শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

আচ্ছা ধরুন যদি এমন হত, যে পাকেচক্রে আপনাকে তিনদিন এমন এক দ্বীপে কাটাতে হবে যেখানে আপনার কাছে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও উপায় থাকবে না, থাকবে না এমন কোনও বৈদ্যুতিক মাধ্যম যার মাধ্যমে আপনি বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন বা কথা বলতে পারেন, আপনার হাতের সামনে থাকবে না আপনার প্রিয় মুঠোফোনটি! নিশ্চয়ই ভাবতে পারছেন না এমন কোনও পরিস্থিতির কথা? তাহলেই ভাবুন এই একটি যন্ত্র কীভাবে রক্তমাংসের সচল মস্তিষ্কের মানুষদের একেবারে নিজের আয়ত্তে কবজা করে ফেলেছে। ফোন ছাড়া থাকার কথা তো ভাবতেও পারেন না, কিন্তু খবর রাখেন কি, এই ফোনের আদি ইতিবৃত্তের? জানেন কি, এই যে ফোনের ওপারে থাকা মানুষটিকে আপনি সম্বোধন করেন যে শব্দটি উচ্চারণ করে সেই ‘হ্যালো’ নামের বিশেষ তরঙ্গধ্বনি প্রাপ্ত শব্দটিকে? এহেন সম্বোধনের কাজে লাগানোর কারণটা আদতে কী? বা টেলিফোনের সুপরিচিত আবিষ্কারক গ্রাহাম বেলের সঙ্গে আর কারা তাঁদের অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন এই দিগ্বিজয়ী আবিষ্কারের পেছনে? আসুন আজ বরং কথা হোক আপনার জীবনের সেই প্রিয় জিনিসটিকে নিয়ে যেটা ছাড়া আপনার গোটা পৃথিবীটাই এই মুহূর্তে অচল।

গ্রাহাম বেল টেলিফোনের আবিষ্কর্তা, এই তথ্যটি তো সর্বজনবিদিত, কিন্তু এই ধারণার পাশাপাশি অনেকে এই ধারণাও পোষণ করে থাকেন যে গ্রাহাম বেলের প্রেমিকার নাম ছিল ‘হ্যালো’, আর সেই কারণেই তিনি নিজের প্রেমিকার প্রতি অমর অনুভূতির নিদর্শন স্থাপন করার উদ্দেশ্যে টেলিফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিটিকে সম্বোধন করার জন্য ‘হ্যালো’ শব্দটিকে ব্যবহার করা আরম্ভ করেন সম্বোধকের তরফ থেকে। এই ধারণা কিন্তু একেবারেই ভুল ধারণা। গ্রাহাম বেলের প্রেমিকার নাম ছিল গার্ডিনার হুবার্ড। হুবার্ডকেই গ্রাহাম বিয়ে করেছিলেন । ১৮৭৬ সালে টেলিফোন আবিষ্কারের ঠিক এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৮৭৭ সালের ১০ মার্চ গ্রাহাম তার সহকারীকে প্রথম ফোন করেন এবং সেই সময়ে তিনি সম্ভাষণের জন্য ব্যবহার করেছিলেন ‘আয়হই’ শব্দটি। হ্যাঁ হ্যালো নয়, ‘আয়হই’ হল পৃথিবীর প্রথম টেলিফোন সম্ভাষণের শব্দ। বেশ কয়েকদিন এই শব্দটির প্রচলন থাকলেও কাহিনির মোড় ঘোরে ১৮৭৭ সালের ১৮ জুলাই একেবারে অন্য এক মানুষের হাত ধরে, আর তিনি হলেন বৈদ্যুতিক আলোর আবিষ্কারক থমাস আলভা এডিসন। টেলিফোন যখন প্রথম আবিষ্কার হয় তখন তাতে কোনও রিং-এর ব্যবস্থা ছিল না। একপাশের টেলিফোন লাইনের সঙ্গে অপর পাশের টেলিফোন লাইন সবসময়ই সংযুক্ত করা থাকত, অর্থাৎ কল বিচ্ছিন্ন করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। প্রয়োজনে কথা হত দুইপ্রান্তে থাকা মানুষ দুটির মধ্যে। আর তখনই কথোপকথন আরম্ভ করার জন্য সেই সময়ে দেখা দিল সম্ভাষণের প্রয়োজনীয়তা। এরপরই ১৮৭৭-এর ১৮ জুলাই থমাস আলভা এডিসন ‘প্রিন্সিপাল অব রেকর্ডেড সাউন্ড’ আবিষ্কারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে যে শব্দটি প্রথম একাধিকবার উচ্চস্বরে ব্যবহার করেছিলেন, সেটি হল ‘হ্যালো’ আর এই শব্দটিই তিনি প্রথম তার উদ্ভাবিত ‘পেপার সিলিন্ডার ফনোগ্রাফ’ যন্ত্রে রেকর্ড করেন। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুযায়ী ‘হ্যালো’ শব্দটির ব্যবহার প্রথম লিপিবদ্ধ হয় ১৮৭২ সালে, অর্থাৎ প্রায় ২০০ বছর আগে। ২০০ বছরে পৃথিবীর ইতিহাস আমূল বদলে গেছে, বদলেছে পুরোনো অনেক অভ্যাস এবং বিশ্বাসও, কিন্তু ‘হ্যালো’র মায়া কাটিয়ে সম্ভাষণের জন্য অন্য কোনও শব্দকে মানুষ বেছে নিতে পারেনি, তাই তো আজও কেবল ফোনেই নয়
সামনাসামনিও কোনও মানুষকে প্রথম সম্বোধন করার জন্য বা অচেনা কোনও মানুষকে সম্বোধনের জন্যও আমরা ব্যবহার করে থাকি এই ‘হ্যালো’ শব্দটিকেই। অর্থাৎ এইটুকু পরিষ্কার কেবল আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল নন, টেলিফোন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক থমাস আলভা এডিসনের টেলিফোন সংক্রান্ত এই আবিষ্কারও যুগান্তকারী এক অধ্যায় তৈরি করে দিয়েছে টেলিফোনের ইতিহাসে।

