রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীমা।

বেলুড়ের বাড়িতে থাকার সময়েই ১৩০০ সালের পৌষমাসে শ্রীমা হঠাৎ খবর পেলেন যে, বলরাম বসুর একমাত্র কন্যা বিবাহিতা ভুবনমোহিনী আর নেই। মেয়ের শোকে ও ক্রমাগত রোগে ভুগে বলরামবাবুর স্ত্রী কৃষ্ণভামিনীর স্বাস্থ্যহানি ঘটে। তারপর স্বামী ও মেয়ের মৃত্যুতে তিনি একেবারেই ভেঙে পড়েন। তাঁর মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য তাঁকে কোন স্বাস্থ্যকর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা হলে তিনি শ্রীমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান। বলরামবাবুর একমাত্র সন্তান তাঁকে কৈলোয়ারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেই মতো মা সারদাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়।
কৃষ্ণভামিনী দেবীর সনির্বন্ধ অনুরোধে শ্রীমাও তাঁর সঙ্গে কৈলোয়ারে যান। তাঁদের সঙ্গে গিয়েছিলেন কৃষ্ণভামিনী দেবীর মা, গোলাপমা, স্বামী যোগানন্দ, সারদানন্দ, ত্রিগুণাতীতানন্দ, যোগীন মহারাজের বাবা নবীনচন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ। সকলে শাহাবাদ জেলার অন্তর্গত কৈলোয়ারে যান। এখানে সকলে মাসদুই থাকেন। শ্রীমা এখানকার বন্যহরিণদের দলবেঁধে স্বচ্ছন্দ বিচরণ আর পাখির মতন তাদের দ্রুতগতি দেখে বালিকার মতো খুশি হন। তিনি বলেন যে, ওদেশে ছোট ছোট খেজুরগাছ, তাতে রস হয়। শিয়ালে এসে রস খেয়ে ফেলে বলে লোকে মাটিতে গর্ত করে সারারাত তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। গর্তের মুখে তাদের মাথার ওপরে মাটির খোলা দিয়ে রাখে, মাঝে মাঝে মাথা তুলে দেখে আর ‘দূর-দূর’ করে শিয়াল তাড়ায়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৪: সুন্দরবনের মৃত ও মৃতপ্রায় নদী

মা সারদার স্নেহ ও সান্নিধ্য পেয়ে কৃষ্ণভামিনী দেবীর মনের অবস্থা অনেকটা স্থির হয়। তারপর তাঁরা সকলে কলকাতায় ফিরে যান। এইসময় শ্রীমা পুনরায় দেশে যান। আবার দেশ থেকে ফিরে একমাস বেলুড়ে থাকেন। এই সময় বাবুরাম মহারাজের মাতা মাতঙ্গিনী তাঁর নিজগৃহে নতুনভাবে জগদম্বা পুজো শুরু করলে তাঁর আহ্বানে যোগীনমা, গোলাপমা ও গুপ্ত মহারাজকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীমা আঁটপুরে যান। পুজোর কয়েকদিন সেখানে থেকে দেশে ফিরে আসেন।
১৩০১ সালের শেষের দিকে কলকাতায় ফিরে পুনরায় মা সারদা কাশী হয়ে বৃন্দাবনে যাওয়ার সঙ্কল্প করেন। তীর্থ করার মানসে নিজের মা শ্যামাসুন্দরী দেবী ও ভাইদের দেশ থেকে নিয়ে আসেন। স্বামী যোগানন্দ, যোগীনমা ও গোলাপমাও তাঁদের সঙ্গে যান। ফাল্গুন থেকে বৈশাখের কয়েকদিন প্রায় দুইমাসের কিছু বেশি সময় তাঁরা বৃন্দাবনে আবার সেই কালাবাবুর কুঞ্জে থাকেন। এই সময় শান্তিরাম ঘোষ সস্ত্রীক হরিবল্লভ বসুকে নিয়ে দোলপূর্ণিমার দুই একদিন আগে বৃন্দাবনে পৌঁছন। প্রায় দেড়মাস পর তাঁরা যখন বৃন্দাবন থেকে ফিরে আসেন, শ্রীমা তখনও সেখানে থাকেন।
আরও পড়ুন:

