![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2024/02/Sarada-Devi.jpg)
শ্রীমা।
স্বামী প্রেমানন্দ বলেছেন, সারদা মা ঠাকুরের থেকেও বড় আধার। তিনি স্বয়ং ভগবতী, সাক্ষাৎ জগদম্বা। তিনি রাজরাজেশ্বরী এমন সাধ করে কাঙালিনী সেজেছেন। বলরাম বসু আর তাঁর স্ত্রী কামারপুকুরে শ্রীমাকে দেখে এসে অবাক হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা দেখেন, পুকুরপাড়ে ছেঁড়া কাপড়ে গেরো দিয়ে তাঁদের শ্রীমা কলমিশাক কুঁড়োচ্ছেন। এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখে কৃষ্ণভামিনী দেবীর চোখ দিয়ে জলের ধারা নামল। ঠাকুর যে বলে গিয়েছিলেন, ‘শ্বশুরের ভিটেয় থেকে কলমিশাক বুনবে আর মোটা কাপড় পরবে, কারও কাছে হাত পাতবে না’। মন্ত্রজপের মতো মা সারদা সেই নির্দেশ পালন করেছেন। নিজের হাতে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে শাক বুনেছেন। ঠাকুরের ভক্ত সন্তানদের তিনি সাধনভজনের সঙ্গে আর্তের সেবায় ব্রতী হতেও প্রেরণা দেন। কাশীতে সন্ন্যাসীভক্তদের সেবাকেন্দ্র দেখে তিনি আনন্দিত হয়ে আশীর্বাদ করেন। কিন্তু শ্রীম-সহ কয়েকজন ভক্ত আপত্তি করে বলেন যে, এতে সাধনে ব্যাঘাত ঘটবে। মা সারদা তখন স্পষ্ট বলেন যে, ঠাকুর বলে গেছেন, ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’। জীবের সেবা ছাড়া যে সাধনভজন মিথ্যে হবে। শ্রীমায়ের কথায় তখন সকলেই সহমত হয়। তাই ভগিনী নিবেদিতাকে স্বামিজী শ্রীমায়ের কাছে সমর্পণ করেন।
সেকালের এক বিধবা মহিলার পক্ষে একাধারে বিদেশিনী ও খ্রিস্টান মেয়েকে স্বীকার করা এক কথায় কল্পনাতীত ছিল। তাই স্বামিজির মনে প্রচ্ছন্ন কৌতুহল ছিল, শ্রীমা তাঁকে কীভাবে নেন দেখার। দেখা গেল যে, মা সারদা নির্দ্বিধায় এই খ্রিস্টানকন্যাকে ‘খুকি’ বলে কাছে টেনে নেন মায়ের মমতায়। পরে সারা বুল, জোসেফিন ম্যাকলাউড, ক্রিস্টিন প্রমুখ বিদেশিনীদেরও তিনি একইভাবে গ্রহণ করেন। এমনকি তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে খেয়েছেনও। নিবেদিতাও তাঁকে সত্যিকারের মা মনে করতেন এবং তাঁকে মা বলতেন। শুধু তাই নয়, তিনি বুঝেছিলেন যে শ্রীমার মধ্যে সতত বহমান জগজ্জননীর স্নেহধারা। শ্রীমা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, মা সারদা বর্তমান পৃথিবীর মহত্তমা নারী, পরমা মাতৃমূর্তি। তিনি শ্রীমাকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘মাগো, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ তুমি। আর তাতে নেই আমাদের বা জগতের ভালোবাসার মতন উচ্ছ্বাস। তোমার ভালোবাসা এক স্নিগ্ধ শান্তি যা প্রত্যেককে কল্যাণস্পর্শ দেয়’।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2024/02/Sarada-33.jpg)
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৩: সারদা মায়ের দার্শনিক দৃষ্টি
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2024/01/Uttam-Kumar-2-1.jpg)
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
নিবেদিতার বক্তব্য হল, সারদা মা ভারতীয় নারীর আদর্শ বিষয়ে ঠাকুরের বাণীর চরম প্রকাশ। একই সঙ্গে তিনি নতুন আদর্শেরও প্রথম প্রকাশ। ১৩০৪ সালের শেষে আবার কলকাতায় ফিরে শ্রীমা বোসপাড়া লেনের ১০/২ নম্বর বাড়িতে এসে থাকেন। সেই সময় তাঁর জীবনে পর পর কতগুলি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে। ১৩০৫ সালের মহাষ্টমীর দিন ৬ কার্তিক সন্ধ্যার পর স্বামিজি তাঁকে প্রণাম করতে আসেন ও ঠাকুরের উপর অভিমান করে বলতে থাকেন যে, এই তো ঠাকুর! কাশ্মীরে এক ফকিরের চেলা স্বামিজির কাছে যেত বলে সেই ফকির রেগে গিয়ে শাপ দিলে, তিনদিনের মধ্যে দাস্ত হয়ে এই জায়গা ছেড়ে স্বামিজিকে পালাতে হবে। আর সঙ্গে সঙ্গে কিনা