রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


মেরি কুরি

‘প্রয়োজনীয়তাই আবিষ্কারের জন্মদাত্রী’। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ তার জীবনযাত্রাকে সহজ থেকে সহজতর করার লক্ষ্যে সদা সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে। আর সেই লক্ষ্য পূরণে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি বা আবিষ্কারের দিকে অগ্রসর হয়েছে মানুষ। কোনও কিছুর অভাব বা অপ্রাচুর্যতাবোধকে দূরীকরণে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে কিছু আবিষ্কারের মাধ্যমে ওই অভাববোধের শূন্যস্থান পূরণ করা হয়েছে যুগে যুগে। আবার অনেক সময় এমনও দেখা গিয়েছে, অনেক কিছুর অভাবের প্রেক্ষাপটে একটি আবিষ্কারের জন্ম হয়। কারণ যাই হোক না কেন, আবিষ্কারের এই ধারা নিরন্তর বহমান। কিন্তু এই আবিষ্কারই মানব সভ্যতার কাছে কখনও হয়ে দাঁড়িয়েছে আশীর্বাদ, কখনও বা অভিশাপ, আবার কখনও কখনও আবিষ্কারকের মৃত্যুর কারণ। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, আবিষ্কার আমাদের সভ্যতার রথচক্রকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আবিষ্কারককে তাঁর জীবন দিয়ে চুকিয়ে দিতে হয়েছে আবিষ্কারের মূল্য। আজ তেমনই একজন আবিষ্কারকের কথা বলব, যাঁর আবিষ্কার তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

মাদাম কুরির নাম জানে না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। তবে অনেকেই হয়তো এটা জানে না যে, আজও তাঁর ব্যবহৃত যেকোনও জিনিসপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাইলে জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে হতে পারে। গবেষণার কাজে ব্যবহৃত মেরি কুরির ডাইরি যদি কেউ দেখতে চান, তবে তাঁকে এমন একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হয়, যেখানে লেখা থাকে তার জীবন ঝুঁকিতে পড়লে সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।

তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি বিখ্যাত। তাঁর আবিষ্কারের মধ্যে পলোলিয়াম ও পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পৃথকীকরণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৮ সালে তিনি ও তাঁর স্বামী পলোলিয়াম আবিষ্কার করেন। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করার সময় খুব একটা সর্তকতা অবলম্বন করতেন না মেরি। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ লেগে থাকা টেস্টটিউব পকেটে নিয়ে সবসময় চলাফেরা করতেন। এই ভাবে প্রতিনিয়ত অসতর্কভাবে কাজ করতে করতে তিনি অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া নামক ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এই রোগটি আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে অতিমাত্রায় রক্তক্ষরণ ঘটায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। পলোলিয়াম আবিষ্কারের পরই মেরি কুরি এই রোগে আক্রান্ত হন। মেরি বলতেন —’জীবনে ভয়ের কিছু নেই যা আছে সবই অনুভবের’। এই আবিষ্কার যে তাঁকে প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরেও কখনও গবেষণার কাজে তিনি অবহেলা করেননি। তাই নির্ভয়ে তিনি শুধু অনুভব করে গেছেন বিজ্ঞান সাধনাকে।