ডায়াবিটিস বাগে আনতে কোন প্রোটিন খেতেই হবে, আর কী কী এড়াতেই হবে?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

কলকাতায় ফেরার পর মা সারদা তাঁর মা ও ভাইদের দেশে পাঠিয়ে দেন। আর নিজে মাস্টারমশাইয়ের কলুটোলার বাড়িতে দুই সপ্তাহ থেকে দেশে ফিরে যান। বৃন্দাবন থেকে শ্রীমা একটি ছোট বালগোপালের মূর্তি নিয়ে আসেন, তবে পুজো না করে রেখে দেন। একদিন তিনি দেখেন যে, গোপাল তাঁর কাছে এসে অনুযোগ করছে, ‘তুমি আমাকে এনে ফেলে রেখেছ, তুমি আমাকে খেতে দাওনি, পুজো করনি, তুমি পুজো না করলে আমাকে কেউ পুজো করবে না’। পরদিনই মা সারদা বালগোপালের মূর্তি বার করে তার মুখচুম্বন করে পুজো করে তাঁকে নিত্যপূজিত ঠাকুরের পাশে রাখেন।

১৩০৩ সালের বৈশাখে কলকাতায় এসে শ্রীমা সরকারবাড়ি লেনের গুদামওয়ালা বাড়িতে পাঁচ-ছয় মাস বসবাস করেন। গোপালের মা, গোলাপমা, প্রমুখ স্ত্রীভক্তদের সঙ্গে তিনি ওই বাড়ির তেতলায় থাকতেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ, যোগানন্দ আর অপর দুই একজন সাধু দোতলায় থেকে তাঁর সেবার দেখাশোনা করতেন। বৈশাখ মাসের শেষে বলরামবাবুর ছেলের বিয়ে উপলক্ষে তাঁকে নিমন্ত্রণ করে বসুভবনের কাছে, ৫৯/২, রামকান্ত বসু স্ট্রিটের শরৎ সরকারের বাড়িতে এনে রাখা হয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

বসুভবনে তখন কলি ফেরান চলছিল। শরৎ সরকার স্বামিজীর মন্ত্রশিষ্য ভক্ত ছিলেন। তার বাড়িতে শ্রীমা একমাস থাকেন। শরৎবাবুর মাসতুত ভাই গৌরবাবু অর্থাৎ নরেশ ঘোষ তখন ছোট। তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, একদিন সরকারবাড়িতে গৌর প্রভৃতি আট-দশ বছরের ছেলেরা রোজ দুপুরে বুড়ি-বুড়ি খেলত। সেদিন ছেলেদের মধ্যে কেউ বুড়ি সাজতে চাইল না।

তারা সারদা মাকে বলল, ‘তুমি আমাদের বুড়ি হবে’? শ্রীমা ছেলেদের খেলা তেতলা থেকে দেখছিলেন, তাদের কথা শুনে ধীরে ধীরে গিয়ে বুড়ির আসন ইটের ওপর বসলেন। মহানন্দে ছেলেরা তাঁর মাথায় হাত রেখে দাঁড়াল আর একজন তাদের তাড়া করছে, এমন সময় আওয়াজ শুনে গৌরের মা আসেন। আর ছেলেদের কাণ্ড দেখে তিনি তাদের ধমক দিয়ে বলেন যে, তারা আর বুড়ি করবার লোক পায়নি। মা সারদাকে তিনি প্রণাম করে ঘরে যেতে অনুরোধ করেন। শ্রীমা তখন বলেন, ‘ওদের তো একজন বুড়ি চাই, কেউ হতে চাচ্ছিল না; তাই আমিই বুড়ি হলুম’। এমনই সহজ, সরল ছিলেন মা সারদা।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content