এডিসনের পাশাপাশি আরও অনেক বৈজ্ঞানিকের অবদানও কিন্তু জুড়ে রয়েছে টেলিফোন আবিষ্কারের ইতিহাসের সঙ্গে। তাদের মধ্যে যে দুজনের নাম অবশ্য উল্লেখ্য সেই দুজন হলেন আন্তোনিও মুচি এবং আমোস ডলবেয়ার। এছাড়া চার্লস গ্রাফটন পেজ, চার্লস বোরসেউল, ইনোসেঞ্জো মানজোটির এবং বৈজ্ঞানিক এলিশা গ্রেও এই বিশিষ্ট উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমোস ডলবেয়ার শব্দতরঙ্গের আবিষ্কার এবং বৈদ্যুতিক আবেগকে কীভাবে বৈদ্যুতিক স্পার্কে পরিণত করা যায় সেই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

বেলের এই আবিষ্কারের ফলে হয়তো টেলিগ্রাফের চাহিদা কমে যাবে, এই আশঙ্কায় টেলিগ্রাফ কোম্পানির কেউই চাননি সহজে জনসাধারণের মধ্যে টেলিফোনের ব্যবহার আরম্ভ হোক। এমতাবস্থায় বেল তার এই বিশেষ আবিষ্কারটিকে প্রকাশ্যে সর্বসমক্ষে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন।এই প্রদর্শনীতে প্রথম টেলিফোন প্রদর্শন করেন ১৮৭৬ সালের ১০ মে আমেরিকান একাডেমি অফ সায়েন্স-এ ওস্টনে। কিন্তু তারপরেও টেলিগ্রাফ কোম্পানি বাজারে টেলিফোনের বাণিজ্যিকভাবে টেলিফোনের প্রচার করার ক্ষেত্রে কোনওরকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিল না। তখন বেল এবং থমাস উভয়েই টেলিগ্রাফের মাধ্যমে ১৩ কিলোমিটার দূরে ভয়েস প্রেরণ করতে সক্ষম হন এবং ওই বছরের শেষেই দূরত্ব ২২৯ কিলোমিটার অব্দি বাড়াতে সক্ষম হন। এরপর বাধ্যত বেল নিজের টেলিফোন কোম্পানি খোলার সিদ্ধান্ত নেন এবং বলাই বাহুল্য তার সিদ্ধান্তে কোনও ভুল ছিল না। বেল কর্তৃক স্থাপিত এই ঐতিহাসিক টেলিফোন কোম্পানি আজ AT&T নামে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত এবং বিখ্যাত।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে টেলিফোন পরিণত হয়েছে মুঠোফোনে, কেবল কথোপকথন নয় টেলিফোনের বিবর্তিত গবেষণার ইতিহাসের ধারাবাহিক অধ্যায়ে এর পারঙ্গমতার তালিকায় যুক্ত হয়েছে বিশ্বের যাবতীয় প্রগতিমূলক তথ্যের সম্ভার। ইন্টারনেট থেকে আরম্ভ করে ভার্চুয়াল জগতের প্রতিটি স্তরে মানুষ যুক্ত হতে পারছেন বিশ্বের যেকোনও জায়গার যেকোনও মানুষ, যেকোনও ইতিহাসের সঙ্গে। এই অসাধারণত্ব একদিনে সম্ভব হয়নি, প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস, একজন মানুষের আন্তরিক শ্রম ও তার সঙ্গে অনেক মানুষের সৎ ও আন্তরিক সাহচর্য এমন এক অনবদ্য আবিষ্কারকে পৃথিবীর সামনে এনে দিয়েছে যে আবিষ্কারের পাশাপাশি, সেই আবিষ্কারের পেছনে থাকা প্রতিটি খুঁটিনাটি কাহিনিও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে৷

 


Skip to content