১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর রাশিয়া বিভাজনের সময় পোল্যান্ডের ওয়ার্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন মেরি স্কলোডসকা কুরি। অধ্যাপক বাবা ও প্রধান শিক্ষিকা মা আর পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গে সর্বকনিষ্ঠ মেরি সব সময় পড়াশোনার আবহের মধ্যেই থাকতো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাঁর বাবা আয়োজন করতেন বিজ্ঞান ও সাহিত্যের আসরের। তাই বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসাটা শুরু হয়েছিল শৈশব থেকেই। মেরির বয়স যখন দশ, তাঁর মা যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই তাঁর বড় বোন মারা যান। পরপর দুই প্রিয়জনের মৃত্যুতে মেরি খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কালক্রমে মেরির বিবাহ হয় পিয়ের কুরির সঙ্গে। একদিকে বিজ্ঞানের নিরলস গবেষণা আরেকদিকে সুখের দাম্পত্য জীবন— ভালোই চলছিল সময়টা। কিন্তু ভাগ্য সঙ্গ দিল না বেশিদিন। একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় স্বামী পিয়েরের মৃত্যু হয় মাত্র এগারো বছরের বিবাহিত জীবন অতিবাহিত করার পর। এই মৃত্যু মেরিকে বিজ্ঞান সাধনার সঙ্গে আরও বেশি করে যুক্ত করে। মেরি তাঁর ভালোবাসাকে ধারণ করেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর অসমাপ্ত কাজ। বলা ভালো তাঁদের দুজনের বিজ্ঞান গবেষণার অসমাপ্ত কাজ।

পিয়ের কুরি ও মেরি কুরি

১৯১১ সালে প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে নোবেল পুরস্কার। তারপর দ্বিতীয়বার নোবেল পেলেন রসায়নে। তাঁর স্বামীর প্রতি ভালোবাসা উজাড় করে দিলেন মানবসেবায়। তেজস্ক্রিয়তাকে কীভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কাজে লাগানো যায় সেই চেষ্টা করলেন। সফলও হলেন। তাঁর অক্লান্ত নিরলস পরিশ্রম তাঁর এই গবেষণা এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি তাঁর আবিষ্কারকে কাজে লাগান। এই সময় মেরি বুঝতে পারেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে সার্জনদের সাহায্য করার জন্য যুদ্ধস্থলের কাছাকাছি ফিল্ড রেডিওলজিক্যাল সেন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন। রেডিওলজি অঙ্গসংস্থানবিদ্যা এবং স্বয়ংক্রিয় বলবিদ্যার উপর অধ্যয়নের পর তিনি এক্সরে যন্ত্র এবং ভ্রাম্যমাণ রেডিওগ্রাফির উন্নয়ন করেন। যেগুলো পরবর্তীতে ‘পেটিটস কুরিস’ নামে পরিচিত। তিনি তাঁর মেয়ে আইরিনের সহায়তায় কুড়িটি ভ্রাম্যমান হাসপাতালগুলোতে রেডিওলজিক্যাল ইউনিট পরিচালনা করেন। কিন্তু দিনরাত তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে কাজ করার ফল ভালো হল না মেরির পক্ষে। অচিরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই এই মহীয়সী বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়। তিনি শুধু একজন সফল বিজ্ঞানীই ছিলেন না, একাধারে একজন নিবেদিত স্ত্রী, একজন দায়িত্বশীল মা এবং একজন মানবদরদী ছিলেন। পিয়ের কুরির হাত ধরে যে তেজস্ক্রিয় ভালোবাসার সূচনা হয়েছিল তাঁর অন্তরে, যে ভালোবাসা বিকশিত হয়েছিল দুটি মনের মধ্যে, তা কালক্রমে মানবকল্যাণের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। আর এই ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটল তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। কুরি দম্পতি প্রথমে পিচব্লেন্ড থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পলোনিয়াম এবং রেডিয়াম আবিষ্কার করেন যা ইউরেনিয়াম থেকে দশ লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী। এই রেডিয়ামের ব্যবহার অপরিসীম। তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন, কোনও কোনও মৌলের পরমাণু ক্রমাগত ভেঙে গিয়ে রশ্মি বিকিরণ করে। এই বিকিরণ অন্য কোনও পদার্থ ভেদ করেও যেতে পারে। এই ধরনের পদার্থকেই বলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ আর এর গুনকে বলে তেজস্ক্রিয়তা। যে তেজস্ক্রিয়তা মানব সভ্যতাকে তেজোময় করে তুলেছিল সেই তেজস্ক্রিয়তাই আবিষ্কারকের প্রাণ হরণ করল, আবিষ্কারককে নিস্তেজ করল!

Skip to content