তাই হল! সামান্য এক ফকিরের অশুভ শক্তিকে কেন ঠাকুর রোধ করতে পারলেন না। উত্তরে শ্রীমা বলেছিলেন, শঙ্করাচার্যও তো এমন করে নিজের শরীরে রোগ আসতে দিয়েছিলেন, শোনা যায়। ‘তোমার শরীরে রোগ আসতে দেওয়া আর তাঁর নিজের শরীরে আসতে দেওয়া যে একই কথা। তিনি তো ভাঙতে আসেননি, গড়তে এসেছিলেন। সবই বিদ্যা, বিদ্যাকে তো মান্য করা চাই। তিনি তো হাঁচি, টিকটিকি পর্যন্ত মেনেছেন’। তাতে স্বামিজি বলেন, ‘তুমি যাই বল না কেন, আমি মানিনা’। শ্রীমা বলেন, ‘না মেনে কি যো আছে? তোমার টিকি যে তাঁর কাছে বাঁধা। স্বামিজি অশ্রুসজল হয়ে দু’ হাতে মার শ্রীচরণ জড়িয়ে ধরলেন।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2024/02/Sundarban-2-1.jpg)
এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৬: সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল হকিকত
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2024/02/jyotirindranath-tagore.jpg)
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮০: ঠাকুরবাড়ির ফরাসি-পাচক
উত্তর ভারত পরিভ্রমণ শেষে ভগিনী নিবেদিতা কার্তিকের মধ্যভাগ থেকে আট, দশদিন শ্রীমার সঙ্গে বাস করেন। আমেরিকাবাসী মিসেস ওলি বুল আর মিস ম্যাকলাউড এই সময় ভারতে অবস্থান করছিলেন। সংকোচহীনভাবে শ্রীমা ও তাঁর সঙ্গিনীরা এই সকল বিদেশিনীদের সঙ্গে বসে আহারাদি করেন। মিসেস বুলের একান্ত আগ্রহে এই সময়ে এই প্রথম মায়ের দুখানা ফটো তোলা হয়েছিল। ফটোগ্রাফার হ্যারিংটনের তোলা প্রথম ছবিতে শ্রীমায়ের পায়ের দক্ষিণাঙ্গুলি কাপড়ে ঢাকা ছিল। কিন্তু মিসেস বুল দেশে নিয়ে গিয়ে শ্রীমায়ের ছবি পুজো করবেন বলে মায়ের শ্রীচরণ ফটোতে যাতে দর্শন করা যায়, তাই শ্রীমাকে অনেক বুঝিয়ে দ্বিতীয়বার ছবি তুলতে রাজি করান। গোলাপমা তখন মায়ের সঙ্গেই ছিলেন, তাঁর মুখে অনেকেই একথা শুনেছেন।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2024/02/Samay-Updates_Shukhalata-Rao.jpg)
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2024/02/china-rose.jpg)
হেলদি ডায়েট: অনেক শারীরিক সমস্যার সমাধান জবা ফুল
কালীপুজোয় শ্রীমা বেলুড়ে নবনির্মিত মঠে আসেন ও স্বহস্তে পুজোর জায়গা পরিষ্কার করে স্বয়ং ঠাকুরের পুজোকার্য সম্পন্ন করেন। ওইদিন ভগিনী নিবেদিতা অপরাহ্নে মঠে এসে শ্রীমা, স্বামিজি, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও শরৎ মহারাজকে নিয়ে বাগবাজারে ফিরে আসেন। তাঁদের সকলের উপস্থিতিতে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িতে নিবেদিতার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫ চৈত্র শ্রীমার জীবনের সেই বেদনাময় দিন। স্বামী যোগানন্দ যিনি বারবছর তাঁর সেবা ও স্বাচ্ছন্দ্যবিধানে সর্বতোভাবে নিয়োজিত ছিলেন, তিনি দীর্ঘ চারমাস রক্তামাশয় ও জ্বরে ভুগে অকালে চলে গেলেন। কাশীতে অতি কঠোর তপশ্চর্যার জন্য কয়েক বছর আগে থেকেই তাঁর শরীর ভেঙে যায়। যোগীন মহারাজের এই অসুখের সময় ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল ও বুড়োবাবা অর্থাৎ দীনু মহারাজ তাঁর খুব সেবা করেন। তাঁরা আগে থেকেই যোগীন মহারাজের সহকারিরূপে কাজ করতেন। বুড়োবাবা সম্ভবত যোগীন মহারাজের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন আর যোগীন মহারাজ ছিলেন শ্রীমার ‘অন্তরের বস্তু’। তাঁর অসুখ বাড়লে শ্রীমা কাঁদতেন। তিনি একটু ভালো আছেন দেখলে নিজেও ‘ভালো আছেন’ মনে করতেন। তাঁর জন্য ভেবে ভেবে মার শরীর শুকিয়ে যায়। তিনি দেহরক্ষা করলে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘বাড়ির একটা ইট খসল, এ বার সব যাবে’।— চলবে
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।