপি দেওয়া হয়, তার ফলে সামগ্রিকভাবে তাদের অবস্থার উন্নতি হতে দেখা গিয়েছে।

লোগো থেরাপির তিনটি প্রধান পদ্ধতি হল—ডেরিফ্লেকশন বা বিচ্যুতি, প্যারাডক্সিয়াল বা আপাতবিরোধী উদ্দেশ্য এবং সক্রেটিক ডায়লগ। ডেরিফ্লেকশন বা বিচ্যুতি এই পদ্ধতির মাধ্যমে কোন হতাশাগ্রস্থ বা ভীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা হয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেক্সচুয়াল ডিসঅর্ডার বা যৌন রোগীদের ক্ষেত্রেও। কোনও ব্যক্তিকে যদি তার আত্মহত্যার করার পূর্ব মুহূর্তে তার মনকে ভিন্ন দিকে চালিত করা হয়, তাহলে অনেক সময় সে আত্মহত্যা করে না। তার মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটে।
আরও পড়ুন:

বিপন্ন বাংলার রাজ্যপশু বাঘরোল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা

প্যারাডক্সিয়াল বা আপাতবিরোধী পদ্ধতি—কোনও রোগী যে অবস্থায় আছে তার ঠিক বিপরীত অবস্থায় তাকে চালিত করার পদ্ধতি হল প্যারাডক্সিয়াল পদ্ধতি। ধরা যাক, কোন একটি পরিবার বা কোন একজন রোগী গুরুগম্ভীর পরিবেশের মধ্যে রয়েছে, তার মনও ভারাক্রান্ত, ঠিক তখন যদি হাসিঠাট্টা বা মজার মাধ্যমে পরিবেশকে লঘু করার যায়, তাহলে রোগীর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটতে পারে।

সক্রেটিক ডায়লগ হল—অস্বাভাবিক কোনও ব্যক্তি যখন বিভিন্ন ধরনের আপাতত মূল্যহীন কথাবার্তা বলে থাকে, তখন তার মধ্য থেকে সঠিক অর্থ খুঁজে বের করা এবং তার আচরণ ও চালচলন থেকে তার প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করা। আর সেই মতো তার চিকিৎসা করাই হল সক্রেটিক ডায়লগের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেখান থেকে তার পজেটিভ দিক খুঁজে বের করা এবং রোগীর আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা হয়।

ভিক্টর ফ্রাঙ্কলের মত অনুসায়ী, পৃথিবীতে তিন ধরনের মানুষ আছেন। প্রথম ধরনের মানুষ আধ্যাত্মিকতা ও শান্তির মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পান। দ্বিতীয় দল মানুষ অসম্ভব চাপ এবং পার্থিব ভোগ ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেন। আর তৃতীয় একদল মানুষ আছেন যারা হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকলেও আত্মদাম্ভিকতা প্রচুর।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৯: নিরুপমা দেবী— তাঁকে নিয়েই গল্প হোক!

ফ্রাঙ্কলে বেশ কয়েকটি বই লিখে তাঁর আবিষ্কৃত তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তিনি লেখেন ‘ম্যা নস সার্চ ফর মিনিং’ ১৯৪৬; ‘দি উইল টু মিনিং: ফাউন্ডেশনস এন্ড এপ্লিকেশন অফ লোগোথেরাপি’ এবং শেষ বই ‘ম্যা নস সার্চ ফর আল্টিমেট মিনিং (১৯৯৭)’। তিনি ধর্ম এবং মনস্তত্ত্বকে একসঙ্গে মিশিয়ে নতুন এই থেরাপির জন্ম দেন এবং তা মানুষের জীবন যাত্রার মানোনন্নয় এবং মানসিক বিকাশে বিশেষ সাহায্য করে। তার জন্যে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ‘আমেরিকান সাইকিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন’ তাঁকে ‘অস্কার ফিস্টার পুরস্কার’ প্রদান করেন।

লোগোথেরাপি নিউরোসিস সমাধানে, ডিপ্রেশন বা হতাশা দূরীকরণে, অবসেসিভ কম্পাসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি নিরাময় করতে এবং স্রিজোফ্রেনিয়া বা পাগলামির মতো অস্বাভাবিকতা প্রশমনে বিশেষ উপযোগী।

আজ সমগ্র বিশ্বে অগণিত লোগোথেরাপির প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং মানুষের মধ্যে এর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, বর্তমানে মানুষ নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত, বিপুল অর্থ থাকা সত্ত্বেও তাদের মনে শান্তি নেই। তখন এই থেরাপি তাদের মানসিকতার উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করছে। কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাদের মধ্যে একাকীত্বও হ্রাস পাচ্ছে।
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, একে অপরের সাথে সমন্বয় সাধন ক্ষমতা ইত্যাদিও বৃদ্ধি পায় এই থেরাপির মধ্য দিয়ে। এই থেরাপির আলোকময় দিকগুলি হল ঘৃণা নয ভালোবাসা, নিরাশা নয় আশা, দায়িত্ববোধ ও অন্তরের স্বাধীনতা এবং সৌন্দর্যপ্রীতি। এগুলি আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩২: দীক্ষার আংটি হেমলতাকে দিয়েছিলেন মহর্ষিদেব

লোগোথেরাপির সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত করা হচ্ছে সাইকোসোমাটিক এবং ফিজিওলজিক্যাল হেলথ বেনিফিটের। ৯০ এর দশক থেকে এইরকম বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও লেখালেখি চলছে। লোগোথেরাপিকে কেউ কেউ পজেটিভ সাইকোলজিও বলছেন। এই থেরাপির একজন অনুসরণকারী বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ইডিথ উইসকফ জোয়েলসন বলেছেন, অসুখী অবস্থা হল একপ্রকার ম্যা ল অ্যাডজাস্টমেন্টের রূপ। তাঁর কথায়, এই থেরাপি যাঁরা অনুসরণ করেন তাদের মধ্যে নেগেটিভ ভাইব্রেশন দূর হয়। প্লেন যাত্রীদের কষ্ট এবং একঘেয়েমি লাঘব করার জন্য বিভিন্ন এয়ারলাইন সংস্থায় এই থেরাপির ব্যবহার হচ্ছে। অতি সম্প্রতি ক্যানসার রোগীদের এই ট্রিটমেন্টের শামিল করা হচ্ছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আশ্চর্যজনক ফল মিলছে। সম্প্রতি এক কেস স্টাডিতে দেখা গিয়েছে, সারভাইকাল ক্যান্সারের রোগীদের এই থেরাপি প্রয়োগের ফলে কষ্ট এবং হতাশা অনেকাংশে দূর হয়েছে (সোয়িট্রিসনো ও মোওয়ার্ডি, ২০১৭)।

তবে সমালোচকদের মতে, এই থেরাপি হল মেটাথেরাপি, যা সিউডোসায়েন্সের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। সুতরাং এটি কতটা ভরসাযোগ্য, তাই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়ে গিয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ এবং কেস স্টাডি করে দেখা গিয়েছে এই থেরাপির এক আলোকময় দিক রয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, নতুন জেনারেশন এই থেরাপিকে ভালোভাবে গ্রহণ করছে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content