শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আন্দ্রেই জেলেজনিয়াকভ

অস্ত্রশস্ত্র বললেই আমাদের চোখের সামনে সবসময় ভেসে ওঠে বন্দুক, কামান-গোলা, তীর-ধনুক, তলোয়ার ইত্যাদি। কিন্তু এসব ছাড়াও অত্যাধুনিক এমন অস্ত্র রয়েছে যা উপরোক্ত সকল অস্ত্রশস্ত্র অপেক্ষা বহুগুণ শক্তিশালী। রাসায়নিক অস্ত্র। হ্যাঁ, নামটা শুনতে ভারী অদ্ভুত লাগলেও বিজ্ঞানের আশীর্বাদেই হোক বা অভিশাপেই হোক, রাসায়নিক অস্ত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই অস্ত্র শুধু যে মানুষের উন্নত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে তা নয়, উন্নত ধ্বংসাত্মক বুদ্ধিমত্তার পরিচয়কে জ্ঞাপন করে। এই অস্ত্র, যা মানুষের মৃত্যুর জন্য বা ক্ষতির জন্য রাসায়নিকগুলিকে ব্যবহার করে। আধুনিক যুদ্ধের সবচেয়ে মারাত্মক বিষয়গুলির একটি হল রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ। রাসায়নিক অস্ত্র শুধু যে মানুষেরই ক্ষতি করে তা নয়, যেখানে এর প্রয়োগ করা হয় সেই অঞ্চলের প্রাণীজগতেরও ক্ষতিসাধন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই এই অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। রাসায়নিক অস্ত্রের যুদ্ধে সৈন্যদেরকে নার্ভ এজেন্ট থেকে শুরু করে ফোস্কা এজেন্ট পর্যন্ত মারাত্মক রাসায়নিকগুলোর সঙ্গে যুঝতে হয়।

আজ এমন একজন ব্যক্তির কথা বলব যিনি ছিলেন সোভিয়েত রাসায়নিক অস্ত্রবিজ্ঞানী। রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ তাঁর শরীরেই হয়েছিল এবং তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। সৃষ্টির নেশা নাকি বিজ্ঞানের সাধনা -ইতিহাস সে বিষয়ে নীরব থেকেছে। ইতিহাস শুধু সাক্ষ্য দেয় ঘটনার।

আন্দ্রেই জেলেজনিয়াকভ। বাবা নিকোলাই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাসায়নিক শিল্পের উপপ্রধান। মস্কো যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যাচ্ছিল, সেই সময়ই আন্দ্রেইয়ের বাবা সোভিয়েত ইউনিয়নের কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির ডেপুটি হেড ছিলেন। সোভিয়েত কেমিক্যাল ওয়েপনস প্রোগ্রামে তাঁদের পরিবারের পরিষেবা প্রায় দুই বংশ পরম্পরা ধরে চলছিল।

১৯৭১- ১৯৯৩ এই সময়ের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়া ৫০টি স্নায়ু এজেন্টের সমন্বয়ের বাইনারি রাসায়নিক অস্ত্রের বিকাশ ঘটিয়েছিল। এগুলো ছিল একদল নার্ভ এজেন্ট। এদের মধ্যে কিছু বাইনারি রাসায়নিক অস্ত্র নোভিচক। ১৯৮০-র দশকে আন্দ্রেই জেলেজনিয়াকভ রাসায়নিক অস্ত্রের উপর কাজ করেছিলেন, সেই সময় ত্রুটিযুক্ত একটি হুডের কারণে মারাত্মক নার্ভ এজেন্ট তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়।

নোভিচকের বিষে আক্রান্ত হওয়ার পর আন্দ্রেই বলেছিলেন তাঁর চোখের সামনে ক্রমাগত ভেসে উঠছে লাল আর কমলা রঙের গোল গোল মতো কিছু জিনিস, কানের মধ্যে একটা টিং টিং শব্দ, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসা আর একটা অজানা ভয় তাঁকে গ্রাস করছে — যেন কিছু একটা হবে। ওয়েপন ল্যাবের ঘটনা যা তাঁকে নার্ভ এজেন্টের কাছে উন্মোচিত করেছিল তাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হল। বিষে আক্রান্ত হওয়ার পর আন্দ্রেই একটি চেয়ারে বসে সেই ল্যাবের কিছু মানুষকে বলেছিলেন —‘‘নোভিচক আমাকে ধরে ফেলেছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাকে হত্যা করবে।” এই বিষয়ে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন অধুনালুপ্ত সংবাদপত্র নোভয়ে ভ্রেমাকে। ১৯৯২ সাল নাগাদ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল।

নোভিচকের বিষ জেলেজনিয়াকভের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। সিরোসিস, টক্সিক হেপাটাইটিস, ড্যামেজ নার্ভ ও এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৩ সালে এক রাতে খাবার খাওয়ার সময় মস্তিষ্কের খিঁচুনিতে আন্দ্রেইয়ের জীবনাবসান হয়।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা, ১৯৯০ সালে জর্জ বুশ এবং মিখাইল গোর্বাচেভ রাসায়নিক অস্ত্র চুক্তিতে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন যে অনুষ্ঠানে, সেখানে বাঁশি বাজানোর কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন আন্দ্রেই জেলেজনিয়াকভ। সবাই সেখানে শপথ নিয়েছিল — রাসায়নিক অস্ত্র আর কেউ তৈরি করবে না। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই অস্ত্র তৈরি বন্ধ করার। আন্দ্রইয়ের মৃত্যু প্রমাণ করে সে সবই শুধু কথার কথা ছিল!

Skip to content